Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেশপ্রেম ও মেধা পাচার

মনোয়ার পারভেজ
৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৪৪

আপনারা তো প্রায়ই অনেক সময় মানব পাচারের কথা শুনেছেন পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনে খবরের চ্যানেলে কিংবা শুনেছেন লোকমুখে। শুনেছেন লোমহর্ষক ভয়ানক ভয়ানক নানা গল্প মানব পাচারের। এবং রাশি রাশি ঘৃণা ও নিন্দা প্রকাশ করেছেন মানব পাচারের ঘটনা ও পাচারকারীদর বিরুদ্ধে। মানব পাচার নিয়ে নানা গল্প, নাটক ও সিনেমায়ও আছে দেশে। তারপর মানব পাচার রোধ করতে যদিও সরকার কাজ করে যাচ্ছিল এবং যাচ্ছে। এই নিয়ে যদিও আরও অনেক আলোচনা-সমালোচনা আছে তবে এই লেখায় আপাতত এখন আর ঐদিকে যাচ্ছি না। মানব পাচার, তারপর আলোচনায় আসলো অর্থ পাচারের ঘটনা। এই নিয়েও অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে দেশে। তবে তার আড়ালে আরেকটি পাচারের তথ্য হচ্ছে বিদেশে শুধু আমাদের মানব পাচার এবং টাকা পাচার হচ্ছে না, আড়ালে মেধাও পাচার হচ্ছে! তথ্যটা কিছুটা অবাক করার বিষয় হলেও আসলে এটাই সত্যি। এই মেধা পাচারের ঘটনাকে আপনি মানব পাচারের ডিজিটাল রূপ হিশাবেও ধরতে পারেন অথবা আমার কাছে এটা তারচেয়েও আরো বেশি কিছু বা ভয়ংকর মনে হয়। এমনকি বলতে পারেন মানব পাচার ও টাকা পাচারের দুটির সমন্বয়’ই হচ্ছে এক মেধা পাচার।

বিজ্ঞাপন

মানব পাচার আর অর্থ পাচারে নিমিত্তে দেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, গভীরভাবে চিন্তা করলে মেধা পাচার তারচেয়েও বেশি ক্ষতিকর। সুতরাং মেধা পাচারের ঘটনা ঐ দুটি পাচারের থেকে আরও ভয়ংকর রূপও হতে পারে, যদি গভীর থেকে বিবেচনা করেন। পার্থক্য শুধু মানব পাচার আর অর্থ পাচার হয় অবৈধ ভাবে আর মেধা পাচার হচ্ছে একটা বৈধ পন্থায়, আবার আড়ালে। এই যেমন আমরা দেখছি এক কিন্তু হচ্ছে ভিন্ন। যদিও আমরা তার কিছুই টের পাইনা অথবা টের পেলেও নীরবে সহ্য করে আসছি মুখ বন্ধ করে। তবে মেধা পাচারের ঘটনায় যেহেতু আমার এই লেখা, এটা যারা মানতে চান না বা পারছেন না তাদের কাছে আমি আপাতত আপনাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, আমাকে দয়াকরে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন আর সহ্য করে বাকিটা পড়বেন আশাকরি। অতঃপর আমার কথা হচ্ছে ওইদিকে কি আমাদের দৃষ্টি আছে? হয়তো নেই অথবা দৃষ্টি রেখেও করার মতো কিছুই থাকছে না বা আদৌ নেই!

বিজ্ঞাপন

বর্তমান পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন হচ্ছে পড়াশোনা বা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে চলে যাওয়া। তার অর্থ কি দাড়ায় দেশের উচ্চ শিক্ষায় তারা অসন্তুষ্ট? আবার এখানকার অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই পড়াশোনার জন্য বিদেশে যাওয়া মূলত একটা উপলক্ষ্য মাত্র, মূল লক্ষ্য বা ঘটনা হচ্ছে দেশ ত্যাগ করে সেখানে স্থায়ী হওয়ার চিন্তাভাবনা করা। ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা, পর্তুগাল, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা ইত্যাদি দেশ গুলোতে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য পাড়ি দিয়েছেন। কোনোরকমে ইন্টারমিডিয়েট (এইচএসসি) শেষ হলেই একটা মাধ্যম অনুসারে শুরু হয় এই যাত্রা। আর শিক্ষার্থীদের এই বিদেশে চলে যাওয়ার হিড়িক দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আমাদের সিলেট অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি। তার সুবাদে আমাদের এখানে IELTS-এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একটা রমরমা বাণিজ্য চলছে। যদিও সরাসরি বাণিজ্য বলা আমার উচিত নয়, তবুও অগত্যা বলতেই হয়। তবে বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করতে যাওয়া এখানে মূলত কোনো সমস্যা নেই; এটা তো এক প্রকার আমাদের জন্য গৌরবের বিষয় বলা চলে। যা নিয়ে দেশের অনেকে গৌরব ও অহংকার করে থাকেন। কিন্তু বিপত্তিটা আসে মূলত বিদেশে পড়াশোনার জন্য যাওয়া তাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই পড়াশোনা শেষে আর দেশে ফিরে আসতে চায়না, এবং তারা সেখানেই স্থায়ী হয়ে যেতে চায়, চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে, যা আমি আগেই বলেছি। আর তাদের এই ইন্টারমিডিয়েট শেষেই বিদেশে চলে যাওয়া ও না ফিরতে চাওয়ার জন্য অধিকাংশেই দায়ী দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও আমাদের দেশের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থান। এতে মূলত আমাদের দেশের লাভের চেয়ে ক্ষতিটাই বেশি হচ্ছে। এখন বলতে পারেন কিভাবে ক্ষতি হচ্ছে? এই ক্ষতির পরিসংখ্যান হয়তো আপনাদের হাতে-কলমে দেখাতে পারব না। কেননা কিছু কিছু ক্ষতি আছে যা পরিসংখ্যানে দেখানো যায় না। ক্ষতিটা হচ্ছে মূলত সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিবৃত্তিক অর্থাৎ মেধাবৃত্তিক। বলতে পারেন আমরা হয়তো তাদের নিকট হতে রেমিট্যান্স পাচ্ছি, আবার কারো কারো কাছ থেকে সেটাও পাচ্ছি না। তবে আমরা দেশে যে মেধাকে কাজে লাগানোর কথা ছিল আমাদের সেই মেধা গুলো কাজে লাগাচ্ছে ঐসব দেশগুলো। এইযে তারা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে তাদের দেশে শিক্ষার ব্যবস্থা বা পড়াশোনার সুযোগ করে দিচ্ছে এটা কি তারা এমনি এমনিই করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন? না, অবশ্যই না। এখানে তাদের অবশ্যই অনেক ফায়দা/সুবিধার গল্প লুকিয়ে আছে। কেননা এই শিক্ষার্থীরা খুব সহজে পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মিশে যাচ্ছে। শিক্ষার পাশাপাশি তাদের দ্বারা সংস্কৃতি চর্চা করারও একটা বাড়তি সুবিধা আছে। এতে তাদের নিজেদের সংস্কৃতির একটা প্রচার ও প্রসার হচ্ছে। কেননা প্রত্যেক দেশ/জাতি তাদের নিজেদের সংস্কৃতির চর্চা ও প্রচার, প্রসার চায়। তারা এই কাজটা শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে করিয়ে বেশি সফল বোধ করছে, এবং তারা সফলও হচ্ছে। এইজন্য বর্তমানে দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকদের বদলে ছাত্র ভিসায় (student visa) শিক্ষার্থীদেরকে যাওয়ার জন্য বেশি সুযোগ দিচ্ছে। এটা মূলত তাদের লাভের উপর লাভ। সহজ ভাষায় বলতে গেলে একের ভিতর অনেক। তারা এক সাথে কয়েকটি ফায়দা বা সুবিধা নিচ্ছে। প্রথমত সবাই তো ফ্রি বৃত্তি (scolership) পেয়ে সেখানে পড়তে যাচ্ছেন না। যদিও আমি বলব এই ফ্রি বৃত্তি একটা লোভ দেখানো মাত্র। তারপরও ঐসব দেশ গুলো এসব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লক্ষ্য লক্ষ্য টাকা উপার্জন করছে। তাদের দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে মিশিয়ে নিচ্ছে এমন আরও অনেক ফায়দা/সুবিদা নিচ্ছে তারা। তারা ফায়দা নিবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের ক্ষতিটা হচ্ছে কোথায়? সেটাই মূলত দেখার বিষয়। প্রথমত উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের এই চলে যাওয়ার হিড়িক ইঙ্গিত দেয় দেশের উচ্চশিক্ষায় তারা হয়তো আস্তা, ভরসা এবং বিশ্বাস রাখতে পারছে না। এবং এই যুক্তিকে কোনোভাবেই একেবারে ফেলে দেওয়াও যাবে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গভীরে গেলে অবশ্যই তার উত্তর পাওয়া যায় (এগুলো নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে সময় করে অন্য কোনো অধ্যায়ে)। তখন হয়তো অনেকের কাছে মনে হয়, তাদের এই চলে যাওয়াটাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ। এবং এই বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে নিজের স্বার্থের জন্য, এটা কখনো দেশের স্বার্থে নয়। নিজস্ব স্বার্থের জন্য তারা তখন শিক্ষায় দেশপ্রেমের কথা ভুলে যায় এবং ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দেশ যখন তাদের ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না, তখন তারা স্বার্থবাদী হবে এটাই তো স্বাভাবিক। যদিও কেউ কেউ দেশপ্রেমের অতিমাত্রার জন্য আর স্বার্থবাদী হতে পারেন না, আবার তাদেরকে তখন অনেকেই বোকা বলেও তকমা দিয়ে থাকেন। তবে কারা সত্যিকারে দেশপ্রেমিক আর কারা স্বার্থবাদী এই প্রসঙ্গও এখানেই গুছানো যাক। এটা চাইলে পরবর্তী কোনো অধ্যায়েও আলোচনা করা যাবে। বরং আসা যাক মেধা পাচারের আরেক গবেষণায়। গবেষণা গবেষণার কাছে নিয়ে যায়। গবেষণার আরেক অর্থ হচ্ছে গরু খোঁজা। এইযে গরু খোঁজার কাজ ঐসব দেশগুলোতে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের দ্বারা করানো হচ্ছে এটাও তাদের একটি সুবিধা বা লাভের অংশ। অথচ এই গবেষকদের গরু খোঁজার কথা ছিল বাংলাদেশে। কিন্তু আমরা তাদেরকে দেশে ধরে রাখতে পারিনি, আমি এটাকে আমাদের ব্যার্থতাই বলব। তার দায় অবশ্যই আমাদের রাষ্ট্রের এবং দেশের হর্তাকর্তাদের উপর পড়ে। কেনই বা পড়বে না? বিদেশে আমাদের শিক্ষার্থীরা গবেষণা করছে এবং নানা নতুন নতুন আবিষ্কারও করছে বটে। এমনকি ঐসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আমাদের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা শেষে অধ্যাপক হিশেবেও নিয়োজিত আছেন। অথচ তাদের নিজ দেশে ও নিজ দেশের জন্য নেই কোনো গবেষণা কোনো আবিস্কার, তাছাড়াও আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো যথেষ্ট অধ্যাপক ও শিক্ষকদের অভাবে ভূগছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবস্থাও একই। এগুলোতে আমরা কি পিছিয়ে নেই? উত্তর হচ্ছে, আমাদের থেকেও তারা কাছে নেই। অথচ এখান থেকেও ঐসব দেশগুলো আর্থিক ও বিভিন্ন দিক থেকে লাভবান এবং সফল হচ্ছে। আমাদের মেধাগুলো তারা কাজে লাগাচ্ছে, তাদের উপযোগ কাজের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। এইযে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মেধাগুলো তারা কাজে লাগাচ্ছে এটা কি এক প্রকার মেধা পাচার নয়? অবশ্যই এটা মেধা পাচার। এই মেধা পাচারের ঘটনায় আমরা ভালো ভালো মেধাবী হারাচ্ছি, গবেষক হারাচ্ছি, বিজ্ঞানি হারাচ্ছি, অধ্যাপক ও শিক্ষক হারাচ্ছি। অথচ চাইলে তাদেরকে দিয়ে আমাদের দেশে কাজ করানো যেতে, তাদের সাথে নিয়ে দেশকে আরও এগিয়ে নেওয়া হতো। বিপরীতে আমাদের মেধা দিয়ে এসব দেশগুলো এগিয়ে যাওয়ার গল্প শুনাচ্ছে। হ্যাঁ আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশ থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যখন ঐসব দেশগুলো যেভাবে মেধাবী বা মেধা তৈরি করছে তখন আমরা কেন দেশে তাদের তৈরি এভাবে করতে পারছিনা? তার দায় কি কিছুটা হলেও আমাদের নয়? অবশ্যই আমাদের, শুধু যারা চলে যায় তাদের নয়। কেউ কেউ নাহয় অর্থের লোভে পড়ে চলে যায়, অনেকে তো দেশে অবহেলিত হয়ে ও অনিশ্চয়তার নিয়ে চলে যাচ্ছে। তার উদাহরণও কিন্তু আমাদের এখানে অহরহ আছে। আসলে আমরা রত্ন চিনতে ভুল করি এবং মেধার কদর দিতে ভুলে যাই, ধরে রাখতে ব্যার্থ হই। ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, “যে দেশে গুনীর কদর নেই সে দেশে গুনী জন্মাতে পারেনা।” এখানেও তার কথার ভিত্তিতে বলতে হয়, যে দেশে মেধা বা মেধাবীর কদর নেই সে দেশে মেধাবী জন্মায় না অথবা জন্মালেও সেটা থাকবে না। এইযে মেধা পাচারের কারণে দেশের একটা ক্ষতি হচ্ছে এটা শিক্ষার্থীরা বুঝবে না। কেননা শিক্ষার্থীরা দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করবেনা, তারা স্বাভাবিক ভাবেই নিজের চিন্তা করবে।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশপ্রেমের কথা শুধু ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষার মতোই, বাস্তবে তার ফলাফল অনেকের কাছেই নেই। কেননা এই দেশপ্রেমের শিক্ষা শিক্ষার্থীদের শুধু পরিক্ষার খাতায় পাস করানোর জন্যেই শেখানো হয় বলে দেশপ্রেম নিয়ে আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের এমন অবস্থা আজকাল। সুতরাং তাদের কাছ থেকে নিরেট দেশপ্রেম আশা করাই বোকামি। কিন্তু যারা দেশের হর্তাকর্তা তাদের অবশ্যই সজাগ হতে হবে, তাদের নিয়ে ভাবতে হবে অন্তত দেশের স্বার্থে। শিক্ষার্থীদের দেশমুখী করার চিন্তাভাবনায় কাজ করতে হবে, তারা পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরোক। এবং আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষার মানও বাড়াতে হবে। কেননা অবকাঠামো গত উন্নয়নের চেয়ে বড় বেশি প্রয়োজন শিক্ষার উন্নয়নের, তাহলে না মেধাবৃত্তিক উন্নয়ন হবে। আদৌ কি কেউ সজাগ হবে? হলেতো রাষ্ট্রের উন্নতি, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মেধাবৃত্তিক ফলাফল আসবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

মনোয়ার পারভেজ মুক্তমত মেধা পাচার

বিজ্ঞাপন

ছবির গল্প / টমেটো বাণিজ্য
৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:১৫

আরো

সম্পর্কিত খবর