Saturday 04 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জসীম উদ্দীন: গ্রামীণ বাংলার কবি

আজহার মাহমুদ
১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:২৮

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতিকে তার লেখনীতে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি ‘পল্লী কবি’ নামে খ্যাত, কারণ তার রচনাগুলোতে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনজীবন, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির এক জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে, জসীম উদ্দীনের কবিতা গ্রামীণ বাংলার সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। তার রচনায় পল্লী মেলার গান, পালাগান, গাজীর গান এবং গ্রামীণ উৎসবের রঙিন চিত্রায়ণ পাওয়া যায়। তার গীতিকবিতাগুলো বাংলার লোকসংগীতের সাথে মিশে গিয়ে আজও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়।

বিজ্ঞাপন

জসীম উদ্দীনের সাহিত্যিক যাত্রা শুরু হয় ছাত্রজীবনেই। তার প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘কবর’। এটি তার ছাত্রজীবনে রচিত হলেও পরে ‘রাখালী’ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। এই কবিতায় দাদির কবর নিয়ে নাতির অনুভূতি এবং পারিবারিক বন্ধনের এক হৃদয়স্পর্শী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এটি গ্রামীণ পারিবারিক সম্পর্ক এবং আবেগের এক অপূর্ব চিত্র। দাদির কবরের পাশে বসে নাতি তার শৈশবের স্মৃতি আর পরিবারের আন্তরিকতা স্মরণ করছে। এখানে পারিবারিক বন্ধন এবং সময়ের গতিপ্রকৃতি দারুণ সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি আজও বাংলা সাহিত্যের অনন্য একটি কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

বিজ্ঞাপন

জসীম উদ্দীনের কবিতায় গ্রামীণ জীবনের আনন্দ-বেদনা, প্রেম-ভালোবাসা এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট বেশ গুরুত্বের সাথে ফুঠে উঠেছে। তার লেখা ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ এবং ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ গ্রন্থ দুটি পড়লে এই বিশেষণও কবির জন্য কম হয়ে যাবে। এই দুই গ্রন্থে প্রেম, বিয়োগান্তক ঘটনা এবং গ্রামীণ জীবনের চিত্র এতটাই জীবন্তভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যে আজও গ্রন্থগুলো পাঠকদের হৃদয়ে দাগ কাটে।

‘নকশী কাঁথার মাঠ’ একটি কাব্যনাট্য। এটি জসীম উদ্দীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা বলা যায়। যেখানে বাংলার গ্রামীণ জীবন, প্রেম, বিরহ এবং মৃত্যুর এক অনবদ্য কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। রূপাই ও সাজু নামের দুই চরিত্রের প্রেমকাহিনি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এটি গ্রামীণ জীবনের প্রকৃত রূপও তুলে ধরে। এই কাহিনিতে বাংলার মেঠোপথ, পুকুরপাড়, ধানখেত এবং কাঁথার নকশার মতো ঐতিহ্য এতটাই জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে পাঠক যেন পুরো গ্রামীণ পরিবেশের অংশ হয়ে যান।

এই কবিতায় কাঁথার নকশা একটি প্রতীক। এটি সাজুর ভালোবাসা, স্মৃতি এবং জীবনের দুঃখ-কষ্টের ধারক। রূপাইয়ের জন্য সাজুর সেলাই করা নকশী কাঁথা তাদের অমর প্রেমের স্মারক হয়ে উঠে। এখানে প্রকৃতি এবং অনুভূতি একত্রে মিশে গেছে, যা এই কবিতাকে বাংলার সাহিত্যকীর্তির এক অনন্য উদাহরণ করে তুলেছে।

‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ আরেকটি বিখ্যাত রচনা, যা জসীম উদ্দীনের কবি-প্রতিভার উৎকর্ষকে প্রমাণ করে। এখানে গ্রামীণ প্রেমের সাথে সামাজিক বৈষম্য এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-দুর্দশার এক অপূর্ব মিশ্রণ দেখা যায়। এই কবিতায় মানুষের অন্তর্দহন এবং প্রকৃতির মাধুর্যের সমান্তরালভাবে উপস্থিতি এক গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে। এটি বাঙালি পাঠকদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থে মোট ছয়টি পর্ব। কবি জসীমউদ্দিন এই ছয় পর্বকে ভিন্ন নামে আখ্যায়িত করেছেন। যথা- নমুদের কালো মেয়ে, নীড়, পলায়ন, পূর্ব্বরাগ, বেদের বহর, বেদের বসাতি।

জসীম উদ্দীনের কবিতায় প্রকৃতি কখনো পটভূমি নয়, বরং তা একটি জীবন্ত চরিত্র। তার কবিতাগুলোতে নদী, মাঠ, ধানখেত, শাপলা-ফুলের সৌন্দর্য, কাক ডাকার ভোর-সবকিছু এমনভাবে চিত্রিত হয়েছে যে পাঠক মনে করেন তিনি সরাসরি সেই পরিবেশে উপস্থিত। কবির লেখায় গ্রামীণ বাংলার প্রকৃতি, কৃষকের জীবন, তাদের সংগ্রাম এবং সামাজিক বন্ধনগুলো খুবই শক্তিশালিভাবে ফুটে উঠেছে। তার কবিতাগুলোতে নদী, মাঠ, ধানক্ষেত, মাটির ঘর এবং মানুষের জীবনচিত্র এতটাই জীবন্ত যে পাঠক সহজেই সেই পরিবেশ অনুভব করতে পারেন। বলা যায়, জসীম উদ্দীনের কবিতায় প্রকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বাংলার নদী, মাঠ, বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি, মেঠোপথ এবং গ্রামের সন্ধ্যার দৃশ্য কবির লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠে। তার কবিতাগুলো পড়লে মনে হয়, পাঠক যেন গ্রামবাংলার এক অদেখা সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছে।

জসীম উদ্দীন শুধু কবিতায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি গীতিকবিতাও রচনা করেছেন। তার অনেক গান বাংলার লোকসংগীতের অংশ হয়ে উঠেছে। এসব গানে কৃষকের জীবন, গ্রামীণ উৎসব এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্যভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কবি জসীম উদ্দীন তার সৃষ্টিশীলতার জন্য একাধিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তিনি ‘একুশে পদক’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন। তার লেখা শুধু সাহিত্যিক গুরুত্বই বহন করে না, তা গ্রামীণ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবেও কাজ করেছে। অনেকেরে মতে,রবীন্দ্রত্তোর বাংলা কবিতায় অন্যতম প্রধান মৌলিক কবি জসীম উদ্দীন।

১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া কবি ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তবে তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে তিনি আজও বেঁচে আছেন। কারণ তিনি ছিলেন প্রকৃতির কবি। তিনি গ্রামীণ জীবনের সৌন্দর্য ও সংগ্রামের কাব্যিক ভাষ্য রচনা করেছেন। তার লেখনী বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে গ্রামীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসা যায় এবং তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যায়। গ্রামীণ জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ এবং প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ তার রচনায় চিরকাল বেঁচে থাকবে। তার সাহিত্য শুধু এক সময়ের প্রতিচ্ছবি নয়; এটি বাংলার চিরন্তন ঐতিহ্যের ধারক।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

আজহার মাহমুদ জসীম উদ্‌দীন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর