নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা: আইসিসির মুকুটহীন সম্রাট
১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:৫৪
শুরু হয়ে গেছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির উন্মাদনা। দীর্ঘ আট বছর পর পর্দা উঠতে যাচ্ছে আইসিসির আরো একটি মেগা ইভেন্টের। ইতিমধ্যে সব দলই যে যার দল গুছিয়ে নিচ্ছে। খেলছে প্রস্তুতিমূলক দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। আইসিসির এই ইভেন্টে লড়বে ক্রিকেটের পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা,ভারতের মতো দলগুলো। কিন্তু আইসিসির এই ইভেন্টের পরাশক্তির মাঝেও সবচেয়ে অভাগা দলগুলোর মধ্যে দুইজন হলো নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা।
ক্রিকেটকে বলা হয় থাকে ভদ্র লোকের খেলা। আর ভদ্র লোকের খেলাকে আরো প্রসিদ্ধ করেছে নিউজিল্যান্ড। নিউজিল্যান্ডকে ঘিরেই সবারই বাড়তি উন্মেদনা থাকে। আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট এলেই অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষকরা ধরেই রাখে এইবারের বিজয়ী নিউজিল্যান্ডের হতে যাচ্ছে। বছরকে বছর তারা নিজেদেরকে শক্তিমত্তার দিক দিয়ে প্রতিযোগিতা মনোভাবসম্পন্ন প্রস্তুত করে তুলেছে যা বাদবাকি দলের জন্য শিক্ষণীয়।
কিন্তু আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্টগুলোতে বরাবরই পরিচয় দিয়ে থাকে নিউজিল্যান্ড। বিশেষত বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোতে সেমিতে উঠার লড়াইয়ে নিউজিল্যান্ড সবসময় সবার থেকে এগিয়ে থাকে। কিন্তু এই সেমিফাইনাল যেনো নিউজিল্যান্ডের একরকম দুঃস্বপ্ন বলা চলে। ফাইনালে খেলে ট্রফি স্বপ্ন উঁচিয়ে ধরার স্বপ্ন দেখালেও সেই স্বপ্ন রুপ সেমিতে হারার মধ্যে রুপ নেয় দুঃস্বপ্নে। তাই নিউজিল্যান্ডকে অনেকটা মুকুট হীন সম্রাটও বলা চলে।
পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যায় তাহলে ওয়ানডে ফরম্যাটের বিশ্বকাপ কিংবা টি টুয়েন্টি ফরম্যাটের বিশ্বকাপ; এই দুই ফরমেটের আইসিসি ইভেন্টগুলোর ফাইনালে খেলেছে নিউজিল্যান্ড। অন্যদিকে শেষ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিগুলোতে নিজেদের সামর্থের চাইতেও দূর্বল জায়গাটায় তুলে ধরেছে।
চার ছক্কার সীমিত ওভারে বিশ্বকাপে সেমিতে খেলেছে নিউজিল্যান্ড ১০ বার এবং ফাইনাল হেরেছে তিনবার। বিশ্বকাপের মঞ্চে ট্রফি উঁচিয়ে ধরার উল্লাসে মেতেছিল আজ থেকে ২৪ বছর আগে। ২০০০ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের বিশ্বমঞ্চে ট্রফি উঠিয়ে ধরার কর্তৃত্ব দেখায় নিউজিল্যান্ড।
এরপর অনেক বিশ্বকাপ এলো আর গেলো কিন্তু ট্রফি থেকে একপ্রকার বঞ্চিতই ছিলো নিউজিল্যান্ড। পরবর্তী ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে নিউজিল্যান্ডকে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ ২১ বছর। ২০২১ সালে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে আবারো সেই পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে হারিয়ে বিশ্বমঞ্চে আরো একটি ট্রফি উঁচিয়ে ধরার স্বাদ পায় নিউজিল্যান্ড।
চার ছক্কার টি টুয়েন্টি টুর্নামেন্টের দুই বিশ্বকাপের প্রথম আসরে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয় নিউজিল্যান্ডের। একই দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে টুর্নামেন্টে দুটি সবশেষ আসরে। ২০২২ টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে মাত্র ৩ বলের ব্যবধানে বিদায় নিতে হয় সেমিফাইনাল থেকে, অন্যদিকে গেলো বছর ২০২৩ ভারত বিশ্বকাপেও চেনা প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছে হেরে আবারো বিদায় নিতে হয়।
শুধু এখনই নয় ১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৯২, ১৯৯৯, ২০০৭ এবং ২০১১ এই বিশ্বকাপ গুলোতে নিউজিল্যান্ড স্বপ্নভঙ্গের উপহার হাতে নিয়ে ফিরে আসতে হয় বিশ্বমঞ্চ থেকে। সেমিফাইনাল বাদেও টানা ফাইনাল হারার অভিজ্ঞতাও নিউজিল্যান্ডের রয়েছে।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই! তারকা ভর্তিতে থাকা নিউজিল্যান্ড দল সেবার বাজেভাবে অস্ট্রেলিয়ার কাছে মাথা নত করে। ঠিক একইভাবে আরো একবার ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের সামনে সুযোগ এসেছিল বিশ্বকাপের আরো একটি ট্রফি উঁচিয়ে ধরার। সেবার প্রতিপক্ষ ছিলো ইংল্যান্ড। কিন্তু প্রতিপক্ষ বদলালেও ভাগ্য কিন্তু বদলায়নি নিউজিল্যান্ডের । আম্পায়ারের একটি ভুল সিদ্ধান্তে ওইবারেও ট্রফি হাতছাড়া হয় নিউজিল্যান্ডের।
এর এক বছর পরেই ২০২১ বিশ্বকাপেও সেই চিরচেনা চেনা প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার কাছেও মাথা নত করে নিউজিল্যান্ড। সব মিলিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সবশেষ তিন আসরে সেমিফাইনাল খেলেছে নিউজিল্যান্ড। যারা এখনো প্রথম সীমিত ওভারের বিশ্বকাপ জয়ের অপেক্ষায়।
এরপরের বছর ২০২২ সালে পাকিস্তানের কাছে ৭ উইকেটে হেরে সেমিফাইনাল থেকে বরাবরের মতো বিদায় নেয়। যা তাদের রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
২০২৪ বিশ্বকাপ, এই বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের ভাগ্য বিগত বিশ্বকাপের তুলনায় অনেকটাই ব্যাকফুটে ছিলো। নতুন গল্প লেখার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এবারও মাঠে নেমেছিল কেইন উইলিয়ামসন, টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্টরা। কিন্তু আফগানিস্তান থেকে শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের গ্ৰুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলো নিউজিল্যান্ড।
অথচ এই নিউজিল্যান্ড, প্রত্যেকবারের মতো সেরা একাদশ নিয়ে মাঠে নেমেছিল। কেইন উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে ভর করে শক্তিশালী পেস ইউনিট এবং স্পিনিং ইউনিটের কম্বিনেশনে এইবারের বিশ্বকাপে নতুন কিছু রাঙাতে চেয়েছিলো।
সাউদি-বোল্ট -লুকি ফার্গুসন- ইশ সোধিরা বোলিং নৈপুণ্যে দেখালেও ব্যাটিং বিভাগে উইলিয়ামসন, কনওয়ে, রাচিন রবীন্দ্ররা ব্যর্থতার বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলো। যার ফলে এইবারও স্বপ্নভঙ্গ হলো নিউজিল্যান্ডের।
এইতো গেলো, টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ওয়ানডে বিশ্বকাপের কথা। শেষ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি গুলোতেও নিউজিল্যান্ডের পারফরমেন্স ছিলো হতাশায় ভর্তি। ২০০০ সালে ভারতকে হারিয়ে প্রথম শিরোপার স্বাদ পায় নিউজিল্যান্ড। এরপর আর বেশিদূর আগাতে পারেনি। ২০০৬ সালে সেমিফাইনাল থেকে বিদায়, ২০০৯ সালে ফাইনাল থেকে ঝরে যায় একসময়কার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শিরোপা উঁচিয়ে ধরা দল নিউজিল্যান্ড। এরপর পরবর্তী দুই আসরে ২০১৩ এবং ২০১৭ সালে নিজেদের দূর্বল পারফরম্যান্সের কারণে মূল পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়।
আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্টগুলোতে এমন কঠিন সময়ে নিউজিল্যান্ডের হারার প্রধান কারণ হলো ব্যাটসম্যানদের প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স করতে না পারা। নিউজিল্যান্ডের বেশ কয়েকটি সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল ম্যাচ পরিলক্ষিত করলে দেখা যায় টপ অর্ডারদের রীতিমতো ব্যাটিং ব্যর্থতার ফলে কাঙ্খিত লক্ষ্য থেকে তাদের বাদ পড়তে হয়।
অন্যদিকে পাওয়ারপ্লে এবং ডেথ ওভারে ভালো বোলিং এর পর্যাপ্ততার অভাব। তাছাড়া নিউজিল্যান্ড দল সাধারণত পেস-বান্ধব উইকেটে খেলে অভ্যস্ত, ফলে উপমহাদেশের স্পিনার- প্রধান উইকেটে তাদের পারফরম্যান্স তুলনামূলকভাবে দুর্বল।
অন্যদিকে নিউজিল্যান্ড দল সাধারণত রক্ষণাত্মক এবং শৃঙ্খলিত ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করে। তবে অনেক সময় আইসিসি ইভেন্টে আক্রমণাত্মক মানসিকতা এবং দ্রুত রান তোলার প্রয়োজন পড়ে, যা তাদের দূর্বল দিক। সেইসাথে উপমহাদেশের ধীর এবং স্পিন-সহায়ক পিচে নিউজিল্যান্ডের সাফল্য সীমিত। তাদের ব্যাটসম্যান ও বোলারদের কন্ডিশনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সময় লাগে।
নিউজিল্যান্ড দল সাধারণত দলগত পারফরম্যান্সে নির্ভরশীল। যদিও কয়েকজন তারকা খেলোয়াড় (যেমন কেন উইলিয়ামসন, ট্রেন্ট বোল্ট) রয়েছে, তাদের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা কখনো কখনো সমস্যার সৃষ্টি করে।
অথচ ভারত বিশ্বকাপে হাই স্কোরিং রানের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল নিউজিল্যান্ডের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। বিশেষ করে রাচীন রবীন্দ্র বিধ্বংসী ব্যাটিং সবার নজর কেড়েছিল। কিন্তু চাপ মুহূর্তে ব্যাটিং এবং বোলিং এর ব্যর্থতায় দলকে ছিটকে দিয়েছে বিশ্বকাপের লম্বা আসর থেকে।
অন্যদিকে লড়াই করলেও শেষ মুহূর্তে ভাগ্য সহায় না হওয়া, কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ও ম্যাচ-উইনারদের অভাবে হেরে যায়। সব মিলিয়ে নিউজিল্যান্ড দলটাকে বিশ্বকাপের মুকুটহীন সম্রাট কিংবা দ্বিতীয় চোকার্স বললেও ভুল হবার নয়।
এইবার আসা যাক আইসিসি ইভেন্টেগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম চোকার্স তকমা পাওয়া দলটির কাছে। দলটির নাম দক্ষিণ আফ্রিকা। হাসিম আমলা, এবি ডি ভিলিয়ার্স, ফাফ ডু প্লেসিসের যুগের অবসানের পর টেম্বা বাভুমার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছিলো সাউথ আফ্রিকা। সবাই হয়তো স্বপ্ন দেখছিলো, হাসিম আমলা-এবি ডি ভিলিয়ার্সের নেতৃত্বে থাকাকালীন কোনো ট্রফি জেতা হয়নি তা হয়তো টেম্বা বাভুমার নেতৃত্বের মাধ্যমে অবসান ঘটবে, বরংচ এর আক্ষেপের মাত্রাটা বেড়েছে আরো দ্বিগুণ।
১৯৯১, সেই বছর বর্ণবাদের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু তৎকালীন সময়ে কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান হান্সি ক্রোনিয়ের ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারি কিছুটা কলঙ্কিত করেছে।তবে গ্যারি কারস্টেন, জ্যাক ক্যালিস, এবি ডি ভিলিয়ার্স, হাশিম আমলা, ফাফ ডু প্লেসিসদের মতো খেলোয়াড়রা মাঠে তাদের আচরণ এবং নৈতিকতার মাধ্যমে ক্রিকেটকে তারাও সত্যিকারের ‘ভদ্রলোকের খেলা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রেখেছেন।
কিন্তু ১৯৯৮ সালে ঢাকার মিনি বিশ্বকাপ (চ্যাম্পিয়নস ট্রফির আদি নাম) বাদ দিলে গল্পটা কমবেশি একই। প্রতি ইভেন্টই প্রবল শক্তিমত্তা নিয়ে বিশ্বকাপের আসরে হাজির হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। মনে হয়, এবারেই যেন পূর্বের দুঃখগুলো ঘোচানোর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে প্রোটিয়ারা। ক্রিকেটের সবচেয়ে শক্তিশালী দলের একটি তারা, সারা বছর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দেয় তারা। অথচ আইসিসির বৈশ্বিক কোনো টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বে নামলেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে প্রোটিয়ারা। তাই শেষ পর্যন্ত ‘চোকার্স’ ট্যাগ আরও বেশি আপন করে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের।
সেরা ব্যাটার, দুর্দান্ত বোলার-অলরাউন্ডার নিয়ে খেলতে এসেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের আইসিসির ফাইনাল খেলতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। অশ্রুসিক্ত চোখে বারবার বিদায় নিতে হয়েছে সেমিফাইনাল থেকে। মাঝে ২০২৪ সালে বহুল প্রতীক্ষিত ফাইনাল খেললেও ভারতের কাছে হেরে বরাবরের মতো আত্মসমর্পণ করে দক্ষিণ আফ্রিকা।
অথচ ২০২৩ ভারত বিশ্বকাপে এসেই তুলকালাম কাণ্ড করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রতিপক্ষের বোলারদের তুলোধুনো করে বিশ্বকাপের রেকর্ডবই তছনছ করেছে তারা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪২৮ রান করে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড করেছিল প্রোটিয়ারা।
২০২৩ বিশ্বকাপে দাপটের সঙ্গে খেলে সেমিফাইনালে উঠেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে এবারও নিজেদের দুঃখ ঘোচাতে পারেনি তারা। আসরের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৩ উইকেটে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে প্রোটিয়াদের। ২৪ বছর পর এসেও অসিদের বিপক্ষে হারের প্রতিশোধ নিতে পারেনি তারা। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
এর আগেও যেভাবে সেমিফাইনালে এসে স্বপ্ন ভেঙেছে দক্ষিণ আফ্রিকার। ২০১৫ বিশ্বকাপ আসরের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। বৃষ্টিবিঘ্নিত ওই ম্যাচটি যদি জিততে হতো ২ বলে ৫ রান দরকার ছিল নিউজিল্যান্ডের। স্ট্রাইকে তখন গ্রান্ট ইলিয়ট। প্রথম বলেই ডেল স্টেইনকে ছক্কা মারলেন ইলিয়ট। কিউইরা যখন ফাইনালে যাওয়ার আনন্দে উন্মাদে ব্যস্ত অন্যদিকে হাশিম আমলা, ফ্যাফ ডু প্লেসি ও অধিনায়ক এবি ডি ভিলিয়ার্সের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।
এর ঠিক ২৩ বছর আগে, ১৯৯২ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। আর প্রথমবার খেলতে এসেই সেমিফাইনালে উঠে গিয়েছিল তারা।
সেবার সেমিফাইনালে প্রোটিয়াদের খেলা পড়েছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেই সেমিফাইনালে জয়ের পথে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা বাদ পড়ে বৃষ্টি আইনের অদ্ভূত নিয়মে। এরপর ক্রিকেটবিশ্বে বৃষ্টি আইনের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়। অনেক ক্রিকেটপ্রেমী এই পদ্ধতি নিয়ে উপহাস করেন। কিন্তু সেই সমালোচনাও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফাইনালে তুলতে পারেনি।
১৯৯৬ সালে পরের আসরে নকআউট পর্ব শুরু হয়েছিল কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। প্রোটিয়ারাও দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। সেখানে মুখোমুখি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের।
সেই ম্যাচে ব্রায়ান লারার দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে ৮ উইকেট হারিয়ে ২৬৪ রান করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে ব্যাট করতে নেমে এক পর্যায়ে ৪ উইকেটে ১৮৬ রান তুলে ফেলে তারা। কিন্তু সেখান থেকে পথ হারিয়ে ম্যাচ হেরে বিদায় নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।
তৎকালীন সময়ের ৩ বছর পর ১৯৯৯ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। যুক্তরাজ্যের এজবাস্টনে টস হেরে ব্যাট করতে নেমে ২১৩ রান করে অস্ট্রেলিয়া। জবাবে ব্যাট করতে নেমে হাতে ১ উইকেট আর ৩ বল হাতে রেখে ম্যাচ ড্র করে ফেলে দক্ষিণ আফ্রিকা।
ম্যাচ ড্র হলেও আসরে সুপার সিক্সের খেলায় পয়েন্ট টেবিলে এগিয়ে থাকার কারণে ফাইনালের টিকিট পেয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। বুকভরা কষ্ট নিয়ে বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা।
মাঝে ২০১৯ সালেও দক্ষিণ আফ্রিকার পারফর্ম্যান্স ছিলো ব্যর্থতায় ভর্তি। ৯ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ৩ টি ম্যাচ জিতেই গ্ৰুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েই বিশ্বকাপ শেষ করে।
এইবার নজর দেওয়া যাক ৮ বছর পর বর্তমান সময়ের আলোচিত ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দিকে।১৯৯৮ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রথম আসরের শিরোপা নিজেদের করে নেয়। সেই শেষ, এরপরের পরবর্তী আসরগুলোতে সাউথ আফ্রিকার যাত্রা ছিলো আসা যাওয়ার মিছিলে।
পরবর্তী আসরে অর্থাৎ ২০০২ সালে সেমিফাইনালে বিদায় দিয়ে ছন্দপতন শুরু। এরপর ২০০৪ সালে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়। ২০০৪ সালে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়ের পর ২০০৬ সালেও সালে সেমিফাইনাল থেকেও বিদায় নেয়। এরই ধারাবাহিকতায়, ২০০৯ সালে আয়োজক দল হয়েও গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়ের স্বাদ পায় দক্ষিণ আফ্রিকা।
২০১৩ সালে আবারও সেমিফাইনালের যাওয়ার টিকিট অর্জন করে সাউথ আফ্রিকা কিন্তু ইংল্যান্ডের কাছে অসহায়ভাবে আত্মসর্মপন করে তৎকালীন এবিডি ভিলিয়ার্সের দল। এরপরের পরবর্তী আসর ২০১৭ সালে একই ইতিহাস দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তি করে দক্ষিণ আফ্রিকা। এইবারও গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে হয় এই দলের।
এখন আসল কথা হলো, দক্ষিণ আফ্রিকার কেনো বারবার এতো কাছে এসে তরী ডুবতে হয়; এর আসল কারণ খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসবে,ফাইনালের চাপ এবং মানসিক প্রস্তুতির অভাব। দক্ষিণ আফ্রিকা বহুবার আইসিসি টুর্নামেন্টে চাপের মুখে ভেঙে পড়েছে। বড় ম্যাচে নার্ভ ধরে না রাখতে পারার কারণেই চাপে থাকা ম্যাচগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে না দক্ষিণ আফ্রিকা।
যা একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তাছাড়াও অনেকসময় ফাইনাল বা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে ‘ফিনিশার’ হিসেবে শক্তিশালী খেলোয়াড়দের অভাব দেখা যায়। দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার থাকলেও, প্রয়োজনীয় মুহূর্তে স্নায়ুচাপ কাটিয়ে ম্যাচ শেষ করার মতো দক্ষতা অনেক সময় অনুপস্থিত থাকে।
পাশাপাশি বড় ম্যাচে কখনও কখনও ভুল কৌশল বা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, বোলিং পরিবর্তন বা ব্যাটিং অর্ডার ঠিকমতো সাজানো না হওয়া। আর তাছাড়া টানা জয়ের পর ফাইনালে এসে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বা চাপ সামলাতে না পারার ফলে এমন ফলাফল হয়ে থাকে। যা কাকতালীয়ভাবে নিউজিল্যান্ড দলের মধ্যেও বিদ্যমান।
তাই এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্ট, টিম সাউদি এবং লকি ফার্গুসনদের নতুন বলে উইকেট নিতে হবে। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার কাগিসো রাবাদা, আনরিখ নরকিয়া, মার্কো ইয়ানসেনদের পাওয়ারপ্লেতে ও ডেথ ওভারে কার্যকর হতে হবে।
সেইসাথে ব্যাটসম্যানদেরও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। দুই দলের খেলোয়াড় উইল ইয়াং, ডেভন কনওয়ে, কেন উইলিয়ামসন (নিউজিল্যান্ড), হেনরিক ক্লাসেন, এইডেন মার্করাম, ডেভিড মিলারদের (দক্ষিণ আফ্রিকা) মতো ব্যাটারদের বড় ইনিংস খেলতে হবে, বিশেষ করে চাপের মুহূর্তে। যাতে করে ব্যাটিং এর শেষাংশে দ্রুত রান তুলতে সক্ষম হয়।
নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকা দুটো দলই ভালো ফিল্ডিংয়ের জন্য পরিচিত। তবে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ক্যাচ না ছাড়ার এবং সরাসরি থ্রোয়ে রানআউট বের করার দক্ষতা বাড়াতে হবে।
পাকিস্তানের কন্ডিশনে অনুষ্ঠিত হবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ২০২৫। সেখানকার উইকেট সাধারণত স্পিনারদের সাহায্য করে এবং রাতে শিশির প্রভাব ফেলতে পারে। তাই, এই কন্ডিশনে দ্রুত মানিয়ে নিতে হবে।
সময় বদলিয়েছে, তরুণ খেলোয়াড় এবং অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের সমন্বয়ে দুই দলেই বেশ ভারসাম্য দল। এইবার দুই দলেই চাইবে নিজেদের ‘চোকার্স’ ট্যাগ থেকে বেরিয়ে আসতে। এখন দেখার বিষয় হলো ‘চোকার্স’ ট্যাগ থেকে বেরিয়ে শিরোপার ছোঁয়া কোন দল উপভোগ করবে, তা হয়তো সময়েই বলে দিবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এএসজি