Thursday 30 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সবজির বাম্পার ফলনেও কৃষকের ন্যায্যমূল্য কই?

ড. মিহির কুমার রায়
২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৩৫

বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা গল্পটি মনে হয় বাংলাদেশের কৃষক ও বাজার ব্যবস্থা নিয়েই রচিত হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম যেমন বেড়েছে লাগামহীনভাবে, তেমনি কৃষকদের হতাশা বেড়েছে ন্যায্য মূল্যে ফসল বিক্রি করতে না পারায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কৃষি শুমারি অনুযায়ী, বেশিরভাগ কৃষকের নিজস্ব জমি নেই, তারা অন্যের জমিতে কাজ করেন। সাম্প্রতিক কৃষি শুমারিতে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশের বেশি কৃষক প্রান্তিক কৃষক বা ভূমিহীন। গ্রামীণ কৃষক পরিবারের আয় তুলনামূলকভাবে কম। তারা প্রায়ই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। দারিদ্র্যের হার কৃষকদের মাঝে বেশি, বিশেষ করে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে। বেশিরভাগ কৃষক পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় কৃষকদের জীবনযাপন অনিশ্চিত ও স্থবির হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময়ের পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকদের এখন পথে বসার উপক্রম।

বিজ্ঞাপন

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ লাখ ১০ হাজার ৪০০ হেক্টর জমি থেকে ২ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮০০ টন সবজি উৎপাদন হয়। এর মধ্যে শীতকালে ১ কোটি ৪২ লাখ ৩৫৬ টন আর গ্রীষ্মকালে ৮৩ লাখ ৫২০ টন। বর্তমানে দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজির চাষ হচ্ছে। এসব সবজির প্রায় ৯০ শতাংশ বীজ দেশেই উৎপাদন হয় এবং উৎপাদিত বীজের একটা অংশ বিদেশেও রফতানি হয়। সবজি এখন শুধু মাঠে নয়: পলিথিনের বস্তায়, বসতবাড়ির আশপাশে, ছাদ বাগানের ড্রামে, মাটির টবে এমনকি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জলাভূমি ও হাওর এলাকায় ভাসমান ধাপেও সবজি চাষ হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন ২২৫ গ্রাম সবজি খাওয়া উচিত। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু সবজি ভোগের পরিমাণ ৭০ গ্রাম, যা ২০২০ সালের আগেও ছিল মাত্র ৪২ গ্রাম ও ৬০ ধরনের ২০০ জাতের সবজি ফলান এ দেশের কৃষক। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় ।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি একটি বিষয বহুল আলেচিত হয়েছে সবজির বাম্পার ফলনেও মূল্য নিয়ে হতাশায় ভুগছেন কৃষক। উৎপাদন খরচ মিললেও দেখতে পাচ্ছে না লাভের মুখ। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখলাম ভরপুর ফলনেও কাঁদছেন চাষি। প্রায় বছরেই এ রকম খবর আমাদের চোখে পড়ে। শিম নেন ১০ টাকায়। নিলে নেন দশ টাকায়, বাইছা নেন দশ টাকায়, কেজি নেন দশ টাকা। অথবা ফুলকপির হালি বিশ; এইইই আলু নেন ২৫-এ, চার কেজি একশ, চার কেজি একশ; পেঁয়াজ নেন দুই কেজি নব্বই, এরকম হাঁকডাক চলতি পথের ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে। সম্প্রতি ‘পানির দামে আলু, দিশাহারা কৃষক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ। প্রতিবেদনটির পুরো অংশ যদি কোনো পাঠক নাও পাঠ করেন, তারপরও তার পক্ষে অবস্থা কল্পনা করা কঠিন না। মৌসুম শুরুর আগে বাজারে আলুর দামের কথা ক্রেতা ভুলে যাননি। খাবার জন্য ৮০ টাকা কেজি দরে আলু কিনতে হয়েছে কৃষককেও। তার হাতেও তখন আলু ছিল না। মৌসুমের শুরুতেই বাজারে চাহিদার অতিরিক্ত আলু হিমাগারে ঢুকে যায়। কম দামে সংগ্রহ করা আলুই, কয়েক মাস হিমাগারে থেকে বেরিয়ে আসে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রির জন্য। মাঠ থেকে হিমাগার হয়ে ক্রেতার হাতে আসার আগেই মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে পড়ে আলুর দাম বাড়ে কয়েকগুণ। মাঝ থেকে কৃষকের ভাঁড়ার থাকে শূন্য, আর বাড়তি চাপে খালি হয় ভোক্তার পকেট। গত বছরের প্রায় পুরোটা সময় আলোচনায় ছিল আলুর দাম। বেশিরভাগ সময় খুচরা বাজারে এক কেজি আলু ৬০ থেকে ৭০ টাকা দরে কিনতে হয়েছে। আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে বাধ্য হয়ে পণ্যটির আমদানি শুল্ক কমিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর আমদানিও হয়েছে কিছুটা। তবে বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়নি, বরং দাম বেড়েছে। এখন দেশের বাজারে আগাম আলু ওঠায় দাম কমছে। এদিকে এ বছর আলুর ফলন ভালো হয়েছে। এতে সরবরাহ বাড়ায় খুচরায় দাম কম। আবার গত এক মাসের ব্যবধানে পাইকারিতে আলুর দাম অনেক কমেছে। যাতে লোকসানের আশঙ্কা করছেন কৃষক। কৃষি বিভাগ বলছে, অনুকূল আবহাওয়া থাকায় আগাম আলুর ফলন ভালো হয়েছে। তবে উপযুক্ত দাম না পেয়ে কৃষকরা হতাশ। অনেকে উৎপাদন খরচ না ওঠার শঙ্কা প্রকাশ করছেন। এমন হলে আগামী মৌসুমে আগাম আলুর চাষ কমে যাবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ঠাকুরগাঁও জেলাতেই গত মৌসুমে যেখানে ২৬ হাজার ১৬৮ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়, সেখানে এবার আবাদ হয়েছে ৩৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৫৫ হেক্টর জমিতে যারা আগাম আলু চাষ করেছেন, তারা কেজিপ্রতি দাম পেয়েছেন ৬০-৭০ টাকা পর্যন্ত। অন্যদিকে এখন খোলাবাজারেই আলুর কেজি ২০ থেকে ২৫ টাকা। ফলে আলুর বাড়তি দামের যারা আশা করেছিলেন, তারা লোকসানের ঝুঁকিতে পড়েছেন। কিন্তু আলুর জন্য বীজ, সার, কীটনাশকসহ সবকিছুর খরচ কিন্তু একই। মাঝে থেকে প্রায় দ্বিগুণ খরচ করেও কৃষক উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না। এই যে তথ্যের ঘাটতি, এ দিকটিতে আমাদের নজর দেওয়া জরুরি।

৪০০-৫০০ গ্রাম ওজনের যে ফুলকপির প্রতিটি অক্টোবর- নভেম্বরে বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়, সেই একই ফুলকপি বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা হালি দরে। আর দেড়-দুই কেজি ওজনের ফুলকপি বর্তমানে ময়মনসিংহের বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০ টাকা করে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বগুড়ার মহাস্থানগড়ের হাটে যে ফুলকপিটি বিক্রি হচ্ছে ২ টাকায়, সেটিই মধ্যস্বত্বভোগীদের তিন-চার হাত বদলে পর রাজধানী ঢাকার বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। কী পরিতাপের বিষয়! কৃষক হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফুলকপি উৎপাদন করে প্রতিটিতে পাচ্ছেন মাত্র ২ টাকা আর মধ্যস্বত্বভোগীদের সামান্য পরিশ্রমে পকেটের ব্যাংকে জমা হচ্ছে ১৮ টাকা—কৃষকের প্রতি, কৃষির প্রতি এর চেয়ে অবহেলা ও অবিচার আর কি হতে পারে! বগুড়ার একজন ফুলকপির চাষী দুঃখ করে বলেন, ‘ফুলকপির একটি চারার দামই ২ টাকা। তারপর জমি চাষ, রোপণ, আগাছা দমন, সার-সেচ প্রয়োগ, কপি উত্তোলন ও পরিবহন প্রভৃতি কাজে খরচ বিবেচনায় প্রতিটি ফুলকপির উৎপাদন খরচ পড়ে ১০ টাকা। প্রতিটি ফুলকপি ২ টাকা দামে বিক্রি করলে কপিপ্রতি লোকসান হয় ৮ টাকা। যদি দুই ফুট দূরত্বের সারিতে দেড় ফুট দূরে দূরে চারা লাগানো হয়, তবে একরপ্রতি ১৪ হাজার ৫২০টি চারা রোপণ করা যায় এবং রোপণকৃত ওই চারা থেকে যদি শতকরা ৮০ ভাগ বিক্রয়যোগ্য ফুলকপি হয় তাহলে একরপ্রতি ফুলকপির সংখ্যা দাঁড়ার ১১ হাজার ৬৬১টি। প্রতিটি ফুলকপিতে ৮ টাকা করে লোকসান হলে একরপ্রতি কৃষকের লোকসান হয় প্রায় ৯৩ হাজার টাকা। এভাবে কৃষক যদি লোকসানের সম্মুখীন হন, তাহলে সবজি উৎপাদনে কৃষকের উৎসাহ একেবারে হ্রাস পাবে। সবজি বিপ্লব ব্যর্থ হবে। উৎপাদন কমে যাবে, ব্যবহার হ্রাস পাবে এবং পুষ্টিনিরাপত্তা হবে বিঘ্নিত। আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও মেধা বিকাশ হবে চরম হুমকির সম্মুখীন।

ফুলকপির সঙ্গে বাঁধাকপি, মুলা ও শিম, লালশাক ও লাউশাকের দামেও ধস নেমেছে। বর্তমানে প্রতি কেজি মুলা ময়মনসিংহের ত্রিশাল, ভালুকা, ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫-৬ টাকা কেজি দরে, যা এক মাস আগেও ছিল ৩০-৪০ টাকা কেজি। এছাড়া নভেম্বর মাসে যে বাঁধাকপি প্রতিটি বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকা এখন সেই বাঁধকপির জোড়া বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। আজ থেকে এক মাস আগে যে শিম বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকা কেজি দরে এখন তা বিক্রি হচ্ছে শুধু ২০ টাকা কেজিতে। যে লাউশাক আজ থেকে এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা আঁটিতে, সেই আঁটি বিক্রি হচ্ছে এখন ১০ টাকায়। আর ১০ টাকা আঁটির লালশাক বিক্রি হচ্ছে দুই আঁটি ১০ টাকায়। যে আলু ও বেগুন দুই মাস আগে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়, সেই আলু ও বেগুন এখন বিক্রি হচ্ছে ২০-৩০ টাকা কেজি দরে। আমাদের কথা হলো, রেল-সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে যদি সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতি পূরণ দিতে পারে, তাহলে সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য জোগাতে গিয়ে যে কৃষক ক্ষতির শিকার হন, তিনি কেন সরকারি ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হবেন।

এ ধরনের পরিস্থিতির কিছু কারন প্রাকৃতিক আবার কিছু মানুষ সৃষ্ঠ। যেমন ১. সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষক সময়মতো ফুলকপির চারা তৈরি করেও সময়মতো মূল জমিতে লাগাতে পারেননি। বৃষ্টির পর জমিতে জো আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সব চাষী একযোগে জমিতে ফুলকপির চারা রোপণ করেন এবং একই সময়ে সেই ফুলকুপিতে বাজার ছয়লাব হয়ে যায়। এ বছর খরিপ-১ ও খরিপ-২ মৌসুমে সবজির দাম তুলনামূলকভাবে বেশি থাকায় কৃষক বেশি লাভের আশায় রবি মৌসুমে ব্যাপকভাবে চাহিদার তুলনায় বেশি জমিতে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, লালশাক প্রভৃতি সবজির চাষ করেন। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে পণ্যের মূল্য কমে যাবে—এটা অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম। এছাড়া আলু সংরক্ষণের জন্য দেশে অনেক হিমাগার থাকলেও ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, মুলা সংরক্ষণের জন্য কোনো বিশেষায়িত হিমাগার নেই। আবার ফুলকপি, বাঁধাকপি উত্তোলন করে আলু, পেঁয়াজ ও রসুনের মতো দেশীয় পদ্ধতিতে ঘরেও সংরক্ষণ করা যায় না। কারণ এগুলো অত্যন্ত পচনশীল পণ্য। শুধু সংরক্ষণের অভাবে বাংলাদেশে উৎপাদিত সবজির প্রায় ৩০ ভাগ বিনষ্ট হয়ে যায়: ২. একই সময়ে বাজারে চাহিদার চেয়ে বেশি ফুলকপির/সবজির সরবরাহ, ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা, উচ্চ পরিবহন খরচ ও পথে পথে চাঁদাবাজি এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের কৃষক ঠকিয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার অসাধু প্রবণতা সবজির মূল্য পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে হয়; ৩. অনেক কৃষিবীদ বলছেন মন্ত্রনালয়ের সঠিক নির্দেশনার অভাব, স্থানীয় পর্যায়ে বাজার ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা,নিম্নমানের বীজ,সার সরবরাহের সিন্ডিকেট, কৃষি লোন/প্রণোদনা প্রভাবশালীদের দখলে নেয়া ইত্যাদি কারন হিসাবে ধরে নেযা যায়।

স্বল্প সময়ে অল্প জমি থেকে অধিক আয়, সারা বছর চাষোপযোগী উচ্চফলনশীল সবজির গুণমানের বীজ উৎপাদন, বিপণন এবং সবজি চাষের আধুনিক প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার এবং ফলন বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে ঘটে গেছে সবজি উৎপাদনে এক নীরব বিপ্লব। এ বিপ্লবের নায়ক হলেন আমাদের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ও কর্মঠ কৃষক। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় সোয়া দুই কোটি টনের মতো সবজি উৎপাদন হয়। সবজি রফতানি করেও বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত শুধু সবজি রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করে ১ কোটি মার্কিন ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।চলতি অর্থবছরে কৃষিপণ্য থেকে ১১২ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য খাতের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজারের আকার ছিল ১৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ১৩ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। গত বছর বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বাজার (দেশীয় চাহিদা ও রপ্তানি) ছিল ৪৮০ কোটি ডলারের। আর কৃষিপণ্যের বাজার ছিল চার হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের। কারখানা। তবে অবাক করার মতো তথ্য হচ্ছে, কৃষিপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় তামাক। মোট রপ্তানি আয়ের এক-তৃতীয়াংশই আসে তামাক রপ্তানি থেকে। গত ছয় মাসে এসেছে ১৮ কোটি ডলার বা প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য খাত জিডিপিতে ২ শতাংশেরও কম অবদান রেখেছে, যা পাশের দেশের তুলনায় অনেক কম।

সর্বশেষে বলা যায় জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সিংহভাগই কৃষকের সন্তান। তাহলে কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রদান এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পুনর্বাসনের বিষয়টিও জুলাই বিপ্লবের ঘোষণায় এবং সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। আমাদের দেশে কৃষকরা অন্য দেশের মতো সংগঠিত নন। তাদের কোনো কার্যকরী সংগঠন নেই। যেগুলো আছে, সেগুলোর কাজ হলো সরকারের লেজুরবৃত্তি করা। তাহলে কে করবে কৃষক বাঁচানোর আন্দোলন? ভারতের মতো গড়ে তুলবে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে রাজধানী কাঁপানো সংগ্রাম? কৃষক ঋণের দায়ে বস্তির বনবাসে গেলেও আমাদের নেতাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। নেই কৃষক বাঁচানোর, কৃষিজমি সুরক্ষার, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে, পণ্য পরিবহনে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে, ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যস্থার বিরুদ্ধে কোনো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। কারণ দেশের অধিকাংশ কৃষক নেতাদের সঙ্গে কৃষি ও কৃষকের, মাটি ও ফসলের কোনো সম্পর্ক নেই। নেই কৃষকের সমস্যাসংক্রান্ত তাদের কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা ও আগ্রহ। বিদেশে প্রচুর পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত কৌটা, টিন ও বয়ামজাত সবজি পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে টমেটো সস ছাড়া আর কোনো প্রক্রিয়াজাত সবজির দেখা মেলে না। প্রক্রিয়াজাতের ফলে বেশি মূল্য সংযোজন হয় এবং কৃষকও উৎপাদিত সবজির ন্যায্যমূল্য পান। কৃষককে তার উৎপাদিত সবজির ন্যায্যমূল্য প্রদান নিশ্চিত করতে হলে সংযোগ চাষীর মাধ্যমে উত্তম কৃষিচর্চা অনুসরণ করে নিরাপদ সবজি উৎপাদন এবং বিদেশে রফতানি করতে হবে। সবজি ক্ষেতে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশকের পরিবর্তে জৈবসার ও জৈববালাই নাশক ব্যবহার করে অর্গানিক সবজি উৎপাদন করতে হবে। কারণ বিদেশের বাজারে অর্গানিক সবজির চাহিদা ও দাম অনেক বেশি। তথ্যমতে, কৃষিপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি উৎসাহিত করতে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। একসময় এই হার ২০ শতাংশ ছিল। পরে তা ১৫ শতাংশ করা হয়। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে তা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এ দেশের অর্থনীতির মূল কাঠামো কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। তাই এ খাতে সঠিক প্রণোদনা, রপ্তানি বাড়াতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া, তাজা ফলমূল ও শাকসবজি সংরক্ষণে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা সময়ের দাবি।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সারাবাংলা/এএসজি

কৃষকের ন্যায্যমূল্য ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত সবজির বাম্পার ফলন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর