Wednesday 25 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর প্রভাব এবং ভবিষ্যত করণীয়

নাঈমা সুলতানা
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:১১ | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭:১২

বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ নিয়ে বিজ্ঞানীদের উদ্বেগের একটি বিষয় হলো – গ্লোবাল ওয়ার্মিং তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণ, পরিবর্তিত জলবায়ু এবং ক্রমাগত দূষণে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাবগুলো গ্রাস করছে বাংলাদেশকেও। সাথে ঘনজনবসতি ও অসচেতনতা কঠিন করে তুলছে মিটিগেশন ও অ্যাডাপ্টেশনের মতো পদক্ষেপগুলো। বাংলাদেশে দৃশ্যমান গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো জানার মাধ্যমে তা থেকে পরিবেশকে রক্ষা করার সম্ভাব্য করণীয় নিয়ে কাজ শুরু করার এখনই সময়।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবী ব্যাপী গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর যেসকল প্রভাব দৃশ্যমান তা হলো – মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বিরূপ চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, বন্যা বা খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি। এই পরিবর্তনসমূহ শুধু ভৌগোলিক পরিবেশেরই ক্ষতি করে না, বরং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে, কৃষি উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং সর্বোপরি মানুষের জীবনকে ব্যাহত করে। তাই পৃথিবীকে এহেন বিপর্যয়ের মুখ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ব্যক্তি ও সামাজিক পর্যায়ে পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশেও এখন গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো দৃশ্যমান, বেশ প্রকট বলা যায়। যেমন – তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়- বন্যা- খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া, মৎস্যসম্পদ ও প্রাণীবৈচিত্র্য নষ্ট হওয়া, দূষণ সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, অতিরিক্ত গরম বা শীত অনুভূত হওয়ার বিষয়ে আমরা সকলেই ভুক্তভোগী। অতিরিক্ত শুষ্কতা কিংবা হিট ওয়েভের মতো বিপর্যয়গুলো সম্প্রতি বেশিই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত শতকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। রাজধানী ঢাকায় তাপমাত্রা সাধারণ তাপমাত্রার চেয়েও ৩-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি রেকর্ড করা যায়। ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান এবং সারাদেশের নদীগুলো এসে এই সুবিশাল জলরাশিতে মিলেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে এই জলপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে, তলিয়ে যাবে দক্ষিণাঞ্চল। যা বিপদে ফেলবে পুরো বাংলাদেশের বাসস্থান ব্যবস্থা, কৃষি উৎপাদন ও অর্থনীতিকে। বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে জলমগ্ন হয়ে পড়বে দেশের ২০% জমি। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে, উপকূলীয় অঞ্চলের জীবনযাপন ব্যাহত করছে ক্রমাগত।

২০০৭ সালে সিডর দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকবে – কীভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়, বাস্তুচ্যুত করে। দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অসংখ্য নদীর গতিপথ, নিচু ভূমি বন্যার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। বন্যায় কৃষি জমি তলিয়ে যাওয়া উৎপাদন কমিয়ে দেয়, লবণাক্ততা বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে, ধানের উৎপাদন কমে যায়। যা বন্যা পরবর্তী খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে। ফলস্বরুপ কৃষকেরা ফসলের অপ্রতুলতা ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। শুধু পরিবেশের ক্ষতিই না, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ভয়াবহতা দেখা দিয়েছে মানব স্বাস্থ্যের প্রতিও। বায়ুবাহিত শ্বাসকষ্টের সমস্যা, দাবদাহ জনিত হিট স্ট্রোক, হৃদরোগ, পানিবাহিত কলেরা, ডায়রিয়ার মতো রোগ বেড়ে যাচ্ছে। এমনকি ম্যালেরিয়া- ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। তাই বাসস্থানের সংকট, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, কৃষিজমি হ্রাস, স্বাস্থ্যঝুঁকি সর্বক্ষেত্রে জীবন বিপন্ন হওয়া থেকে বাঁচতে প্রয়োজন সচেতনতা ও কার্যকরী উদ্যোগ। শুধুমাত্র কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ পলিসি বা প্রটোকল দ্বারা গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সমাধান সম্ভব নয়। হতে হবে যথাযথ বাস্তবায়ন এবং সচেতন কার্যক্রম – ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয়, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কনভেনশন ও প্রটোকল অনুসরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন – আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত কপ- ২৯ সম্মেলন, কিয়োটো প্রটোকল কিংবা মন্ট্রিল প্রটোকল সবখানেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা ক্লাইমেট চেইঞ্জ এর মতো বিপর্যয়গুলোকে। সেই সাথে এসকল সমস্যা সমাধানে করণীয় কী হতে পারে, বিশ্বব্যাপী কী কী উদ্যোগ নেওয়া সমীচীন হবে -তাও স্থান পেয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলতে গেলে- বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি এনজিও সমূহ গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। Bangladesh Delta Plan 2100 যা একটি শতবর্ষব্যাপী কৌশলগত পরিকল্পনা। এটি পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করে এই ডেল্টা প্ল্যান। এছাড়াও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (BCCTF) জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দেশজ সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারকে মাথায় রেখে এই তহবিলটি গঠন করা হয়েছে। শুধু সরকারি উদ্যোগই নয়, বেসরকারি এনজিও- আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো জলবায়ু দূষণ কমাতে ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় কাজ করে চলেছে। Climate & Clean Air Coalition (CCAC) এর সাথে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব স্বল্পমেয়াদী জলবায়ু দূষণ কমাতে ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করছে। এছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সহায়তা এসকল কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। লবণাক্ততা ও খরা সহিষ্ণু ফসল উৎপাদন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, জনসচেতনতা সৃষ্টি এরূপ কিছুক্ষেত্রে সাফল্যের দেখা মিলেছে।

আশা করা যায়, ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগসমূহ বাংলাদেশে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো হ্রাসে সহায়তা করবে। বিপন্নের হাত থেকে বাঁচাবে জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যকে।

লেখক: শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

নাঈমা সুলতানা বাংলাদেশে গ্লোবাল ওয়ার্মিং মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর