Monday 06 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

র‍্যাগিং মুক্ত ক্যাম্পাস: ২০২৫-এ পরিবর্তন আসবে কি?

ফাহিম হাসনাত
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:০৭

উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াকে বলা হয় উচ্চশিক্ষা গ্রহনের স্বপ্নের আঙ্গিনা। বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে কোনো একটি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা। সেই স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে একজন শিক্ষার্থী অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তার কাঙ্খিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা সুযোগ পায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরই তাকে নতুন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আর সেটা হল র‍্যাগিং।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিং জিনিসটা খুবই পরিচিত একটি শব্দ। কম বেশি সবারই এই র‍্যাগিং এর সম্মুখীন হতে হয়েছে। র‍্যাগিং শব্দটি এসেছে মূলত ইংরেজি ‘Ragging’ থেকে। যার অর্থ হলো- উত্তেজিত করা, খ্যাপানো বা চটানো। এক কথায় সিনিয়র শিক্ষার্থী কর্তৃক নবীন শিক্ষার্থীদের নানাভাবে শারীরিক-মানসিক অত্যাচার ও হেনস্তার করার নামই হল র‌্যাগিং। গালিগালাজ, বিব্রত পরিস্থিতিতে ফেলা, এমনকি তাদের পিতা-মাতা ও নিজ জেলা নিয়ে নানাভাবে হয়রানি করা হয় এই প্রক্রিয়ায়। র‌্যাগিং একটি দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ, যা প্রাচীনকাল থেকে বিবর্তিত হয়ে আজকের রূপ ধারণ করেছে। আধুনিক কালে র‌্যাগিং এর প্রচলন শুরু হয় ১৯ শতকের শেষের দিকে। ১৯৩০-৪০ এর দশকে ভারতীয় উপমহাদেশে বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিংয়ের প্রচলন শুরু হয়। ১৯৬০-৭০ এর দশকে র‌্যাগিং একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশসহ পুরো পৃথিবীতে এটি আরো ব্যাপক রূপ ধারণ করে।

বিজ্ঞাপন

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ নতুন ছাত্রছাত্রী কোনো না কোনো ধরনের র‌্যাগিংয়ের শিকার হন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই হার একটু বেশি, ৭০-৮০ শতাংশ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তুলনামূলক কম, প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কোনো না কোনো ধরনের র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়েছে বা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় ২০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী র‍্যাগিং এর মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে র‍্যাগদাতা সিনিয়র শিক্ষার্থীরা এই কালচারটাকে র‍্যাগিং বলতে নারাজ। তাদের ভাষ্যমতে এটা নাকি পরিচয় পর্ব। বর্তমানে এই পরিচয় পর্ব হল র‍্যাগিং এর আপডেট ভার্সন। তারা এই পরিচয় পর্বকে ফান হিসেবেই উপভোগ করে। তাদের মতে, এর মাধ্যমে জুনিয়রদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় ও সখ্যতা গড়ে ওঠে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, মূলত তথাকথিত এই পরিচয় পর্বের আদলেই শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্মম অত্যাচার করা হয়। বলা যায় নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য এটা একপ্রকারের মানসিক শাস্তি।

ধরা যাক, একজন শিক্ষার্থী সিনিয়র ভাইকে তার পরিচয় দিল। পরিচয় দেবার সময় একটু ভুল হলেই বলে, প্রথম থেকে আবার সম্পূর্ণ পরিচয় বল। এভাবে একটার পর একটা ভুল ধরবে এবং বারবার একই পরিচয় জিজ্ঞেস করার মাধ্যমে তারা একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি ফেলার চেষ্টা করে। আবার, কেউ কোনো সিনিয়র ভাইকে দেখা হলে সালাম দিল না। সেজন্য পরিবর্তে তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ ও মানসিক নির্যাতন করবে। ফেসবুকেও তাদের কাছ থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই। জোর করে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠানো এবং ভাইয়ের প্রতিটি পোস্টে লাইক কমেন্ট করাও এর অন্তর্ভুক্ত। অশ্লীল শব্দ দিয়ে নামতা বলতে বলা, আপত্তিকর বিষয় অভিনয় করে দেখানো, অশালীন ভাবে নাচ করা, সিনিয়র আপুকে প্রপোজ করা, কান ধরে উঠবস করা, কলম দিয়ে ক্লাস রুম পরিমাপ করা, সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁকা দেয়া, গাছে উঠানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানো, শীতের মধ্যে খালি গায়ে হাঁটা ইত্যাদি তাদের তথাকথিত পরিচয় পর্বের অংশ। তাছাড়া একটু ভুল হলে বা তাদের মন মতন কিছু না হলেই অকথ্য ভাষার গালাগাল ত আছেই। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়রদের তৈরি করা কিছু আইন তথা ম্যানার রয়েছে। যেমন- নবীন শিক্ষার্থীরা বাধ্যতামূলক ভাবে সবাইকে সালাম দিতে হবে, কলারযুক্ত টিশার্ট পড়তে পারবে না, শার্টের হাতা ফোল্ড করতে পারবে না, ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় হাটাহাটি করতে পারবে না ইত্যাদি।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে তাদের নিজস্ব কোনো হল নেই। সেক্ষেত্রে, শিক্ষার্থীদের নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাতায়াত করতে হয়। আর এই ভার্সিটির বাসগুলো হল একেকটা পরিচয় পর্বের টর্চার সেল। এখানেও ঠিক একই কায়দায় পরিচয় পর্বের সকল প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা হয়। যার দরুন, ভয়ে অনেক শিক্ষার্থীই ভার্সিটির নিজস্ব বাস থাকা সত্বেও বিকল্প মাধ্যমে ক্যাম্পাসে আসে।

বেশ কিছুদিন আগে কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনের সাথে ঘটে যাওয়া নৃশংস র‍্যাগিং এর ঘটনা আমাদের সবারই জানা। হলের একটা গনরুমে ডেকে নিয়ে রাতভর তার সাথে চলে পাশবিক নির্যাতন। এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় মারা এবং মুখ চেপে ধরে গালিগালাজ করা হয়। এমনকি তাকে ময়লা গ্লাস মুখ দিয়ে পরিষ্কার করানো হয়। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার ছিল, জোর করে তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয়। ওই ভিডিও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করার হুমকিও দেয়া হয়। চিন্তা করুন পাশবিকতার ও হিংস্রতার কোন পর্যায়ে চলে গেছি আমরা! এক আবরার ফাহাদকে ত তারা বাঁচতেই দিল না। অন্যদিকে ফুলপরীর মতন এরকম হাজার হাজার শিক্ষার্থী আজ জীবিত লাশ হয়ে বেঁচে আছে।

সম্প্রতি হাইকোর্ট কর্তৃক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বুলিং’ (কটূক্তি, হেনস্তা বা অপমান করা) ও ‘র‍্যাগিং’ (হুমকি, গালাগাল, নিপীড়ন) রোধে করা নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। নীতিমালায় মৌখিক, শারীরিক, সামাজিক, সাইবার ও যৌনসংক্রান্ত বুলিং ও র‌্যাগিংয়ের সংজ্ঞা রয়েছে। এই নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র‍্যাগিং প্রতিরোধে এক বা একাধিক কমিটি গঠন ও গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্ত জ্ঞানচর্চা, মেধা বিকাশ ও গবেষণা করার জায়গা। এখানে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। র‍্যাগিং নামক অসুস্থ সংস্কৃতি আমাদের স্বাধীন জ্ঞান চর্চা ও মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় বাধা। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীই মেধাবী। এতে কোনো সন্দেহ নেই। লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর সাথে প্রতিযোগিতা করে আজ তারা এই জায়গায়। কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, দেশ সেরা বিজ্ঞানী, বিচারক, এমনকি দেশকে যারা আগামীতে নেতৃত্ব দিবে তারাও কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির একদম প্রাথমিক পর্যায়েই একটা শিক্ষার্থীকে এরকম অসুস্থ ও নোংরা সংস্কৃতির ভুক্তভোগী হতে হয়। যার ফলে একজন শিক্ষার্থী শুরুতেই একটা প্রবল মানসিক ধাক্কা খায়। অনেকের ক্ষেত্রে সেটা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এই মানসিক আঘাত এতটাই তীব্র হয় যা তাকে আত্মহত্যা পর্যন্তও নিয়ে যায়। এমন নজিরও আমরা দেখেছি। সবচেয়ে বড় কথা হল, যে ছেলেটি র‌্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে সে নিশ্চয়ই আগামীতে এর চেয়ে তীব্র মাত্রায় র‌্যাগিং করার পরিকল্পনা করবে। যার ফলে এই নোংরা অপসংস্কৃতি দিনদিন বৃদ্ধি পেতেই থাকবে।

সুতরাং, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এটাই চাওয়া থাকবে যেন প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাগিং তথা পরিচয় পর্ব নামক নোংরা অপসংস্কৃতি মুক্ত থাকে। বেশির ভাগ সময়ই এই র‌্যাগিং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বাস্তবতা হয়ে দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ বা আইনের সহায়তা ছাড়া সমস্যার সমাধান হওয়া কঠিন। ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে র‍্যাগিং এর বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে। আমাদের দেশেও এ নিয়ে বেশকিছু নীতিমালা রয়েছে এবং সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করে কার্যকর করতে হবে। এটি যেহেতু মানবতা বিরোধী অপরাধ সেক্ষেত্রে অপরাধ প্রমানিত হলে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও শিক্ষকরা র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করবে, এমনটাই প্রত্যাশা করি। সর্বোপরি, একটা বাক্যের মাধ্যমে লেখাটি শেষ করি, দেখা হলে ভয়ে সালাম দিয়ে সম্মান দেখানো আর আড়ালে গিয়ে বকা দেয়া কখনও সম্মান হতে পারে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

ফাহিম হাসনাত মুক্তমত র‍্যাগিং মুক্ত ক্যাম্পাস

বিজ্ঞাপন

বিপিএলে ছক্কার রেকর্ড
৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১৯:৪১

আরো

সম্পর্কিত খবর