বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি হৃদয়ে ধারণ করতে হবে
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:০৮
বাংলা ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা। তাজা রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের মুখের ভাষা। যে ভাষার অধিকার আদায় করতে গিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জাব্বার সহ নাম না-জানা অগণিত মানুষ প্রাণ দিয়েছিলো। তাই এ ভাষা আমাদের কাছে প্রাণের ভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের তাঁজা রক্ত দিয়ে যারা আমাদের বাংলা ভাষাকে করেছে মর্যাদাপূর্ণ তাদের জানাই সালাম।
রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের এই ভাষা আজ আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। আমরা ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জানি। পুরো পৃথিবী এখন বাংলা ভাষাকে জানে। এরপরেও আমরা কেন জানি এই ভাষার সম্মান আর মর্যাদা রাখতে পারছি না। ৫২ সালে বুকের রক্ত দিয়ে এ ভাষাকে যারা মহান করেছে আজ আমরা যেন তাদের সেই কর্মের সম্মান রাখতে পারছি না। আমরা এখন বাংলা ভাষাকে অপমান আর অপদস্ত করছি প্রতিনিয়ত। আমার দেশে কিছু কিছু অতিশিক্ষিত রয়েছে যারা বাংলার মাঝখানে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলেন আজকাল। এবং এটাই না-কি আধুনিকতা। কথায় কথায় কয়েকটা ইংরেজি বলে বাংলাকে যেমন ছোট করা হয়, তেমনি যারা বলে তারা নিজেকে বড় মনে করে। আমরা ফেসবুকে এখন বাংলায় লিখি না। লিখি ইংরেজিতে বাংলা। ঘুরেফিরে আমাদের অক্ষর থাকে ইংরেজি। আমরা আ, ই, ক, খ এখন ভুলে গিয়েছি। ধ ন প ফ আমাদের কাছে এখন পরিচিত শব্দ। এখনও অনেক লোক রয়েছে যারা বাংলা ভাষায় কয়টি অক্ষর রয়েছে সেটিও জানে না। কোনটা স্বরবর্ণ আর কোনটা ব্যঞ্জনবর্ণ সেটাও জানেন না অনেকেই। ফেসবুকেই এসব ভিডিও আবার ভাইরাল হয়।
শুধু তাই নয়, বাংলা সম্পর্কে কম জানা হলেও ইংরেজি সম্পর্কে জানা থাকা না-কি জরুরী! অনেকেই ইংরেজি ভালো শেখার জন্য নানান নামী-দামী প্রশিক্ষণও করে থাকেন। এখনকার শিক্ষার্থীদের বাংলা বানান সম্পর্কে ধরণা না থাকলেও ইংরেজি গ্রামার সম্পর্কে প্রচুর ধারণা থাকে। বাচ্চারাও ইংরেজিতে অভ্যস্ত হোক এটাই পরিবারগুলো চায়। এটাই হচ্ছে আমাদের বাঙ্গালিত্ব।
আজ মনে হড়ে যাচ্ছে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সেই কবিতাটি। যেখানে তিনি বলেছেন, ছেলে আমার খুব ‘সিরিয়াস’ কথায়-কথায় হাসে না/জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসেনা।/ইংলিশে ও ‘রাইমস’ বলে ‘ডিবেট’ করে, পড়াও চলে/আমার ছেলে খুব ‘পজেটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না/জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।
আসলে এমনই হয়ে পড়েছে আমাদের ভাষা। যেখানে আমরা নিজেরাই এখন অন্যভাষাকে প্রাধান্য দিচ্ছি। ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে, এই আমাদের জন্যই কি ৫২’র ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো! বড় অদ্ভুত আমরা। আজ আমরা আমাদের ভাষা ভুলে যেতে বসেছি। এখন শুদ্ধ বাংলার সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের আঞ্চলিক ভাষাও। আঞ্চলিক ভাষায় বলতে গেলে একটু অতিশিক্ষতরা আবার ক্ষ্যত বলেও সম্বোধন করেন আজকাল। অথচ আঞ্চলিক ভাষাটাও আমাদের বাংলা ভাষার একটা অংশ। এটাও আমাদের মায়ের ভাষা।
শুধু তা-ই নয়, আমরা এখন আমাদের সংস্কৃতিটাও পরিবর্তন করে ফেলেছি। বাংলা ভাষার সংস্কৃতি, বাংলা সিনেমা, বাংলা নাটক, বাংলা গান, বাংলা গল্প, বাংলা কবিতা, বাংলা উপন্যাস এমনকি বাংলা প্রবন্ধও আমাদের কাছে এখন বিরক্ত লাগে। আমরা ইংরেজি উপন্যাস আর তামিল সিনেমা দেখি। আর বেশি আধুনিক হলে হলে হলিউড ছাড়া কিছুই দেখি না। আর রবিন্দ্রনাথ, নজরুলের চাইতে আমাদের কাছে শেক্সপীয়রের বই বেশি গ্রহণযোগ্য। এমনটাই এখন বাংলার চিত্র। আসলে এটা আমার আপনার একার কারণে নয়্ এটা আমাদের গোটা সমাজ ব্যবস্থার কারণে। আমরা অন্য সংস্কৃতি আমার দেশে প্রবেশ করতে দিয়েছি। অথচ আমার দেশের সংস্কৃতি অন্য কোথাও প্রবেশ করাতে পারি না। আমরা আমাদের টিভি চ্যানেল গুলো আমাদের দেশের চ্যানেল হাতে গুনে যা পাবো তার দিগুণ পাব বিদেশি চ্যনেল। যার কারণে শিশু-কিশোররা এখন বিদেশি চ্যানেল এবং ওই ভাষাতেই আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে।
আমরা ছোটবেলা শুক্রবার বসে থাকতাম বাংলা সিনেমা দেখার জন্য। খেলতে যেতাম না। অথচ এখনকার ছেলে-মেয়েরা বাংলা সিনেমাতো দূরের কথা বাংলা চ্যানেলটাও দেখতে চায় না। অবারিত চ্যানেল চলে আসায় আমরা ভিন্ন সংস্কৃতিতেও আসক্ত হয়ে পড়ছি। এই যে বাংলার প্রতি অনিহা এবং অবহেলা। এমন হতে থাকলে একসময় এই ভাষাকে নিয়ে গর্ব অহংকার করতেও ভুলে যাবো আমরা।
এই মাস বইয়ের মাস। সারাদেশে এই মাসে অমর একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। হাজার বই এই মাসে প্রকাশিত হয়। লেখকরা তাদের সেরা লেখাগুলো নিয়ে বই বের করেন মেলাকে কেন্দ্র করে। এসব বই কিনতে মেলায় আসেন পাঠকরা। দূরদুরান্ত থেকে পাঠকরা আসেন পরিবার পরিজন নিয়ে। কেউ বই কিনেন, বই পড়েন। কেউ-বা আবার পরিবার নিয়ে ঘুরতেও আসেন। তবে বইমেলার জৌলুসটা আগের মতো নেই। মেলায় মানুষের সমাগম থাকলেও পাঠক কিংবা ক্রেতা বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
তাছাড়া এখন পাঠকের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। বর্তমান সময়ে পাঠকের চাইতে বেশি আছেন লেখক। যার কারণে লেখকরাই লেখকদের বই কিনছে। আর পরিচিত ছাড়া খুব বেশি অন্যকারও বই কেনা হয় না। বিশেষ করে নতুন লেখকদের বইতো লেখকের বন্ধু এবং পরিবারের লোকজন ছাড়া কেউ ধরেও দেখেন না। হাতেগুনা নামকরা কয়েকজন লেখকের বই পাঠকরা কিনেন। এছাড়া যার যত বেশি পরিচিত লোক রয়েছে তার ততবেশি বই বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে বইয়ের মানও যাচাই করতে হয় না।
তবে এসবের চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে ভাষা। আমরা আমাদের ভাষাকে সম্মান করলে, এসব আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যবে। তাই আমাদের প্রয়োজন বাংলাকে প্রাধান্য দিয়ে সবকিছু করা। বাংলার সাথে যেন অন্য কোন ভাষা মিশ্রিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলা আমাদের গর্ব, বাংলা আমাদের অহংকার।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি