Saturday 01 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গ্রামীণ অর্থনীতি জন্য ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি জরুরী

ড. মিহির কুমার রায়
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:৪৬ | আপডেট: ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:৪৭

গ্রামীণ অর্থনীতি দেশের সার্বিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকলেও যা বর্তমানে অচলায়তনে রূপ নিয়েছে- সাম্প্রতিক তথ্য উপাত্ত থেকে উঠে এসেছে। জিডিপিতে গ্রামীণ অর্থনীতির ভরকেন্দ্র কৃষি খাতের অবদানও কমে এসেছে। টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়ছে অর্থনীতিতে প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রাখা গ্রামীণ উদ্যোগগুলোর। সব মিলিয়ে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির স্থবিরতায় এখন দুশ্চিন্তা বাড়ছে অর্থনীতিবিদদের। গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম বড় শক্তি কৃষি খাত। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপিতে খাতটির অবদানও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। প্রথম প্রান্তিকে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল দশমিক ১৬ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল দশমিক ৩৫ শতাংশ। এবার বন্যা ও রাজনৈতিক ডামাডোলে কৃষির অবদান কমেছে। আর সার্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ২ শতাংশে নেমে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

গ্রামীণ অঞ্চলে ঋণপ্রবাহ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংক খাতের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি কমেছে প্রায় ১ দশমিক ১২ শতাংশ। ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে এ ঋণ স্থিতি ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৩৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। আগের পঞ্জিকাবর্ষের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) শেষে এ স্থিতির পরিমাণ ১ লাখ ২৬ হাজার ১৫০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।এ সময়ে দেশে ব্যাংক খাতের মাধ্যমে মোট বিতরণকৃত ঋণ স্থিতিতে গ্রামীণ ঋণের অবদানও কমেছে। গত পঞ্জিকাবর্ষের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা আগের অর্থবছর শেষে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের কৃষি খাতে ৩৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এর মধ্যে বিতরণ করতে পেরেছে ৬ হাজার ৪৫৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে কৃষি খাতে মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৮২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ২৬ দশমিক ৮২ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

কৃষি ঋণ বিতরণের উপখাতভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত অর্থবছরের তুলনায় এবার মোট কৃষি ঋণ বিতরণে শস্যের অবদান গত অর্থবছরের ৪৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৪৩ শতাংশে। আর দারিদ্র্য দূরীকরণে ঋণ বিতরণের অংশ ৮ শতাংশ নেমে এসেছে ৪ শতাংশে। তবে মোট ঋণ বিতরণে মৎস্য এবং পশুপালন ও পোলট্রি খাতের বিতরণের অবদান গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্য ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকে ১২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। বাকি ২৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করবে দেশের বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে গত মাসে বিদেশী ব্যাংকগুলো থেকে কৃষি ঋণের প্রবাহ কমেছে প্রায় ৭১ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় এ হার ছিল ৩১ শতাংশ। আর সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কৃষি ঋণ কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি। তবে ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাবে কৃষি ঋণ বিতরণ কিছুটা কমেছে। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ঋণ পরিশোধের দিক থেকে বরাবরই সেরা পারফরম্যান্স আসে কৃষি খাত থেকে। খাতভিত্তিক ঋণ বিতরণের অনুপাতে আদায়ের হারের দিক থেকে কৃষির অবস্থান প্রতি বছরই শীর্ষে। এবারো এ খাতে ঋণ বিতরণ কমলেও ঋণ আদায় আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ আদায় হয়েছে ৯ হাজার ২০৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ আদায় হয়েছিল ৮ হাজার ১৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এদিকে অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গ্রামীণ ব্যাংক এবং বড় ১০টি এনজিও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কৃষি খাতে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৭১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকার, যা গত অর্থবছরের তুলনায় দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। এনজিওগুলো ঋণ বিতরণের প্রভাব ঠিক রাখতে পারলেও পিছিয়ে পড়েছে দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চার দিনব্যাপী বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের শেষদিনে এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জমির উর্বরতা ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত উর্বরতা শক্তি কিছুটা বেড়ে হয়েছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ব্যাপক কমে উর্বরতা শক্তি দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সার, কীটনাশক এবং ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক ব্যবহার পরিবেশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষণায় আরও বলা হয়, ধীরে ধীরে কমছে শ্রমিকের দক্ষতাও। গবেষণায় বলা হয়েছে, ধানের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। প্রতিকেজি চালের উৎপাদন খরচ ২০১২ সালে ছিল ১০ টাকা ৫১ পয়সা। সেটি বেড়ে ২০১৫ সালে হয়েছে ১১ টাকা ৬৭ পয়সা, ২০১৮ সালে ১২ টাকা ৮৮ পয়সা। অন্যদিকে এক কেজি চাল বিক্রি করে লাভ হতো ২০১২ সালে ১৬ টাকা ১৭ পয়সা; ২০১৫ সালে ১৬ টাকা ৫২ পয়সা এবং ২০১৮ সালে ১৭ টাকা ৪৮ পয়সা। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে ধান উৎপাদন করে কৃষকের লাভের অংশ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হয়। তবে কৃষি খাতে বিদ্যমান নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এ খাতের টেকসই উন্নয়ন অব্যাহত রাখা সম্ভব। টেকসই উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে এ খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষকবান্ধব বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। ফসল উৎপাদনের মৌলিক উপাদান মাটি ও পানির দূষণ ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা সমস্যার কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আগামীতে এ ধরনের আরও যেসব সমস্যা ফসল উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে, তা চিহ্নিত করে সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। শস্যের নতুন জাত আবিষ্কার করতে হবে। জমির উর্বরা শক্তি বাড়াতে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করা দরকার। বস্তুত এ সবকিছুর জন্য প্রয়োজন গবেষণা বাড়ানো। উর্বরতা পুনরুদ্ধারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, কৃষকদেরও সে বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। সময়মতো সহজ শর্তের ঋণ ও প্রশিক্ষণ না পেলে কৃষকদের কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সম্ভব হবে না। কৃষক যাতে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান, এটাও নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নতুন করে দেশ পুনর্গঠনের বিভিন্ন দাবি উঠলেও, দুঃখজনকভাবে কৃষকদের অধিকারের প্রশ্ন তথা গ্রামীন অর্থনীতি অনেকাংশেই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে সাম্প্রতি বন্যায়গ্রামগুলোর যে ক্ষতি হয়েছে, তা জাতির সামনে জ্বলন্ত বাস্তবতা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মতে, বন্যায় সরাসরি আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৩৭ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর, যার কারণে অর্থনীতির ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই বিপুল ক্ষতি গ্রামীন জনপদে জীবনের ওপর যে আঘাত হেনেছে, তা পুষিয়ে নেওয়া সহজ হবে না।

লেখক: গবেষক ও শিক্ষাবিদ

সারাবাংলা/এএসজি

গ্রামীণ অর্থনীতি ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

ইজতেমায় যৌতুকবিহীন ৬৩ বিয়ে
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২১:৪৯

আরো

সম্পর্কিত খবর