কিশোর অপরাধ, আমাদের করণীয়
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:০১
কিশোর-কিশোরী হলো ক্ষেত্রবিশেষে ১০ বছর থেকে ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি বয়সী ছেলে-মেয়ে। যদিও একেক আইনে একেক বয়সীদের শিশু ও কিশোর হিসেবে অভিহিত করে থাকে। আর গ্যাং অর্থ দল। নির্দিষ্ট কিছু লোকের একটা দলকে গ্যাং বলে। গ্যাং শব্দটি সাধারণত অপরাধ বা নেতিবাচক কাজে জড়িত কোনো দল বা গ্রুপ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। অপরাধের সাথে জড়িত কিশোরদের প্রত্যেকটি দলকে কিশোর গ্যাং বলে। এই মুহূর্তে দেশে অপরাধ প্রবণতা এতো বেশি বেড়েছে যে, পত্রিকা, টেলিভিশন তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায় মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। আর মানুষ পথ চলতে আতংকিত হয়। ভয়ে শিউরে ওঠে। সবিস্তারে আলোচনা করলে আরো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে বোধ করি।
আমাদের বুঝতে হবে একজন কিশোর কখন গ্যাং এর অন্তর্ভুক্ত হয়? সমঅপরাধ প্রবণ মানসিকতা একদল কিশোরকে একত্রিত করে পরবর্তী অপরাধ পরিক্রমায়। একটি অপরাধের বিচার না হলে আরেকটি অপরাধ করতেও পিছপা হয় না। এই অপরাধপ্রবণ কিশোরদের বাস্তবতার নিরিখে ‘কিশোর গ্যাং’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। প্রথম দিকে কিশোর গ্যাং কালচার রাজধানী ও বড় বড় বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে সারা দেশে ভয়াবহভাবে বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার। শহর, নগর ও গ্রাম সর্বত্রই সমান তালে গ্যাং কালচারের আধিপত্য। প্রতিটি জনপদেই তারা সাধারণ মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়ে এক মহা আতংকের জাল বুনে দিচ্ছে। যা ক্রমশঃ দানবীয় আকৃতি ধারণ করতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা। যা মোটেই অমূলক নয়।
আর এই কিশোর গ্যাং সদস্যদের অধিকাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। ক্ষেত্রবিশেষে ১৯ বছর বা তার বেশি হলেও কিশোরদের সাথে চলাফেরা করেও এই গ্যাং এর সদস্য হতে দেখা যায়। জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০-১১-১৯৮৯ কনভেনশন অব দ্য রাইট অব দ্য চাইল্ড সম্মেলনে শিশুর বয়স ১৮ নির্ধারণ করা হয়। সে আলোকে শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী একটি শিশুর বয়স ১৮ বছর নির্ধারিত হয়েছে। শিশু আইন-১৯৭৪ এ শিশুর বয়স নির্ধারিত ছিল ১৬ বছর। বাংলাদেশের পেনাল কোডের-৮২ ধারা মোতাবেক ৯ বছরের নিচে কোনো শিশুর আইনবহির্ভূত ব্যবহারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। ঐ আইনে ৮৩ ধারা মোতাবেক বিচারকের দৃষ্টিতে ৯ বছরের নিচে ১২ বছরের বেশি না হলে কোনো শিশুর যদি ম্যাচিউরিটি সনাক্ত না হয় সে ক্ষেত্রেও শিশুটি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না। ডিজিটাল যুগে ১৬-১৮ বছরের একজন কিশোর যথেষ্ট ম্যাচিউরিটি লাভ করে। অথচ এরা যত বড় অপরাধই করুক না কেন তাদের শিশু আইনে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। ওই আইনে হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর। ফলে তারা নানা অপরাধমূলক কাজ করেও আইনের সুবিধা ভোগ করার সুযোগ তাদের অনেককেই আরো বেশিমাত্রায় উৎসাহী করে তুলছে বলেও বিশ্লেষকদের ধারণা।
কিশোর গ্যাং রাতারাতি তৈরি হয় না। সমাজের নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে এরা সংগঠিত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এদের দৌরাত্ম্য এত প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, অনেকটা মহামারি বা অতিমারি পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর জন্য দায়ী কারা তা একবাক্যে বলা না গেলেও সামষ্টিকভাবে এই সমাজ বাস্তবতা কিংবা আমরা কেউই দায় অস্বীকার করার সুযোগ কি আছে? যদি থেকে থাকে তবে আমরা এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খুব সচেতন নই অথবা দেখেও না দেখার ভান কিরে চলেছি! যখন নিজে আক্রান্ত হতে থাকবো তখনই এর রেশ এবং জের সম্পর্কে ভাবতে শুরু করবো। তার আগে নয়! সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সচেতন অভিভাবক সবাই দায়সারা গোছের বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে সেমিনারেই সীমাবদ্ধ করছি নিজেদের কার্যক্রম। নিশ্চয়ই আমাদের জানতে হবে এর ভয়াবহতা এবং বিস্তার। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই আমরা একটি বিকারগ্রস্ত যুবসমাজ পেতে যাচ্ছি। আর তার পরিণতি ভোগাতে পারে যুগযুগ। কারণ বিশৃঙ্খল যুবসমাজ নিয়ে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন কোনভাবেই সম্ভবপর হতে পারে না।
কিশোর গ্যাংয়ের বেড়ে ওঠা নিয়ে অনেক গবেষণায় উঠে এসেছে নানাবিধ কারণ। তার মধ্যে কথিত বড়ভাই সুলভ আচরণ। যা অপেক্ষাকৃত ছোট যারা তারা তাদের নেতৃত্ব কিংবা আধিপত্য মানতে নারাজ। স্বাভাবিকত প্রত্যাশিত সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধ বা সমীহ আদায় করতে উঠেপড়ে লাগার কারণেও এই গ্যাং কালচার গড়ে ওঠে বলেও ধারণা করা যায়। আবার এই বড়ভাইদের আশ্রিত হয়ে সেই কথিত ছোটভাইরা নানা অপকর্ম করলে পরে শেল্টার দিয়ে থাকে। এতে করে আরো প্রশ্রয় পেয়ে আরো বেশিমাত্রায় বেপরোয়া আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আবার এক গ্রুপের সাথে অন্য গ্রুপের দ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে থাকে। তাদেরই আবার নামে বেনামে সক্রিয় গ্রুপ চালু রয়েছে। যা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও মিডিয়ার বরাতে আমাদেরও জানা হয়ে যায়। তবে সামাজিক অসঙ্গতিকেও কেউ কেউ দুষছেন। যার কারণ এই কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়ে তারাই আবার গ্যাং তৈরি করে। তবে বিদেশী সংস্কৃতিও কম দায়ী নয়। সেখানে কিছু সিনেমাটিক অ্যাকশন দৃশ্য তাদের অবাধ্য, অশ্লীলতা, অস্ত্রবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, ইভটিজিং, শঠ, প্রতারণা, মাদকের ব্যবহার, নারীর স্বল্পবসনা দেহের উন্মুক্ত ছবি, খুনখারাবি এবং রগরগে দৃশ্য দেখিয়ে উন্মত্ত করে তোলে। স্যাটেলাইট মিডিয়ার যুগে শিশু কিশোররা এইসব মারদাঙ্গা সিনেমা দেখে নিজেকে সেইরূপে কল্পনা করে থাকে। এমনও দেখা গেছে আপন ভাইকে মেরে নিজের অবস্থান জানান দিতেও। যা ব্যাপকভাবে নেতিবাচকতা ছড়িয়ে দিয়েছে অন্যান্যদের এই অপরাধ প্রবণতার দিকে ঝুঁকতে।
আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে উঠতি বয়েসী ছেলেরা অনেকটা স্বাধীনচেতা হয়ে থাকে। তারা পরিবার তথা অপরের অনুশাসন মানতেও নারাজ। আর তাই পরিবারের সামান্য কঠোরতাও তারা হজম না করে বহিঃজগতে পা বাড়ায়। আর এতে তার আশ্রয়দাতা হয় আরেক গ্যাংয়ের দলনেতা। এক্ষেত্রে তার সেই অর্থে কোন বিবেকবোধ কাজ করে না। বয়সের কারণে এমনিতেই তারা আবেগ নির্ভর হয়ে থাকে। যদিও একটা পর্যায়ে তারা নির্দয় নিষ্ঠুর ও উশৃংখল হয়ে ওঠে।
যত যা-ই কারণ উল্লেখ করি না কেন, কোন কিছুই কি এই কিশোর গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে? এখনই এদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অচিরেই দানব আকার ধারণ করতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
তবে পরিবার, সমাজ, শিক্ষালয় সকল জায়গায় যেসব শিশু-কিশোররা বুলিং এর শিকার হয়। তারাও পরবর্তী পর্যায়ে অপরাধে ঝুঁকে পড়ে এইসব গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়তে পারে। এই বুলিং কখনো ছোট কখনো বড়দের কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষকের কিংবা ক্লাসে পড়া না পারার ফলেও হয়ে থাকে। আর এতে কিশোররা হীনমন্যতায় ভোগে। ফলতঃ তারা একসময় মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে অসহায় হয়ে এই গ্যাংয়ে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় অপরাধ সংগঠনের মাধ্যমে।
আবার পিতা-মাতার অতি আহ্লাদী মনোভাবও কম দায়ী নয়। তারা সবসময় চাহিদার বেশি পরিমাণ জিনিসপত্র সরবরাহ করে। যদিও এতে তারা মনে করতে পারে সন্তান খুশি হয়ে ভালো কিছু করবে। আদতে তা আর হয়ে ওঠে না। মা-বাবা চায় সন্তান সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে শুধুমাত্র তাদের দেখানো ও শেখানো পথ অনুসরণ করে। এতে তারা সন্তানের ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রাধাণ্য খুব কমই দিয়ে থাকেন। কারণ তারা চায় গৎবাঁধা কিছু। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থতা সন্তানকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয় অনেকাংশে। এতে সন্তান নিজের ভেতর শূন্যতা অনুভব করে আর অপরাধ জগতে পা বাড়াতে থাকে। এক সময় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এ সময় তারা কার সাথে মিশছে সেদিকে খেয়াল না রেখে আরো কঠোরতা প্রদর্শন ক্রমেই মনোজগতে তাকে নিঃস্ব করে দেয়। আবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক সময় দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে বের হতে পারে না। কিন্তু দায়সারা সচেতন কার্যক্রমেই সীমিত রাখে তাদের কার্যক্রম। অন্যদিকে অপরাধের গুরুত্ব থেকেও বেশি বলপ্রয়োগ অনেক সময় আরো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কখনো কখনো সামাজিক বৈষম্য কিংবা অর্থনৈতিক বৈষম্যও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ। একই বয়েসী একজন ভালো পরিধেয় বস্ত্র ভালো খাবার খাচ্ছে যা তার কাছে ব্যাপক ঈর্ষার কারণ হতে পারে। আর এই অভাব থেকে বের হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় শিশু কিশোররা রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় নিজেকে আবিষ্কার করে। তাদের কাজ মিছিল, মিটিং, শোডাউন ভাংচুর করে আয়ের উৎস তৈরি করে।
কিশোরদের গ্যাং হিসেবে উপস্থাপনে যতটা না তারা দায়ী তার চেয়ে মনে হয় সমাজ তথা পারিপার্শ্বিক অবস্থাও কম দায়ী নয়। একজন শিশু তার শৈশবের সত্তা পরিত্যাগ করতে শুরু করে তখন তার ভেতর একধরনের উন্মাদনা কাজ করে। সে নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করে। অথচ তারই কিছুটা বয়সে বড় আরেক কিশোরই তাকে যখন অবদমন করতে চায় তখনই তার সে সত্তা জানান দেয় মনের ভেতরকার অনুভূতি এবং না মানা একটা ব্যাপার কাজ করে। শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে পড়ে তারা তৈরি করে নিজস্ব বলয়। আর এই বলয় যখন বেপরোয়া কিংবা অতি বেপরোয়া আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তখনই তাদের কিশোর গ্যাং নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
তারা বেড়ে ওঠে কোন না কোন তথাকথিত বড় ভাইয়ের অধীনে। আর শুরু করে অসামাজিক কার্যকলাপ। চুরি ছিনতাই রাহাজানি খুন খারাবির মতো সামাল না দিতে পারা ঘটনাও। আর আশ্রয় খুঁজে অপরাধ জগতের মাফিয়ার নিকট। মাফিয়াদের ছত্রছায়ায় তারা হয় নিঃশেষ হয়ে যায়। আর নয়তো নেতা বনে যায়। শুরু হয় আধিপত্যের লড়াই। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চাঁদাবাজি লুটতরাজ টেন্ডারবাজি তো করেই। এসব করেই খুঁজে ফেরে আয়ের উৎস। পরিবারের উচ্ছন্নে যাওয়া সেই শৈশব পেরোনো কোমলমতি সারল্য ভরা নিষ্পাপ অবয়বের চেহারার কিশোর ছেলেটি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। গ্রহণ করে ইয়াবা কিংবা বাবা, এলএসডি, পেন্টাগন, গাঁজা, আফিম কিংবা আরও ভয়াবহ রকমের কিছু। তখন তারা আর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অপরাধ জগতে জড়িয়ে তখন তারা মর্যাদা খুঁজে ফেরে। জড়িয়ে পড়ে অপহরণ কিংবা চোরাকারবারির মতো রোমহষর্ক কোন ঘটনায়।
গত কিছুদিন আগে ফেনীর একটা স্কুলের সমবয়েসী বন্ধুদের মধ্যে মামুলী বিষয় নিয়ে বিরোধ হলে এই কিশোররাই অপর বন্ধুকে বেধড়ক পিটিয়ে জখম করে। যা সেই নির্যাতনের শিকার কিশোর ছেলেটি পরিবারের কাছে চেপে যায়। কাউকে ঘটনার বিষয়ে কিছুই প্রকাশ না করলেও অপর কোন সহপাঠী ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে নেটদুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে তোলপাড় শুরু হয়। আতংকিত হয়ে পড়ে অভিভাবকমহল। ভুক্তভোগী পরিবার অপরাধে জড়িত সেইসব কিশোরদের ছবি দেখে সনাক্ত করে নাম-ধাম উল্লেখে থানায় এজাহার আনায়ন করলে পুলিশ ও মিডিয়া তৎপর হয়। অভিযুক্ত আসামীদের গ্রেপ্তার করে আইন আমলে আনা হয়। তারপরও কি থেমে ছিল এই অপরাধপ্রবণ কিশোদের তৎপরতা? আইন দিয়ে যত কঠোর ভূমিকাই গ্রহণ করা হোক না কেন, থেমে থাকেনি এদের উপদ্রব। আর এই উপদ্রব এতোই মাত্রা ছাড়ানো যে, থেমে থেমে উঠে আসে আলোচনায়। মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে সমালোচনা শুরু হলে পুনরায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তৎপর হয়।
একজন কিশোর যখন অপরাধ করে তখন তাকে কিশোর সংশোধনাগারে রাখা হয়। আইনি নির্দেশনা অনুসরণ করে বিজ্ঞ আদালত সেই অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন প্রদান করেন। বয়স বিবেচনায় জামিন পেলেও অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় তাদের বিষয়ে উদার মনোভাবের প্রদর্শন ঘটাতে দেখা যায়। কথা হচ্ছে যদি হত্যা কিংবা অপহরণ কিংবা গুম কিংবা আরো চাঞ্চল্যকর কোন ঘটনা ঘটিয়ে যাতে অবলীলায় পার না পেয়ে যায় সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। একজন কিশোর ভুল করে কোন অপরাধ করে ফেললে তাকে সংশোধনের নিমিত্ত সুযোগ দেয়া হলেও অপরাধ পরিক্রমার জন্য নিশ্চয়ই তেমন সুযোগ পাওয়ার অধিকারী হবে না।
তবে একজন শিশু কিংবা কিশোর বয়স ভেদে অপরাধে জড়ানোর পূর্বেই পরিবার তথা সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্য করলে এই বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার পর খুব কমই অপরাধ চক্রে জড়িত হওয়ার সুযোগ পায়। আবার কিশোর অপরাধে অভিযুক্ত করার আগেই সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করেও সে পথ থেকে নিবৃত্ত করা যেতে পারে। একজন কিশোরকে কিশোর অপরাধে সম্পৃক্ত হতে না দিলে তারা গ্যাং গঠন করতে পারবে না। আর গ্যাং না হলে কিশোর গ্যাং নিয়েও সমাজ এতটা ভীত হবে না।
এই কিশোরদের অপরাধী হয়ে ওঠার পিছিনেও রয়েছে পরিবার সমাজ তথা রাষ্ট্রের অবহেলা। যা সকলেই অস্বীকার করে যান অবলীলায়। কেউই এদের কৃতকর্মের দায় নিতে চান না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি এই কিশোররাই তাদের দলের একেকজনের জন্মদিন পালন করে ঘটা করে। আর তা উদযাপনের রীতিও পুরোপুরি ভিন্ন। যার বর্ণনা শুনলে বা দেখলে গা শিউরে উঠবে যে কারো। যেমন- যার জন্মদিন তাকে হাত পিছমোড়া বেঁধে কিছুটা দূর থেকে অনবরত ডিম নিক্ষেপ করা হয়ে থাকে। এতে সেই ডিম সজোরে ভুক্তভোগীর গায়ে লেগে ফেটে সারা শরীর আঠালো হয়ে যায়। আর তখন চোখে মুখে মাথায় কেউ কালি কেউ আটা বা ময়দা মুখ বরাবর জোরে ছুঁড়ে মারে। এটা চলে অনবরত। এতে সেই কিশোর যতো যা আকুতি মিনতি করুক খুব একটা কাজে আসে না। নাছোড়বান্দা কিশোররের দল তাকে না ছেড়ে দিয়ে আরো উদযাপন করতে থাকে। একপর্যায়ে সবাই যখন ক্লান্ত হয় সেই কিশোর ছেলেটিকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেয়া হয়। তারপর অনবরত ডুব এবং চুবানো। কখনো কখনো এতটুকুতেই হয়তো ক্ষান্ত দেয়। কখনো আরও বেশিকিছু। তার ওপর আছে শাস্তির খড়্গ! আবার আর্থিক ক্ষতি হয় এই খরচ কিংবা জন্মদিনের পরবর্তী সেলিব্রেশন হচ্ছে পেটপুরে খাওয়ার আয়োজন। সেই টাকাও নিশ্চয়ই যার জন্মদিন তাকেই বহন করতে হয়।
জানা হয়নি এই যে খরচ তারা কোথায় পায়? কিভাবে সংগ্রহ করে? এভাবে একেকদিন একেকজনের জন্মদিনের এই উদযাপনের ভীতিকর মহড়া চলে। এদের চুল কাটানোর ধরণ যেমন একই। তেমনই পোশাক পরিচ্ছদও একই। দেখা যায় এদের হাঁটাচলা কথাবলা বাচনভঙ্গি সব একই ধরণের। কিন্তু এরা বেপরোয়া! এসব কি থামানো যাবে?
আবার এরা যখন চলাফেরা করে আমার কাছে মনে হয়েছে পোনামাছের মতো করে চলে। একজন যেদিক যায় অন্যরাও একই দিকে ধায়। ঠিক কি কারণে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কিছুই জানে না। ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের বিচরণ! কোথাও অপরাধ করবে মনস্থির করলে সাথে কেউ না জানলেও ক্ষতি নেই! একজন যা করে অন্যরা না জেনে না বুঝে ঠিকই সেই কাজ করে যায়। তাদের মারপিটের ধরণ দেখলে মনে হবে একদল নেশাগ্রস্ত অথবা বিকারগ্রস্ত ছেলেপুলেদের এমন কাণ্ডকীর্তি। যা কোন সভ্য সমাজের লোক দেখে ভয়ে কুঁকড়ে উঠবে নিশ্চিত করেই বলে দেয়া যেতে পারে। তাহলে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত গত কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় সারা দেশে অন্যূন ২৩৭টির মতো ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে, ১২৭টি। এসব গ্যাংয়ের (অপরাধী দল) সদস্য ১ হাজার ৩৮২ জন। ঢাকার পর চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি। এসব দলের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন। যা শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পাঠে জানা হয়েছে।
এসব কিশোররা চটকদার নামে কিশোর গ্যাং পরিচালনা করে থাকে বলেও জানা যায়। একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, একই পাড়া-মহল্লার বাসিন্দা অথবা বখে যাওয়া কিশোর-তরুণেরা এক জোট হয়ে বাহারি ও চটকদার নামে এসব কিশোর গ্যাং তৈরি করে ও পরিচালনা করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওই নামে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ‘আইডি’ খোলা হয়। যেমন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিল্ম ঝিরঝির, স্টার বন্ড, গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপাইয়া দে ইত্যাদি। এখন আরেকটি কালচার শুরু হয়েছে টিকটক সেলিব্রিটি। তার ওইসব কিশোর গ্যাং সদস্যদের স্বপ্ন পুরুষ হয়ে থাকে। এই সকল টিকটকাররা যেখানে জড়ো হয় এই বয়সী কিশোররা সেখানে মুহূর্তেই ভীড় জমিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিতেও সময় লাগে না।
বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, উত্তরা এলাকার গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, বিল বস, নাইন এম এম বয়েজ, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, আলতাফ জিরো, ভাইপার, তুফান এবং ত্রি গোল। মিরপুর এলাকায় আছে সুমন গ্যাং, পিচ্চি বাবু, বিহারী রাসেল, বিচ্চু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং এবং মোবারক গ্যাং। এই জাতীয় ভয়ংকর নাম ধারণের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রথম ধাপ প্রকাশ ও প্রচার করে থাকে। তারা প্রতিনিয়ত খবর ও খবরের শিরোনামে উঠে আসে।
ধানমন্ডিতে একে ৪৭, নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার বন্ড নামের কিশোর গ্যাং রয়েছে। বংশালে রয়েছে জুম্মন গ্যাং, তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্যাং, মুগদায় চান জাদু, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় অদ্ভুত সব নামে গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবেও কাজ করছে বলে পুলিশ সূত্রগুলো বলছে।
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সরকারি সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সন্তানদের ব্যস্ত না রেখে পড়ালেখার বাইরেও খেলাধুলা, নাটক, ভ্রমণ, লেখালেখি, বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, পাঠক্রম আয়োজন, পাঠাগার প্রথা ফিরিয়ে এনে এবং স্কাউটিংয়ের মতো সুস্থ বিনোদনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে তাদের আরও বেশি বেশি করে সম্পৃক্ত করা। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) প্রবেশ নিশ্চিত করা এবং কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে—এমন অ্যাপগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করে দেওয়া। এসবগুলো বিবেচনায় নিলে কিছুটা হলেও রোধ করা যেতে পারে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ পরিক্রমা।
পাড়া-মহল্লাভিত্তিক তালিকা তৈরি করে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রাখা এবং কিশোর গ্যাংয়ের ‘হটস্পট’ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া। তাদের কোনভাবেই যাতে সংগঠিত হতে না পারে সেদিকটায় খেয়াল রাখা। জুমার নামাজে খুতবায় কিশোর গ্যাংয়ের কুফল এবং ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে নিয়মিত বয়ানের পদক্ষেপ নেওয়া এবং স্কুল কলেজে কিংবা টেলিভিশন মিডিয়ায় এর ভয়াবহতা ও কুফল সম্পর্কে প্রচার করা যেতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে কাউন্সেলিং করেও তাদের ভালো পথে ফিরিয়ে আনা সহজ হবে।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, কিশোর সংশোধনাগারের পরিবেশ শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সহায়ক হওয়া। সংশোধনাগারে যেন মানসিক নির্যাতন ও টর্চার সেলে পরিণত না হয়, সে দিকে লক্ষ রাখা। আরও বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মোটরসাইকেল রেস (গতির লড়াই) করে, এ বিষয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টরা ব্যবস্থা নিতে পারেন। এসব করতে উঠতি বয়েসী ছেলেদের নিরুৎসাহিত করা। কিশোর গ্যাং সৃষ্টির কারণ ও উত্তরণের উপায় নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে গবেষণা করা প্রয়োজন। তারপর উক্ত গবেষণা কাজে লাগিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখাও সহজসাধ্য হবে।
পরিশেষে বলতে হয় তারা আমাদেরই সন্তান। এই দেশের সম্পদ। সঠিক যত্নের ফলে তারা দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নেই তাহলে একটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। দেশ মহা সংকটে পতিত হতে পারে। সেই আবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে আলোর পথে ফেরানো আমাদের নৈতিক দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে। যার সুফল দেশের মানুষই ভোগ করবে। তেমনটাই প্রত্যাশা করি।
লেখক: অ্যাডভোকেট ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি