Wednesday 22 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দূষণের ভয়াবহতা প্রতিরোধে আমরা কতটা প্রস্তুত

অমিত বণিক
২২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:৪৫

যখন আমরা নিঃশ্বাস গ্রহণ করি এবং ছাড়ি, তখন প্রায় ২৫ সেক্সট্রিলিয়ন কণা আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। এই কণাগুলোর কোনো কোনোটি হয়তো আগের দিনই সৃষ্টি হয়েছে, আবার কিছু কণা বিলিয়ন বছর আগের হতে পারে। এসব কণার বেশিরভাগই কয়েক লাখ বছর ধরে সভ্যতার বিকাশ এবং মানুষের জীবনযাপনের সময় নিঃসৃত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, আমরা আসলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে কী গ্রহণ করছি? এই কণাগুলোয় আসলে কী রয়েছে? আমরা জানি, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৭৮ শতাংশ হলো নাইট্রোজেন গ্যাস। এই নাইট্রোজেনের বেশিরভাগই সৃষ্টি হয়েছে ভূগর্ভস্থ অগ্ন্যুৎপাত বা লাভার বিস্ফোরণ থেকে। এরপর সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান গ্যাস হলো অক্সিজেন, যা বায়ুমণ্ডলের প্রায় ২১ শতাংশ জুড়ে রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবীতে যেদিন থেকে সমুদ্র সৃষ্টি হয়েছে, সেদিন থেকেই অক্সিজেনের অস্তিত্ব থাকলেও, গ্যাস হিসেবে অক্সিজেনের উৎপত্তি শুরু হয় যখন সাগরে ক্ষুদ্র প্ল্যাঙ্কটনগুলোর জন্ম হয়েছিল। এছাড়া, বায়ুমণ্ডলের ০.৯৩ শতাংশ হলো আর্গন, যা মূলত তেজস্ক্রিয়তা থেকে উৎপন্ন। এই তেজস্ক্রিয়তা পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ এবং পৃষ্ঠের পটাশিয়াম থেকে নির্গত হয়। এই তিনটি গ্যাস মিলিয়ে আমরা যে বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করি, তার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৩ শতাংশ। এই সবগুলো শুষ্ক গ্যাস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে বাতাসে কখনো কখনো জলীয়বাষ্প উপস্থিত থাকে, যা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে অনিয়ন্ত্রিত অংশ হলো, আমরা যে বাতাস গ্রহণ করি তার মাত্র ০.০৭ শতাংশ। এই অতি নগণ্য অংশের মধ্যেই বিদ্যমান থাকতে পারে অসংখ্য ধরনের কণা, বিভিন্ন প্রকার গ্যাস, তরল, ছত্রাক, জীবাণু, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

মোট কথা, এই ০.০৭ শতাংশ বাতাস, যা আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে নিয়মিত গ্রহণ করি, তা প্রধানত মানবসৃষ্ট দূষণ থেকে আসে। ভূপৃষ্ঠের যেকোনো জায়গায় আমরা অবস্থান করি না কেন, এই দূষণের উপস্থিতি কখনো ব্যত্যয় ঘটে না। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে,বর্তমানে বায়ু দূষণ হলো সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং মরণঘাতী দূষণ হিসেবে বিবেচিত।

বায়ু দূষণের কারণে যে মারাত্মক অসুখগুলো হতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে ফুসফুসের নানা জটিলতা, ফুসফুস ক্যান্সার। সহজভাবে চিন্তা করলে আমাদের মনে হতে পারে যে কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়াই বায়ু দূষণের প্রধান উৎস। কিন্তু বিষয়টি আসলে তেমন নয়। কলকারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ার বেশিরভাগই জলীয়বাষ্প। এখানে ক্ষতিকর কণার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে খুব বেশি নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যে পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছি, তা থেকে একটি জীবনঘাতী যৌগ, কণা আকারে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন নামক বিশেষ এক ধরনের কণা এই জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ধোঁয়া থেকে উৎপন্ন হয় এবং বিশ্বের বায়ুপ্রবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কেবল ছড়িয়েই থেমে যায় না; বাতাসে ভেসে থাকার সময় এ কণাগুলো বিভিন্ন রূপান্তরের শিকার হয়। বাতাসে বিদ্যমান অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এগুলো বিভিন্ন ধরনের অক্সিডাইজড রাসায়নিক যৌগ তৈরি করে। কখনো কখনো বৃষ্টির মাধ্যমে ধুয়ে মাটিতে মিশে গেলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই কণাগুলো বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে একটি ভয়ানক ফুসফুস এবং দৃষ্টিশক্তি নাশকারী কণায় পরিণত হয়।

বিশেষত কয়লা নির্ভর কারখানাগুলোর ধোঁয়াতে থাকে মারাত্মক ক্ষতিকর সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাস। এটি বায়ুর জলীয়বাষ্প এবং বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে এমন ধরনের ক্ষতিকর কণার জন্ম দেয়। এ ধরনের দূষণ শহরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বিংশ শতাব্দীতে লন্ডন এবং বেইজিংয়ের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এবং শিল্পোন্নত শহরগুলো এই ভয়াবহ কণার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে একাধিক মহামারির শিকার হয়েছে।

বায়ু দূষণের আরেকটি প্রধান উৎস হলো জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর গাড়ি। এই গাড়ির ধোঁয়াতে থাকে নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং হাইড্রোকার্বন। এরা একত্রিত হয়ে ওজোন নামক গ্যাস তৈরি করে। যদিও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর আমাদের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা দেয়, ভূপৃষ্ঠে ওজোন গ্যাসের উপস্থিতি মোটেও নিরাপদ নয়। ওজোন গ্যাসের অতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে কিছু কিছু শহর ধূসর বর্ণ ধারণ করে, যা দৃষ্টি সমস্যা তৈরি করে এবং পরিবেশকে বিষাক্ত করে তোলে। এটি গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবেও কাজ করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বিগত কয়েক শতাব্দীতে আমরা যে বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসে গ্রহণ করছি, তাতে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। দুঃখজনকভাবে, এই পরিবর্তনটি মোটেও ইতিবাচক নয়। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, সব ধরনের দূষণের মধ্যে বায়ু দূষণ সবচেয়ে প্রাণঘাতী, বিশেষ করে সূক্ষ্ম কণিকা এর কারণে। এই সূক্ষ্ম কণাগুলো মাত্র ২.৫ মাইক্রোমিটারের চেয়েও ছোট এবং প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। বায়ু দূষণ পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে, বিশেষত ঘনবসতিপূর্ণ শহর এবং শিল্পাঞ্চলে। সুক্ষ কণাগুলো ফুসফুস এবং রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে শ্বাসযন্ত্র এবং হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং অকাল মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এছাড়া নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড , কার্বন মনোক্সাইড এবং ভূমি-স্তরের ওজোনের মতো অন্যান্য দূষক দীর্ঘমেয়াদি রোগের সৃষ্টি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউ এইচও) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষ বায়ু দূষণের কারণে মৃত্যুবরণ করে। এটি বায়ু দূষণকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মানবজীবনের বাইরেও বায়ু দূষণের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। এটি পরিবেশের ক্ষতি করে, ফসল উৎপাদন ব্যাহত করে এবং গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, বায়ু দূষণের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে বহু বছর ধরে। বছর বছর বায়ুর মানের অবনতি অব্যাহত রয়েছে। আইকিউএয়ার এর তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ঢাকার বায়ুমান সূচক ছিল ১৫০, যা ২০২৩ সালে বেড়ে ১৭১-এ পৌঁছেছে। এর অর্থ হলো, এই সময়ে বায়ু দূষণ উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলার বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে নিচে অবস্থান করছে। মাত্র ১০টি জেলার বায়ুর মান এখনো আদর্শ সীমার মধ্যে রয়েছে। এই অতিরিক্ত বায়ু দূষণ মানুষের সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বিশেষত, এটি মানুষের প্রজনন ক্ষমতা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। গবেষকরা বায়ু দূষণকে একটি মানবিক বিপর্যয় বলে আখ্যা দিলেও, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কোনো কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অন্তত ১৭টি মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে বায়ুর মান নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণার অভাবে দূষণের মাত্রা আগের তুলনায় বেড়েছে নাকি কমেছে, তার কোনো তুলনামূলক চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ বায়ু দূষণ যখন দেশের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ, তখন সরকারি উদ্যোগে পরিবেশ নিয়ে আরও গভীর গবেষণা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বায়ু দূষণ রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে গবেষকরা স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি কিছু সুপারিশ করেছেন। তারা পরামর্শ দিয়েছেন, শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় প্রতি দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা উচিত। এছাড়া নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঢেকে রাখা এবং নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় সেগুলো ঢেকে রাখা জরুরি। রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করার পাশাপাশি অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানোও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হলো ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, এসব পদক্ষেপ কি পরিবেশ দূষণ রোধে যথেষ্ট? বায়ু দূষণের সমস্যা এতটা গভীর ও বিস্তৃত যে, শুধুমাত্র এসব পদক্ষেপে আমরা কি আসলেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাব? বায়ু দূষণের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আরও সুদূরপ্রসারী, সমন্বিত এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ প্রয়োজন, যা রাষ্ট্রের সব স্তরের সহযোগিতা ও উদ্যোগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন বড় এবং শক্তিশালী শহর বায়ু দূষণ প্রশমনে নানান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, গাড়ির ধোঁয়া নিঃসরণের স্থানে ক্যাটালিটিক কনভার্টার ব্যবহার করা হয়েছে, যা দূষণ অনেকাংশে কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া, বেইজিং-এর মতো বড় শহরগুলো বৈদ্যুতিক শক্তিতে চলমান ইঞ্জিন সম্বলিত গাড়িকে বিশেষভাবে উৎসাহিত এবং জনপ্রিয় করেছে। পরিশেষে বলতে চাই, বায়ু দূষণের সমস্যার সমাধান একেবারেই সহজ নয়। আমরা যে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করি, তা শুধুমাত্র আমাদের জন্য নির্ধারিত নয়। আমরা সবাই একই বাতাস ভাগাভাগি করি, অর্থাৎ বিশ্বের যেকোনো স্থানীয় কারখানায় যেকোনো দূষণ হলে তার প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এই কারণে, বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ কোনো একটি রাষ্ট্র বা জাতির নয়; বরং এটি বিশ্বে বসবাসকারী সকল মানুষের।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

সারাবাংলা/এএসজি

অমিত বণিক দূষণের ভয়াবহতা প্রতিরোধ বায়ু দূষণ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

শাহীন চাকলাদারের ৪ বছর কারাদণ্ড
২২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৪২

‘মানুষ অবদান মনে রাখে না’
২২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:২৬

আরো

সম্পর্কিত খবর