বায়ু দূষণ মনিটরিংয়ে প্রযুক্তির গুরুত্ব
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৮:১০
আমাদের এই পৃথিবীতে প্রায় শতাব্দী ধরে বহু শহর বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বিশ্ববাসীর জন্য বায়ু দূষণ এখনো একটি বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে পরিবেশ দূষণ রোধ (বায়ু পানি ও মাটি), প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও এর সদ্ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে। এদিকে মানুষের বেঁচে থাকার উপাদান গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু। কিন্তু মানব সৃষ্ট বহুবিধ কারণে বাতাস তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে অনিষ্টকর পদার্থের সমাবেশ যখন মানুষ ও তার পরিবেশের ক্ষতিকর হয়ে ওঠে সেই অবস্থাকে বায়ুদূষণ বলে। প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদান গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু বা বাতাস। অন্যান্য যে কোনো দূষণের চেয়ে বায়ুদূষণের পরিধি এবং ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি। কারণ বাতাস স্বল্প সময়ে দূষিত পদার্থকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে পারে। বায়ু দূষণ স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় পরিবেশগত ঝুঁকিগুলোর মধ্যে একটি। বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরেন সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। এই প্রতিষ্ঠানটি বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দিয়ে থাকেন ও সতর্ক করেন। বায়ুমান ৩০০–এর বেশি হলেই তা দুর্যোগপূর্ণ হয়। আর পরপর তিন দিন টানা তিন ঘণ্টা করে দূষণ এ পর্যায়ে থাকলে জরুরি স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ঘোষণার রীতি রয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন শহরের মধ্যে বায়ুদূষণে কয়েকবারই প্রথম অবস্থানে ছিল রাজধানী ঢাকা। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক থেকে এ তথ্য জানা গিয়েছিল।
প্রতিদিনই অবনতি হচ্ছে রাজধানী ঢাকার বায়ুর মান। এদিকে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ব্যস্ততম ঢাকায় যানবাহনের চলাচল কম এবং অনেক কলকারাখানাও বন্ধ থাকার পরেও বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষে ছিল ঢাকা। বাংলাদেশে বায়ু দূষণের যে অবস্থা সেটা একদিনে এই জায়গায় আসেনি। গত প্রায় দেড় যুগ ধরে ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণের মধ্যেই দিন কাটাতে হচ্ছে আমাদের। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো কোনো সময়েই বায়ুদূষণ কমানোর বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বর্তমানে ঢাকার বাতাসে সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়াও কার্বন-মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড এবং সীসাও রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত, যা মারাত্মক ক্ষতি করছে মানবদেহের। জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক এই বায়ুদূষণ মানুষ এবং অন্যান্য জীবের জন্য এখন হুমকি স্বরূপ। দূষিত বায়ু গ্রহণের মাধ্যমে শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসই নয়, সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইডগুলোর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায় কাশি, দম বন্ধ, দীর্ঘস্থায়ী হাঁপানি, ফুসফুসে পানি জমে রোগীর মৃত্যুও হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। পরিবেশ দূষণের এক ভয়াবহ দিক হচ্ছে বায়ুদূষণ। পরিবেশ দূষণকারী অদৃশ্য এই সূক্ষ্ম কণার উৎস শনাক্তকরণ এবং সমাধানের জন্য জৈব মডেলিং তৈরি হচ্ছে কম্পিউটার সিমুলেশন, জিআইএস, ডাটা মাইনিং ইত্যাদি পদ্ধতিতে। এসব মডেল ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’-এর রিয়েল-টাইম ডেটার (তথ্যের) সঙ্গে সমন্বয় করে বিশাল ডেটাবেজ তৈরি করছে বিভিন্ন আবহাওয়া স্টেশন থেকে আসা প্রতি মুহূর্তের ডেটা (তথ্য) দিয়ে। কেন্দ্রীয় সার্ভারে থাকা এই ডেটাবেজ পরবর্তীতে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী গ্রাফ ও সংখ্যা আকারে দৃশ্যমান করা হয় বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে। সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক এমন গুরুত্বপূর্ণ ফল আপলোড করা হয় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। অডিও-ভিডিও ও এনিমেশন করে দেখানো হয় নানা অ্যাপস, ফেসবুক ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। গ্রাহকরা এই গ্রাফ, সংখ্যা ও ফল দেখে বুঝতে পারে যে, বাতাস কতটা সুদ্ধ কিংবা দূষিত এবং প্রতিকারের জন্য কি করণীয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের তৈরি নিজস্ব সফটওয়্যার দিয়ে এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং করে থাকে।
গুগল ম্যাপে সারাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গার এয়ার কোয়ালিটি দেখার সুযোগ আছে সবার জন্য। মূলত দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে মাটি, পানি এবং বায়ু দূষণ স্থায়ীভাবে পরিবেশগত সমস্যায় পতিত হচ্ছে। টেক্সটাইল, মাইনিং, ট্যানারি, মেটাল প্যাটিং, সার ও কৃষি শিল্প, ব্যাটারি, কীটনাশক, আকরিক শোধনাগার, পেট্রোকেমিক্যালস, কাগজ উৎপাদন, ইটভাটি, যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো বর্জ্য পদার্থ যেখানে সেখানে ফেলানো বায়ু ও পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। পরিবেশ দূষণের আরেকটি ভয়াবহ দিক হচ্ছে ওজোন স্তরের ক্ষয়। এর আল্ট্রাভায়োলেট রেডিয়েশন বা অতিবেগুনী তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রভাবে ত্বকের ক্যান্সার ও চোখের বড় রকমের ক্ষতি হয়। বায়ুদূষণের ফলে গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া বা সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পড়ে পুরো প্রাণিজগতের ওপর। বায়ু দূষণের কারণে খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে উদ্ভিদ নিজেও বিপদে পড়ে এবং উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীরাও পড়ে বিপদে। ভয়াবহ এই বায়ু দূষণ থেকে পরিত্রাণের জন্য শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা, নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন ও কাজের সময় ঢেকে রাখা, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা, অবৈধ ইটভাটি বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা, প্রচুর গাছ লাগানো, ছাদ বাগানে উৎসাহিত করা,জলাধার সংরক্ষণ ইত্যাদি ব্যাপক হারে বাড়ানো দরকার। এদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশে বায়ুর গুণগত মান সঠিক রাখার জন্য প্রযুক্তিবিদরাও কাজ করে যাচ্ছেন দিনরাত। এগুলো সবুজ প্রযুক্তি বা গ্রিনটেক, এনভায়রনমেন্টাল বায়োটেকনোলজি ইত্যাদি নামে পরিচিত। এসব জৈবপ্রযুক্তি দূষিত পরিবেশের (বায়ু, পানি, ভূমি) প্রতিকারে অসম্ভব ভূমিকা রাখছে।
লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এএসজি