সরস্বতী পূজা: বাঙালির আবেগ এবং ভালোবাসার নাম
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:৫১
শীতের সকালে ঠান্ডার আমেজ চারিদিকে। কুয়াশায় আচ্ছন্ন সূর্য উঁকি দিচ্ছে একটু একটু করে। কিন্তু এর মাঝেও সাত সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে শিক্ষার্থীরা তাদের মনের আশা আকাঙ্ক্ষা জানাতে মন্দিরে ছুটে যায়। কারণ বছর ঘুরে আবারও এলো বাঙালির অন্যতম ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা। ভোরের আলো ফুটতেই হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সরস্বতী পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
প্রত্যেক বছর বিদ্যা ও সংগীতের সহিত দেবী সরস্বতীর আরাধনা করে থাকে শিক্ষার্থীরা। এই দিন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ একসাথে একত্রিত হয়ে মায়ের আরাধনা করে থাকে। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কমতি থাকে না। আর তাই সরস্বতী পূজা রূপ নিয়েছে বাঙালির আবেগ এবং ভালোবাসায়।
সরস্বতী পূজা কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়, এটি জ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার প্রতীক। বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আরাধনা মূলত অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূর করে সমাজকে আলোকিত করার এক অনন্য প্রয়াস। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, পরিবারে এবং সমাজে এই পূজার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু এই সরস্বতী পূজার বিশেষ মাহাত্ম্য আছে।
মূলত মা সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী-সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করে থাকতেন বলে জানা যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর আমলে প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে পাঠশালায় ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াতকলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। তখনকার সময় পাঠশালায় শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজার আয়োজন করতো। গ্রামাঞ্চলে এই প্রথা বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। অন্যদিকে শহরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সরস্বতীর প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করতেন।
মা সরস্বতী বিদ্যার দেবী হলেও মায়ের নামের মাঝেও রয়েছে ভিন্নতা। মায়ের নামের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ‘সরস’ শব্দের অর্থ হলো জল। সুতরাং সরস্বতী শব্দের অর্থ হলো জনবতী বা নদী। অনেক পণ্ডিতরাই মনে করেন দেবী সরস্বতী প্রথমে ছিল নদী। পরে তিনি দেবী হিসেবে পূজিত হন। এর বাইরেও মায়ের আরেক নাম বীণাপানি।
হাতে বীণা ধারণ করেছেন বলেই তার অপর নাম বীণাপাণি। বীণার সুর মধুর।পূজার্থী বা বিদ্যার্থীর মুখনিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর হয় এবং জীবনেও মধুর সংগীতময় হয় এ কারণেই সরস্বতীর হাতে বীণা।
তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এই পূজার বিসর্জন দেখতে আসত। পূজার আরম্ভরকে কেন্দ্র করে দুই ঘণ্টা আতসবাজিও পোড়ানো হত। এরপর আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। এইদিকে শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায়। সরস্বতীর পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়।
এইদিন মা সরস্বতীর পূজাকে কেন্দ্র করে বেশকিছু উপচার সামগ্রীর গুরুত্ব বহন করে থাকে। যেমন: অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। পূজার জন্য বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুলও প্রয়োজন হয়। এইদিনে শিক্ষার্থীরা বিদ্যা, জ্ঞান, বুদ্ধি লাভের আশায় মা সরস্বতীর চরণে নিজেদের পুস্তক সমর্পিত করে থাকে। এছাড়াও এই দিনটি বিশেষ করে ছোটদের জন্য খুব আনন্দের সহিত পালন করা হয়।এইদিনে মা সরস্বতীকে সামনে রেখে ছোটোদের হাতেখড়ি দিয়ে পাঠ্যজীবনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। মা সরস্বতী পূজার আরো একটি বিশেষত্ব হলো অঞ্জলী প্রদান। যা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনে আবেগময় ভালোবাসার দিন হয়ে থাকে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের দল বেঁধে অঞ্জলি দিতে দেখা যায়।
যেহেতু সরস্বতী বিদ্যা, জ্ঞান এবং ললিতকলার দেবী, সেই কারণে সাধারণত সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই উৎসব অনেক বড় করে পালন করা হয়। সাধারণত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সরস্বতী পূজার আগের দিন থেকে সরস্বতী পূজার পরদিন দই, খই, মিষ্টি, কলা, বাতাসা, ক্ষীর দিয়ে মাখা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে।
সরস্বতী পূজায় ছোট থেকে বড় সবার মধ্যেই আবেগ ভালোবাসাময় মূহূর্ত কাজ করে। প্রথমত ছোটদের এবং বড়দের পূজার আনন্দ বয়সভেদে ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। তাদের পূজার আবেদন এক হলেও উদযাপনের ধরণ আলাদা।
ছোটদের পূজার আনন্দের মধ্যে দেখা যায়, পূজার দিন নতুন বা পছন্দের পোশাক পরার আনন্দ ছোটদের জন্য সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। বিশেষ করে মেয়েরা হলুদ শাড়ি বা পোশাক পরে আনন্দিত হয়। সেইসাথে মিষ্টি, নারকেল নাড়ু, খিচুড়ি ও অন্যান্য প্রসাদ খাওয়ার জন্য ছোটরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। ছোটদের আকর্ষণে থাকে। চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, কুইজ ও নৃত্য প্রতিযোগিতার দিকে। যা তাদের পূজার আনন্দ বাড়িয়ে তোলে। ঘরের বয়জ্যেষ্ঠ এবং তাদের বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে ঘুরে বেড়ায়, প্রতিমা দেখে ও আনন্দ উপভোগ করে।
অন্যদিকে বয়সের তারতম্যে কারণে বড়দের পূজার আনন্দে কিছুটা পরিবর্তন আসে। বড়রা ক্লাব ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূজার আয়োজন, মণ্ডপ সাজানো, আলোকসজ্জা, রঙিন আলপনা ও দেবী আরতি ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত থাকে। পূজা উপলক্ষে পুরনো বন্ধু, সহপাঠী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দ পায়। পূজা উপলক্ষে আয়োজিত সংগীত, নাটক আয়োজন এবং উপভোগ করে।
শুধু ছোট-বড় নয়,প্রজন্মভেদেও সরস্বতী পূজার আনন্দের মধ্যেও এসেছে ভিন্নতা। পুরাতন প্রজন্ম এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে সরস্বতী পূজার উদযাপনের ধরন এবং মানসিকতায় কিছু পার্থক্য দেখা যায়। এই পার্থক্য ঐতিহ্য, প্রযুক্তি এবং সমাজের পরিবর্তনের সাথে গভীরভাবে জড়িত।
পুরাতন প্রজন্মের সরস্বতী পূজার দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় ঐতিহ্যের প্রতি মনোনিবেশ করতো। সরস্বতী পূজায় রীতি-নীতিকে গভীরভাবে অনুসরণ করত। মন্ত্রোচ্চারণ, পুষ্পাঞ্জলি, এবং আরতির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিত। পূজার পরিমিত আয়োজন আয়োজন ছিল সাদামাটা কিন্তু আন্তরিক। সৃজনশীলতার চেয়ে ধর্মীয় ভাবনা ছিল বেশি প্রাধান্য। একত্রিত হওয়া মানে পরিবারের সদস্য, আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে সময় কাটানো। পূজা একটি সামাজিক বন্ধনের উৎসব ছিল। গান, নাটক বা কবিতা আবৃত্তি ছিল বিনোদনের মূল উৎস।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সরস্বতী পূজা নিয়ে ভাবনা চিন্তাতে এসেছে বেশকিছু পরিবর্তন। নতুন প্রজন্ম ঐতিহ্যের পাশাপাশি পূজায় আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করে, যেমন ডিজাইনার প্রতিমা, থিম ডেকোরেশন, ডিজে মিউজিক ইত্যাদি। পূজার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা, লাইভ স্ট্রিমিং, এবং ই-আলপনা এখন সাধারণ হয়ে গেছে। ডিজে পার্টি, ফ্যাশন শো এবং প্রতিযোগিতা এখন পূজার একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে। পরিবার বা প্রতিবেশীদের চেয়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে সময় কাটানো এবং আড্ডার প্রতি বেশি জোর।
এই আধুনিকায়নের মূল রহস্য হলো পুরোনো দিনের তুলনায় জীবনযাত্রা এখন দ্রুতগামী, তাই পূজার ধরনে আধুনিকতার ছাপ পড়েছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নতুন প্রজন্মের পূজার রীতিতে প্রভাব ফেলেছে। পুরোনো প্রজন্ম পূজাকে বিদ্যার আরাধনার সাথে গভীরভাবে যুক্ত রাখলেও, নতুন প্রজন্ম সেটাকে কিছুটা বিনোদন এবং সামাজিকীকরণের দিকেও নিয়ে গেছে।
তবে, পার্থক্য থাকলেও উভয় প্রজন্মের মধ্যে পূজার মূল ভাবনা, অর্থাৎ বিদ্যার দেবী সরস্বতীর আরাধনা, আজও একীভূত। শুধু প্রকাশভঙ্গি সময়ের সাথে বদলে গেলেও, এখনো একই আবেগ এবং ভালোবাসা রয়ে গিয়েছে।
এইদিকে সময়ের তাগিদে, জীবিকার প্রয়োজনে অনেক শিক্ষার্থী চলে যায় কর্মজীবনের দুনিয়ায়, আর কেউ কেউ চলে দেশের বাইরে অথবা নিজের জেলার বাইরে। তখন সরস্বতী পূজা তাদের কাছে নস্টালজিয়ার এক বিশাল অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
শিক্ষাজীবনে পূজার দিন মানেই ছিল স্কুল-কলেজে সাজসজ্জা, প্যান্ডেল ঘোরা, বন্ধুদের সঙ্গে মজা করা, নতুন পোশাক পরা, প্রসাদ খাওয়া এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করা এইসব কিছু স্মৃতিতে রোমন্থন করে বেড়ায়। তবে চাকরির ব্যস্ত জীবনে এসে তাদের কাছে এই উৎসবের অনুভূতি কিছুটা বদলে গেছে।
অনেকেই এই দিনে শৈশবের স্মৃতিচারণ করেন, বিশেষ করে স্কুল-কলেজ জীবনের আনন্দের মুহূর্তগুলো মনে করে।যারা বাইরে বা অন্য শহরে চাকরি করছেন, তারা পূজার দিনটিতে পুরনো বন্ধুদের বা পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন, পুরোনো ছবি দেখেন। কেউ কেউ আফসোস করেন যে এখন আর আগের মতো সরস্বতী পূজার আনন্দ উপভোগ করা হয় না, সময়ের সঙ্গে জীবনের গতি বদলে গেছে।সামাজিক মাধ্যমে অনেকে পূজার ছবি শেয়ার করেন, পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করেন।
কিন্তু এতসব কিছু হয়ে গেলেও পূজার আনন্দটা কোথাও গিয়ে যেন ফিকে হয়ে যায়নি। বয়সের তারতম্যে থেকে শুরু করে প্রজন্ম বদলে গেলেও এখনো বাঙালির পুজো আসলে এক জায়গায় হয়। জীবিকার তাগিদে অফিস আদালত থেকে ছুটি না পেলেও সময় বের করে পূজা মণ্ডপে যান বা পরিবার পরিজন বন্ধুদের সঙ্গে ছোটখাটো গেট-টুগেদার করেন। সব মিলিয়ে, পুরাতন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা সরস্বতী পূজাকে শৈশব ও কৈশোরের এক মধুর স্মৃতি হিসেবে দেখেন, যা এখনো তাদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে আছে, যদিও সময়ের অভাবে আগের মতো উদযাপন করা সম্ভব হয় না। আর যাদের ছুটি থাকে, তারা পরিবারের সঙ্গে পূজায় অংশ নেন, বিশেষ করে সন্তানদের নিয়ে স্কুল-কলেজের পূজা দেখতে যান।
রাত পোহালেই শিক্ষার্থীরা আবারো সরস্বতী মায়ের সাথে উৎসবে মেতে উঠবে। ভক্তদের প্রত্যাশা থাকে প্রত্যেকবছর মা সরস্বতী এই ধরাধামে এসে তাদের বিদ্যাশক্তিতে উজ্জীবিত করে তোলুক এবং অশুভ জ্ঞান দূর করে সবাইকে জ্ঞানের আলোতে পরিপূর্ণ করুক। তাই প্রত্যেক বছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজাকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন থিমের আয়োজন করা হয়েছে।
তবে, আধুনিক সমাজে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও প্রযুক্তির বিকাশের ফলে বিদ্যার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কিছুটা কমে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষাকে কেবলমাত্র একটি পেশাদার দক্ষতা হিসেবে দেখা হয়, যা প্রকৃত বিদ্যার আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সরস্বতী পূজা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃত শিক্ষা কেবল ডিগ্রি বা চাকরি পাওয়ার জন্য নয়, বরং এটি ব্যক্তিত্ব গঠনের এবং সমাজের কল্যাণে ব্যবহারের এক শক্তিশালী হাতিয়ার।
সরস্বতী পূজা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরও এক সুন্দর নিদর্শন, কারণ বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। এ ধরনের উৎসব আমাদের সমাজকে আরও ঐক্যবদ্ধ করে তোলে এবং সংস্কৃতির বহুমাত্রিক সৌন্দর্যকে তুলে ধরে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এএসজি