পেন্ডুলামে ঝুলছে স্বপ্ন
২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:৪৫
একজন তুখোড় পড়ুয়া মেডিকেল এডমিশনের ছাত্র বা ছাত্রী ৭৬ মার্ক পেয়েও কেন আসন পেল না? এই প্রশ্নের উত্তর কী দিবেন আপনারা? হ্যাঁ! এমন হয়েছে ২৪-২৫ ভর্তি সেশনে। কারণ সে সেকেন্ড টাইমার ছিল। তিন নম্বর মাইনাস থাকায় তার ফলাফল হয় ৭৩। আর এবারে কাট মার্ক ছিল ৭৩.৭৫ নম্বর। একজন সেকেন্ড টাইমার মেডিকেল এডমিশনের কত ছায়াপথ সমান স্বপ্ন ছিল! বিশাল মহাসাগর বা ওই সীমাহীন উঁচু হিমালয় পরিমাণ স্বপ্ন ছিল। অথচ সে কীসের কাছে হেরে গেল সে নিজেও জানে না। তার জীবন এখন হতাশায় কাটছে। ১০০ মার্কের মধ্যে ৭৬ নম্বর পেয়েও সে তার স্বপ্ন ছুঁতে পারল না। তার স্বপ্ন অসীম আকাশের পেন্ডুলামে ঝুলছে। তার পরিবারের সবার আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সন্তানের কাঁধে স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে রোগীদের সেবা করবে এই দৃশ্যটা দেখতে চেয়েছিল। তার শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল। কিন্তু কী অদ্ভুত কারণে থেমে গেল সহস্র আশা ও স্বপ্ন।
আসলে ঠিক কি জন্য সে স্বপ্নহারা হলো সে নিজেও বুঝছে না। কেউ এক বছর আর কেউ দুইটা বছর পার করছে ডাক্তার হবে বলে। রাতের ঘুম হারিয়ে ভোর পর্যন্ত পড়ছে। টেবিল ও লাল চা নিয়ে বসে থাকতো আঠার মতোই চেয়ারে। কত প্রতিবেশীর দাওয়াত বা প্রোগ্রাম মিস দিয়েছে ডাক্তার হবে বলে। বন্ধুবান্ধবের সাথে ঘুরাফেরা বাদ দিয়েছে সাদা পোষাক পড়ে ক্লাস করবে বলে। ভারচুয়াল জগৎ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে পরিবার ও নিজের স্বপ্ন সত্য করবে ভেবে। বাপের অক্লান্ত পরিশ্রমের টাকা দিয়ে পড়াশোনা করছে মানুষের সেবা করবে বলে। বাপের রক্ত কিংবা ঘামে ভেজা শরীর দেখলে এখন তার হৃদয় কেঁপে উঠে। হু হু করে কাঁদে নিরবে নিজে নিজে। সে কেন হেরে গেছে?
আপনি কয়টা নিউজে দেখছেন একজন ছুঁড়ে পড়া স্টুডেন্টের সাক্ষাতকার নিয়েছে? আপনি কয়টা লেখককে জানেন যিনি একজন বিভীষিকাময় প্রতিযোগিতায় হারা ছাত্রের জীবনী তুলে ধরছে? কয়টা ব্লগারকে চিনেন যে তার ক্যামেরাতে স্বপ্ন ভঙ্গ স্টুডেন্টের জলজল চোখ ভিডিও করছে? না তেমন কেউ নেই এমন। হেরে গেলে কেউ খবর রাখে না। যে জিতে যায় তাকে নিয়ে হইচইপূর্ণ পরিবেশ হয়। তাকে ঘিরে সকল হট্টগোল হয়। যে নিজের বালিশ বিঝিয়ে কাঁদছে তার খবর নেয় এমন মানুষ নগন্য। একজন ৭৬ বা ৭৩ পাওয়া স্টুডেন্ট জানে তার কত পরিশ্রম করতে হয়েছে এই পরীক্ষার জন্য! কত তিমির নির্ঘুম করেছে স্বপ্ন সত্য হবে বলে। আহ জীবন!
তাদের নিয়েও একটু ঘাটাঘাটি করুন। তাদের একটু উৎসাহ দিন। তারা এখনো রুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদছে। সবার সামনে হাসলেও সে রাতে ঘুমাতে পারে না। তার চোখের জল অনাবৃষ্টির ন্যায় বের হচ্ছে। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। বুকে ফিনফিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। এ্যালেজ-গ্যালেজ চিন্তা হচ্ছে কেন আমি হেরে গেলাম? আমি কি কপালের কাছে হারলাম? নাকি এডুকেশন সিস্টেমের কাছে? নাকি মেধার কাছে? আমি কেন হারলাম ইয়া আল্লাহ? কেন আমাকে নিয়ে হইচই হচ্ছে না? কেন সবাই কল দিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে না? কেন সবাই মক ট্রল ও ব্যাঙ্গত্বক হাসছে আমাকে ইঙ্গিত করে? আমার অপরাধ কী? আমি কী চেষ্টা করিনি? আমিও তো বহু কিছু ত্যাগ করছি ডাক্তার হবো বলে।
একজন স্টুডেন্টের পিছনে বহুজনের স্বপ্ন থাকে। মা-বাবা ও ভাই-বোন এর পরিশ্রম রয়েছে। অনেক পিতা-মাতা নিজে ভালো না খেয়ে বা চিকিৎসা না করে ছেলে মেয়েদের ভর্তি যুদ্ধের জন্য তৈরি করেন। পরদেশে গিয়ে স্বদেশ ভুলে ছেলে মেয়ের জন্য টাকা দেন। ছেলেকে ডাক্তার বানাবে বলে মাঝ সমুদ্রে গিয়ে মাছ মারেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। প্রতিদিন সকালে বের হয় সড়কে মরণফাঁদে গাড়ি নিয়ে। আরো বহু সেক্টরে কাজ করে একজন স্টুডেন্টের পিছনে টাকা ডালেন। কিন্তু তারা আজ শূন্য হয়ে ফিরছে। আমরা আপনাদের এই হারকে হার বলে দেখি না৷ আমরা বলব আপনি নব্য কিছু শিখেছেন এখান থেকে। হয়তো পরবর্তী ধাপে আরো উত্তম কিছু অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য। হতাশ না হয়ে সামনে এগিয়ে যান। আপনার ফলাফল খারাপ হয় নাই।
গত ১৭-১৮ সেশন থেকে বর্তমান ২৪-২৫ সেশন পর্যন্ত নিচের দিক থেকে সর্বোচ্চ কাট মার্ক হয়েছে ২৪-২৫ সেশনে। সোজাসাপটা ৭৩.৭৫ যা গত বছর ছিল ৬৭.০০ তে। ১৭-১৮ তে ছিল ৭০.৭৫ আর এবারের আগে নিচের দিক থেকে বেশি ছিল ২১-২২ সেশনে ৭২.৭৫। একজন স্টুডেন্ট কিভাবে মন কে সান্তনা দিবে? সে গত কয়েক সেশনের চেয়ে বেশি মার্ক পেয়েছে তবুও শূন্য মাইনাস শূন্য! তার সকল পরিশ্রম বৃথাই হলো। তাদের পাশে আমাদের থাকা দরকার। তারা অবশ্যই মেধাবী ও পরিশ্রমী। তারা হেরেছে আমাদের সিস্টেম ও আসনের কাছে। হয়তো কিছু আসন বাড়লে আজ তারাও বলত নব্য ও নয়া ডাক্তার হবে।
মহান রব হয়তো তাদের জন্য ভালো কিছু রেখেছে৷ যেমন, আমি একজন ভাইয়াকে চিনি যে দুই দুইবার মেডিকেল এডমিশনে অংশগ্রহণ করে চান্স না পেয়ে দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়েন নাই। তিনি মনকে শক্ত করে নিজের মগজকে আরো ধারালো ও তীক্ষ্ণ করে সেকেন্ড টাইম পাবলিক পরীক্ষা দিয়েছিল। সফলতাও এসেছিল তার। ফার্মেসি নিয়ে পড়ে আজ বিশাল একটা কোম্পানিতে চাকরি করছে। যার ধারেকাছে অনেক ডাক্তারও নাই। তার খ্যাতি বহুগুণ বেড়েছে উল্টো। তিনি কখনো ডাক্তার হতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে নাই। মাঝে মাঝে আমাদের এসব ইতিহাস বলে শুনান তিনি। এমন অহরহ উদাহরণ রয়েছে আনাচ-কানাচে। আজ আপনারা যারা আসন পান নাই তারাও হয়তো সেই ভাইয়ার মতোই হবেন। সুতরাং হতাশ না হয়ে বিশাল আকাশের দিকে থাকান। নতুনভাবে শুরু করুন ভিন্ন বিষয়ের জন্য। পরিশ্রম বৃথা যায় না ও যাবে না। দুশ্চিন্তা না করায় শ্রেয়! মহান সৃষ্টিকর্তা আপনাদের শক্তিশালী করুক ও আরো ভালো কিছু উপহার দিক। সেই কামনা রইলো।
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম
সারাবাংলা/এএসজি