পরিবেশের জন্য রক্ষা করতে হবে জলাভূমি
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:২৯
আমরা বাঙালি, আমাদের বলা হয়ে থাকে মাছেভাতে বাঙালি। বাংলাদেশ কে আরো বলা হয় নদী মাতৃক দেশ। নদী, খাল,বিল, জলাশয় সব কিছুই পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করে। জলাভূমি হলো এমন একটি স্থান বা এলাকা, যার মাটি মৌসুমভিত্তিক বা স্থায়ীভাবে আর্দ্র বা ভেজা থাকে। জলাভূমিগুলো গোটা পরিবেশব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র হিসাবে বিবেচিত হয়।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের সমৃদ্ধ উদাহরণ হলো জলাভূমি। ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস। ১৯৯৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০০টিরও বেশি দেশের পরিবেশসচেতন নাগরিকরা এই দিবসটি পালন করে আসছে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীনালা, বিল, হাওর, বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি এ দেশকে ঘিরে রেখেছে। তথ্যমতে, এ দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। জলাভূমির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের এই দিনে ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদী সম্মেলনে জলাভূমির টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সই হয়। যা রামসার কনভেনশন চুক্তি বলে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে রামসার কনভেনশন চুক্তি কার্যকর হয়।১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এ চুক্তিতে সই করে। তথ্যমতে এখন পর্যন্ত ১৭১ দেশ চুক্তি অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীনালা, বিল, হাওর, বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি এ দেশকে ঘিরে রেখেছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, এ দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মত্স্য, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো জলাভূমি।
বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৫০ শতাংশ বা ৭-৮ লাখ হেক্টর ভূমি জলাভূমি। দেশটি ১৯৯২ সালে রামসার চুক্তিতে সই করে। প্রথম রামসার স্থান হিসেবে সুন্দরবন ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে দ্বিতীয় রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পৃথিবীজুড়ে ২ হাজার ৪৭১টি জলাভূমির স্থান আন্তর্জাতিক গুরুত্ব হিসেবে তালিকাভুক্ত, যার মোট আয়তন ২৫৬,১৯২,৩৫৬ হেক্টর।
কিন্তু প্রশ্ন হলো জলাভূমির বিষয়ে আমরা কতটা সচেতন? জলাভূমির উপকারিতার বিষয়ে আমরা কতটা জানি? জলাভূমি পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় কতটা ভূমিকা রাখে? আসলেই কি আমরা জলাভুমি রক্ষায় কাজ করছি নাকি জলাভূমি ধংসলিলায় মেতে উঠেছি? এমন নানা প্রশ্ন আমার মতো সচেতন মহলের। এর উত্তরই বা কি আছে? আমাদের দেশে পরিবেশ রক্ষায় কত আইন, বিধি রয়েছে সেগুলো আমরা কতটা মানি? যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় অথবা জানতে চাওয়া হয় জলাভূমি কি? জলাভূমির পরিবেশ এবং মানুষের জন্য কি কাজ করে অথবা আজ থেকে ১০ বা ২০ বছর আগে কি পরিমাণ জলাভূমি ছিলো এখন তার চেয়ে বেড়েছে না কমেছে? এর উত্তর হয়তো অনেকেরই জানা নেই বা জানলেও প্রকৃত তথ্য জানা নেই কিংবা জানার চেষ্টাও করি না। অথচ বাংলাদেশের পরিবেশ, নদী, খাল, বিল রক্ষায় আইন বিধি রয়েছে। কিন্তু সেই আইন লাল ফিতায় বন্দি।
জাতীয় পানি নীতি (১৯৯৯) এর ৪.১৩ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘…হাওর, বাঁওড় ও বিল জাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যর ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে এগুলোর গুরুত্ব অসীম। হাওর এবং বাঁওড়গুলোতে শুষ্ক মৌসুমেও যথেষ্ট গভীরতায় পানি থাকে তবে ছোট বিলগুলো সাধারণত চূড়ান্তপর্যায়ে আর্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। এই বিলগুলো প্লাবনভুমির নিম্নতম অংশ। এই জলাশয়গুলো আমাদের প্রাকৃতিক মৎস্যসম্পদের সিংহভাগের উৎস এবং নানা ধরনের জলজ সবজি ও পাখির আবাসস্থল। তা ছাড়াও শীত মৌসুমে উত্তর গোলার্ধ থেকে আগত অতিথি পাখিদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। হাওর এবং বিলগুলো খালের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। অতীতে প্রকৌশলগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অনেক বিলকে তাৎক্ষণিক ফসল লাভের জন্য নিষ্কাশিত আবাদি জমিতে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকট আকার ধারণ করে। প্রথমেই মাছ এবং গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের উৎস কচু, শাপলা, কলমি জাতীয় জলজ সবজির বিলুপ্তি ঘটে। বর্ষা মৌসুমে প্লাবনভূমির বর্জ্য প্রবহমান খালের মাধ্যমে বাহিত ও শোধিত হয়ে নিষ্কাশিত হতো। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সেই প্রাকৃতিক শোধনক্রিয়া ব্যাহত হয়ে পরিবেশের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করেছে।’
অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ ২০০০ সালের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছে, ‘…হাওর ও জলাভূমি এলাকা অর্থ নিচু প্লাবিত অঞ্চল যাহা সাধারণত হাওর এবং বাওর বলিয়া পরিচিত।’ ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০-এর ১৮৭ নং অনুচ্ছেদে আছে, ‘…বদ্ধ জলমহাল বলিতে এরূপ জলমহাল বুঝাইবে যাহার চতুঃসীমা নির্দিষ্ট অর্থাৎ স্থলবেষ্টিত এবং যাহাতে মৎস্যসমূহের পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে মৎস্য ধরার উপযোগী। সাধারণত, হাওর, বিল, ঝিল, হ্রদ, দিঘি, পুকুর ও ডোবা ইত্যাদি নামে পরিচিত জলমহালকে বদ্ধ জলমহাল বলিয়া গণ্য করা হয়’। জাতীয় পানি নীতিতে আরও উল্লেখ আছে, ‘…হাওর, বাঁওড় ও বিল জাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যর ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ।
আমাদের গ্রামে মানুষের চোখে এমন ভুরি ভুরি জলাভূমি দেখা মিললেও তাদের কাছে এটা জলাভূমি হিসেবে পরিচিত নয় তাদের কাছে কমনভাবে পরিচিত হলো ডোবা, মজ্জা পুকুর যে পুকুর বা ডোবা দিয়ে তাদের কোন কাজ হয়না। অথচ এই জলাভূমির গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের গ্রামের মানুষের কোন ধারণাই নেই। দেশের নানাপ্রান্তের ভিন্ন ভিন্ন জলাভূমি জীবনে অভ্যস্ত জনজীবনের কাছে জলাভূমির ব্যঞ্জনা ও সম্পর্কগুলো ভিন্ন ভিন্ন। তারপরও দেশজুড়ে জলাভূমির একটি গণ সংজ্ঞা আছে। জলাভূমি মানে ‘জলাভূমি আশ্রিত জীবনপ্রবাহ’। কেন আজ দেশজুড়ে জলাভূমিসমূহের করুণ অবস্থা? আমার মতে প্রধান কারণ হলো, জলাভূমির বিষয়ে আমরা অবগত না, ধারনা না থাকা, জলাভূমির গুরুত্ব না বোঝা ইত্যাদি। এরপর হচ্ছে জলাভূমির গণ সংজ্ঞা। দেশের জলাভূমিগুলো সম্পর্কে একবারেই না জেনে, না বুঝে, সেই জীবনের সঙ্গে কোনোভাবেই একাত্ম না হয়ে গায়ের জোরে ‘জলাভূমি উন্নয়ন কি সংরক্ষণ’ তো করছিই না উল্টো ভরাট দখলের মিছিলে শামিল হচ্ছি। এখনো আমরা জলাভূমিকে ‘পতিত’ নিচু ভূমি বা অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করি। গায়ের জোরে দখল, নিয়ন্ত্রণ ও দূষণ করি। লণ্ডভণ্ড করে দিই।
পরিশেষে বলতে চাই- পরিবারের প্রতি যেমন আমরা যত্নবান হয়ে পরিবার কে সুরক্ষিত রাখি তেমনি আমাদের পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে রাখতে হলে জলাভূমি রক্ষায়ও আমাদের যত্নবান হতে হবে। এ জন্য দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তাই আসুন আমরা জলাভূমি রক্ষা করি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি