Monday 31 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আঞ্চলিক ভাষা বাংলার অলঙ্কার স্বরুপ

অলোক আচার্য
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৩৯ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৪১

ভাষার একটি সৌন্দর্য বা বৈচিত্র্যতা হলো আঞ্চলিক ভাষা। শুদ্ধ ভাষা চর্চার কঠোরতায় আঞ্চলিক ভাষা অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পরেছে। কিন্তু ভাষার বৈচিত্র্যতায় এবং আকর্ষণে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার অতুলনীয়। যা আমাদের মনোযোগ ধরে রাখে, নতুনত্বের স্বাদ দেয় এবং পরিতৃপ্তি দেয়। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষের নিজস্ব ভাষা আছে। ভাষা মানুষের কাছে মা ও মাতৃভূমির মতোই গুরুত্বপূর্ণ, শ্রদ্ধেয় এবং ভালোবাসার। সেই ভালোবাসার কারণেই পাকিস্তানের চাপিয়ে দেয়া উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেয়নি বাঙালি। ভাষা জাতির শেকড়ের খোঁজ দেয়। আমাদের মধুর বাংলা ভাষা আমাদের জাতিসত্ত্বার পরিচয় বহন করে। ভূখন্ড, পতাকা, ভাষা এগুলো একটি জাতির অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত। ভাষার মাধ্যমেই আমাদের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। ‘যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। দেশ ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুড়ায়, নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।’ কবি আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’ কবিতার এই চরণগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদের মাতৃভাষা, মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে অথচ বাংলা ভাষার প্রতি মমতা নেই, তাদের বংশ ও পরিচয় সম্পর্কে কবির মনে সন্দেহ জাগে। আজ এই যে বাংলায় কথা বলার অনুভূতি, বাংলায় সাহিত্য চর্চার অনুভূতি তা প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষীর কাছেই আবেগের, শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার। এই ভাষার ভাব আবার অঞ্চলভেদে একটু আলাদা হয়। সেটা জেলাভেদে বা কোনো অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়। এসব উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা বলে পরিচিত। আঞ্চলিক ভাষাকে অনেক সময় গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তবে আজ আমরা এসব উপভাষার গুরুত্ব উপলদ্ধি করছি। এর বৈচিত্র্যতার গুরুত্ব বুঝতে পারছি। আমরা বুঝতে পেরেছি এসব উপভাষাও রক্ষা করতে হবে। মনের আবেগ প্রকাশে বিভিন্ন উপভাষা অঞ্চলভেদে আরও শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে। এসব আঞ্চলিকতার বৈচিত্র্য শুনতেও বেশ ভালো লাগে।

বিজ্ঞাপন

শুদ্ধ ভাষার পাশাপাশি এসব আঞ্চলিক ভাষাও যথেষ্ট গুরুত্বের দাবিদার। আঞ্চলিক ভাষা গুরুত্বপূর্ণ বা আঞ্চলিক ভাষাকেও টিকিয়ে রাখতে হবে এর নিজস্ব গুরুত্ব বিবেচনায়। বাংলা ভাষায় এসব আঞ্চলিক ভাষারও যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এর ধরণ এবং বৈচিত্র্যতা। ভাষা থেকে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। সেই সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য আনে ভাষার আঞ্চলিকতা। বহু আঞ্চলিক ভাষায় গান রয়েছে যা অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং শ্রুতিমধুর। আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব মূলত দুটি কারণে। প্রথমত: প্রথমে আঞ্চলিক ভাষাতেই শিশু বড় হয় এবং দ্বিতীয়ত: এসব আঞ্চলিক ভাষা আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতা বজায় রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের টিভি নাটকগুলোতে এসব আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে নাটকের বৈচিত্র্যতা এবং দর্শকদের আগ্রহ লক্ষণীয়। আঞ্চলিক ভাষায় যে সকল গান রয়েছে সেগুলোরও রয়েছে ব্যপক জনপ্রিয়তা। তবে কিছু ক্ষেত্রে যে ভাষার অপব্যবহার হচ্ছে তা অস্বিকার করা যায় না। সেটুকু বাদ দিলে একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করার কারণে নাটক দর্শকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পাবনা, রাজশাহী, বরিশাল, নোয়াখালী বা সিলেটের ভাষা ব্যবহার আজ আমাদের দেশে ব্যপক জনপ্রিয়। এর বাইরেও বহু আঞ্চলিক ভাষা ছিল বা কিছুটা এখনো আছে। নতুন প্রজন্মের কাছে ক্রমেই তা অজানা হয়ে উঠছে। কারণ পরিবারগুলোতে শিশুকাল থেকেই জোর দেওয়া হয় প্রমিত ভাষার ওপর এবং অবহেলা করা হয় আঞ্চলিক ভাষার। অথচ এই উপভাষাগুলো একজন মানুষের পরিচয় বহর করে। সে কোন অঞ্চলের তা তার ভাষা থেকেই ধারণা লাভ করা যায়। আঞ্চলিক ভাষার প্রতি মমত্ববোধ থেকে এসব অঞ্চলের কবি, সাহিত্যিক ও গীতিকাররা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে রচনা করেছেন কবিতা, গল্প, গান। সুর করেছেন। সেসব সারাদেশেই জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো আঞ্চলিক ভাষা। এটি আমাদের ভাষার প্রাচুর্য। এই প্রাচুর্যতা যদি হারিয়ে যায় তাহলে আর বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বিজ্ঞাপন

আঞ্চলিক ভাষার ব্যপকতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং ভালোবাসা এটা প্রমাণ করে যে আঞ্চলিক ভাষা রক্ষায়ও যথেষ্ট জোর দিতে হবে। যদিও আমরা কেবল শুদ্ধ ভাষা ব্যবহারেই মনোযোগ নির্দিষ্ট করেছি। তবে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার সবর্ত্র চোখে পরে না। বরং ভুল বানান এবং উচ্চারণ স্পষ্ট হয়। শুদ্ধ ভাষা চর্চাই যে সর্বোতভাবে সম্ভবপর হচ্ছে না। পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকেই মা এবং আশেপাশের মানুষের মুখে নানা ভাষা শুনে শিশু ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেটাই তার মাতৃভাষা। সেই ভাষা চর্চার মধ্যে দিয়েই শিশু বড় হয়ে উঠতে থাকে। শিশু জন্ম নেয়ার পর মায়ের মুখের ভাষা শুনেই সে বড় হয়। সেই ভাষাও আঞ্চলিক ভাষা। পরে সে শুদ্ধ ভাষা শেখে। অর্থাৎ শুরুটা তার নিজ অঞ্চলের ভাষা দিয়েই হয়। তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আঞ্চলিক ভাষা হলো বাংলা ভাষার সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য আমাদের বাংলাকে আরও মাধুর্যমন্ডিত করেছে। এসব আঞ্চলিক ভাষার কথার ধরণ, উচ্চারণ, ভঙ্গি সবকিছু এক থেকে অন্য ভিন্ন হয়। এসব আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে যে ভালোবাসার মাধূর্য রয়েছে তা আর কোথাও দেখা যায় না।

ভাষার অধিকার আদায়ে আমাদের গৌরবমন্ডিত ইতিহাস থাকলেও বিদেশি ভাষা চর্চার প্রতি আমাদের আগ্রটাই বেশি। বাংলা ভাষা চর্চা হলেও তা শুদ্ধতার ওপরই বেশি জোর দেয়া হয়। অথচ আঞ্চলিক ভাষাগুলো টিকিয়ে রাখাও যে আমাদেরই দায়িত্বের মধ্যে পরে তা ভুলতে বসেছি। মানবদেহের পুরো শরীর যদি হয় বাংলা ভাষা তাহলে তার সৌন্দর্যের অলংকার এসব আঞ্চলিক ভাষা। একবার ভাবুন আজ আমরা নোয়াখালি, রাজশাহী, বরিশাল, পাবনা বা চট্টগ্রামের ভাষা খুব সহজেই আলাদা করতে পারি। আরও অবাক করা ব্যপার হলো যে, এসব আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে সেই অঞ্চলের মানুষকেও আলাদা করা সম্ভব হয়। যেমন- একজন রাজশাহী অঞ্চলের মানুষকে সহজেই তার অঞ্চলের ভাষা দিয়েই চেনা সম্ভব। সেই অঞ্চলের ভাষা পরিচিত হচ্ছে। এলাকাভিত্তিক নিজস্ব ভাষা সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। নিজ সন্তানকে অবশ্যই ভাষার শুদ্ধতা সম্পর্কে সঠিক পথ দেখাতে হবে। কারণ শুদ্ধ ভাষা সর্বত্র প্রয়োগ করা জরুরী। সেই সাথে নিজ শেকড়ের সন্ধানও দিতে হবে। সেই শেকড় হলো তার নিজ অঞ্চলের ভাষা। আঞ্চলিক ভাষাও আমাদের গর্ব। ভাষা রক্ষা করার যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনিভাবে প্রয়োজন রয়েছে এসব আঞ্চলিক ভাষা রক্ষা করার।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

অলোক আচার্য আঞ্চলিক ভাষা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

এবারও বন্ধ শিশু পার্ক
৩১ মার্চ ২০২৫ ১৫:০৭

আরো

সম্পর্কিত খবর