আমাদের দুঃখী ছেলেমেয়েগুলো!
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:১৭ | আপডেট: ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:৩১
বড় দু:খী আমাদের ছেলেমেয়েগুলো!
তারা বেড়ে উঠছে চিন্তার বিস্তৃতিহীন, দ্বন্দ্বহীন, এক-রৈখিক এক জীবন নিয়ে। তুমুল হৈহল্লা প্রতিদিন অথচ ভেতরে ভেতরে নির্জীব, একাকী। ‘আমির আবরণে’ ঢাকা তাদের ভাবনার আকাশ।
ওদের কাছে পড়াশোনা মানে জিজ্ঞাসাবিহীন, ভাবলেশহীন এক নিস্তরঙ্গ ভ্রমণের মতো। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মানে- একটা সনদ, একটা ডিগ্রি, একটা কিছু করে জীবন চালানো, ক্যারিয়ার, উপার্জন ইত্যাদির জন্য নিজেকে তৈরি করার কারখানা।
ওরা জানে না, ক্লাসের চারদেয়ালের বাইরে অদ্ভুত সৌন্দর্যে লেপা একটা পৃথিবী আছে… ওদের দৃষ্টির সীমানায় এক ভারী, অন্ধকার পর্দা টানা। দূরের আলো আসেনা, দূরের বাতাস লাগেনা ওদের চিন্তার উঠোনে। অথচ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘জগৎকে আমরা মন দিয়া ছুঁই না বই দিয়া ছুঁই।’
সিলেবাসের বাইরে ওরা তাকানোর জো নেই, ওরা জানে না জীবন সংলগ্ন আশ্চর্য সুন্দর কতকিছু যে এখনো বইপত্রে লেখা হয় নি। জানালা দিয়ে তাকালেই আকাশ, দরজা মাড়ালেই সুঘ্রাণ মাটি, মায়াঘাসের পথ, বাহু ছড়ানো গাছ-গাছালি, বিকেলের বাতাস, সন্ধ্যার মেঘ-আমাদের ছেলেমেয়েগুলো সে রূপ, ঐশ্বর্য দেখার সুযোগ পায় না! দেখতে চায় না!
কত দু:খী এরা!
চাঁদের পাশে থাকা ধ্রুবতারা, দিন জ্বলা সূর্য, পূর্নিমা রাত, নক্ষত্র, চন্দ্র গ্রহণ, অবসর, অবকাশ, চুপচাপ মহাকাশ— কিছুই তাদের হৃদয় ছুঁতে পারে না! অথচ প্রফেসর ড. তপোধীর ভট্রাচার্য্য বলেন, ‘পথ চললেই হবে না, গন্তব্যও জানতে হবে’।
ওরা অপেক্ষা জানে না, অপেক্ষার সৌন্দর্য, অপেক্ষার যন্ত্রণা কিছুই লাগে না তাদের গায়ে। প্রেম, প্রাপ্তি, আক্ষেপ, স্মৃতি- তাদের অভিধানে অন্যরকম সংজ্ঞা নিয়ে হাজির হয়। মানুষে মানুষে টান, মায়া, মোহ, মুগ্ধতা, বাসনা, আর্তি, আকুলতা, উৎকন্ঠা ওরা বুঝার সুযোগ পায় না। পাঠ্যবই, গাইড, টিউটর, কোচিং, সাজেশন এসবই তাদের দিনমানের সঙ্গী। এরা সফলতা চায়, সার্থকতার মানে বুঝে না। ওরা সেলিব্রেটি হতে চায়, জীবনকে সেলিব্রেশন করার সুযোগ খোঁজে না।
বড়ো ভীতু এরা! ব্যর্থতাকে বড় ভয় তাদের। কেবলই বন্ধুর মুখ সামনে চায়, কেবলই নিজের মতো করে অন্যকে চায়। বিচিত্র মত, পথের নানারঙা রঙধনু ওদের দৃষ্টির সীমানা এড়িয়ে যায়।
আমাদের ছেলেমেয়েগুলো বড় কপালপোড়া! এই নাগরিক কোলাহল, অস্থিরতা, দহন, পীড়ন ওদের ভাবজগতে কোন ছায়া ফেলে না! ওরা নিজের ভেতরে নিজেরাই বন্দী হয়ে আছে। ওদের শিক্ষাজীবন রূপ-রস-জৌলুসবিহীন, কেবল নিজেকে একটি চাকুরির উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রয়াসমাত্র। খেলার মাঠ, বাগানের সূর্যমুখী, লাইব্রেরির পুরনো বই তাদের খুব একটা টানে না।
এই জোয়ার-ভাটার জীবন, এই আশা-হতাশার জীবন, এই প্রেম-বিরহের জীবন দু’হাত কচলে দেখার সুযোগ তারা নিল না! নেয় না! তারা ‘না জানে বেদন/ না জানে রোদন/না জানে সাধের যাতনা যত’।
ওদের স্বপ্ন আগলে রাখে ‘সিলেবাস’ নামক এক বন্দীশালা, আশার বিপুল তরঙ্গের ওপর এ এক অকল্পনীয় নিয়ন্ত্রণ যেন। সেমিস্টার, এসাইনমেন্ট, পরীক্ষা, গ্রেড ইত্যাদি তাদের ভাবনার দুয়ারে পাহারা বসায়। সমাদরহীন, করুণ, কাতর তাদের দিনমান। বাইরে ওদের দৃষ্টি যায় না, ওদের স্বপ্ন আটকে থাকে সুনির্দিষ্ট একটা আঙিনায়। ওরা না জানল অকৃপণভাবে দান করার আনন্দ, না শিখল নি:স্বার্থভাবে গ্রহণের স্বর্গসুখ।
ওরা কাঁটা ছাড়া গোলাপ চায়, স্রোতহীন নদী চায়। খুব সহজে সাফল্য চায়। খ্যাতি চায়, মান-যশ চায়। রজনীকান্ত বলেন, ‘ওরা—চাহিতে জানে না, দয়াময়!/চাহে ধন, জন, আয়ুঃ,/আরোগ্য, বিজয়!/করুণার সিন্ধু-কূলে,বসিয়া,/ মনের ভুলে/এক বিন্দু বারি তু’লে,/ মুখে নাহি লয়;’
অচেনা বাতাস বার বার নিভিয়ে দিতে চায় তাদের ভীরু প্রদীপ। অমলকান্তির মতো রোদ্দুর হতে কেউ চায় না কেউ হতে চায় না হতে দেবদারু । তারা কেবলই অন্ধকারে হাত পাতে। কাকে যেন খোঁজে, অথচ ‘মোহমেঘে’ তারে ‘দেখিতে’ দেয় না।
কথা হলো, শিক্ষা গ্রহণকে সনদ প্রাপ্তি আর জীবিকা অর্জনের ঘোরটোপ থেকে মুক্তি দিতে পারলেই এর প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করতে পারে আমাদের ছেলেমেয়েরা। তখনই তারা পৌঁছাতে পারে জীবনের গভীরে। আঁধার পেরিয়ে দেখা পেতে পারে দ্বীপান্বিত ভোরের।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগ প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এএসজি