Monday 24 Feb 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলা নাটক-সিনেমা: প্রয়োজন সংস্কার

সুমন বৈদ্য
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:০৩

সিনেমা- নাটক মানুষের কথা বলে। মানুষকে কখনো হাসায় আবার কখনো কাঁদায়। সিনেমা-নাটক এমন এক বৈচিত্র্যধর্মী বিষয়, যেখানে মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। এই বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলতে প্রয়োজন হয় ভালো লেখকের, ভালো গল্পের এবং ভালো অভিনেতার।‌ কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। যা রীতিমতো সংস্কারের অভাব।

বর্তমান নাটকের যদি একবার তাকানো হয় তাহলে ওভারেটেড গল্প এবং মাত্রারিক্ত ভিউয়ার্সের পিছনে সময় দেওয়া ছাড়া ভালো গল্পের চাহিদা দিনকে দিন কমেই যাচ্ছে।পাশাপাশি গুণী পরিচালকের ভালো নাটকও নির্মাণ হচ্ছে, কিন্তু গুণী পরিচালকের ভালো নাটকের ভিড়েও দিনে দিনে ওভারেটেড নাটক তৈরি হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

একটা সময় নাটক ছিল পারিবারিক বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। যাকে বলা হতো ড্রয়িং রুম বা পারিবারিক মিডিয়া। হানিফ সংকেত, মোহাম্মদ মুস্তাফা কামাল রাজ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, হুমায়ূন আহমেদ, বৃন্দাবন দাস ,কচি খন্দকার কিংবা সালাউদ্দিন লাভলু এনাদের মতো গুণী শিল্পীদের বিনোদিত নাটকের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে ধারাবাহিক কিংবা প্যাকেজ যেকোনো নাটকই দেখার জন্য পরিবারের সদস্যরা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতো। গল্প, অভিনয়, শৈল্পিক উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিনোদনের পাশাপাশি সেসব নাটকে ছিল সামাজিক বার্তা। যা ছিলো গুণগত মানের স্বর্ণযুগ।

নাটকের নামে ছিলো না কোনো ভাঁড়ামি,ইউটিউবে ট্রেন্ডিং এ থাকার অসুস্থ মন মানসিকতা। তখনকার সময় প্রতিটা নাটকে গল্পের তৎকালীন অবস্থান কিংবা যে গল্পের উপর নির্মিত নাটক সেই গল্পের মূল শেকড়ের বিষয়বস্তু দেখানোর চেষ্টা ছিলো। নাটকগুলোর গল্প ছিল বৈচিত্র্যময়। দর্শক সংখ্যা কম হলেও নাটকের প্রতি সম্মান ছিল বেশি। তবে নাটক দেখা সীমিত ছিল, কারণ ইন্টারনেটের ব্যবহার কম ছিল।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু গুণী শিল্পী এবং গুণী পরিচালকের অভাবে অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে বর্তমান নাটকে। ২০১৬-২০২০ থেকে শুরু ওভাররেটেড নাটকের বিস্তার। এ সময়ের নাটকের অবস্থান আসলে কেমন, কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের নাটকের ভবিষ্যত! হাস্যরস আর ভিউ বাণিজ্যে কি হারাচ্ছে নাটকের শিল্পমান।

আগে নাটকের চিন্তাধারা বিষয়বস্তু ছিলো সাধারণ মানুষের আবেগ এবং ভালোবাসা যা এখনকার বর্তমান প্রজন্মের কাছে নিছকই ব্যবসার বিষয়বস্তু ছাড়া কিছুই নয়।

তখনকার সময়ে নাটকে হাস্যরস গল্পের মধ্যে চরিত্র এবং কাহিনীরও একটা ভালো সংযোজন ছিলো। কিন্তু এখন গ্রামের মানুষ, মফস্বলের মানুষ কিংবা যারা ইউটিউবের দর্শক, তাদের রুচি ও ভিউর কথা চিন্তা‌ করে হাস্যরসাত্মক নাটক নির্মাণ করা হয়। এর মূলে আছে ব্যবসার চিন্তা।

২০২১ সময় থেকে বর্তমান সময়ে ওভাররেটেড নাটকের চূড়ান্ত যুগের আবির্ভাব শুরু।নাটকের মান নিয়ে প্রশ্ন অনেক আগেই উঠেছিল। মানহীন নাটকের কারণে দর্শকেরা দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এবার পড়তি মান, নিম্নমানের গল্প, অভিনয়, অত্যধিক বিজ্ঞাপন বিরতির পাশাপাশি যোগ হয়েছে নতুন বিরক্তি—উদ্ভট নাম।

ইউটিউব খুঁজে যদি দেখা যায় তাহলে কিছু নামের উদ্ভট চিহ্ন পাওয়া যায়। সেন্ড মি নুডস, বেড সিন, চুটকি ভান্ডার, সেলিব্রেটি কাউ, মিউচুয়াল ব্রেকআপ, ড্যাশিং গার্লফ্রেন্ড, বংশগত পাগল, ম্যানেজ মকবুল, চ্যাতা কাশেম, আমার তিন বউ, উত্তেজিত বউ, হেভিওয়েট মিজান, এক্সফেল মফিজ, মফিজের লাইফস্টাইল, কম খরচে হানিমুন, ইয়ো ইয়ো জামাই, এর মধ্যে কিছু নাটক ইউটিউবের জন্যই তৈরি হয়েছিল।

আগে বাংলা নাটকে শক্তিশালী গল্প ও চিত্রনাট্য দেখা যেত, যা এখন অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। বর্তমানে নাটকগুলোতে তেমন বৈচিত্র্য নেই, একই ধরনের প্রেম-ভালবাসার গল্প বারবার দেখানো হচ্ছে। ভাইরাল হওয়া কোনো গল্প বা চরিত্রের অনুসরণ করে একের পর এক নাটক বানানো হয়।একই ধরনের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, পরকীয়া, কৌতুকনির্ভর নাটক তৈরি করা হয়।

চিত্রনাট্যে গভীরতা ও চরিত্র নির্মাণের প্রতি যত্ন কমে গেছে। নাটকের সাফল্য এখন দর্শকদের প্রশংসার চেয়ে ইউটিউব ভিউয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। ফলে নির্মাতারা কনটেন্টের মান নিয়ে কম মাথা ঘামিয়ে ভাইরাল হওয়ার মতো কনটেন্ট বানানোর দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন।

টিভি দর্শক কিংবা মানুষের মৌলিক গল্পের প্রতি ভালোবাসার চাইতে বর্তমান নির্মাতারা ইউটিউব ভিত্তিক স্বল্প মিনিটের ভাইরাস কন্টেন্টের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। নাটকের নামকরণ হয় বিতর্কিত ও আকর্ষণীয়, যাতে দর্শক কৌতূহলী হয়ে ক্লিক করে। কিছু অভিনেতা ও অভিনেত্রী বাস্তবসম্মত অভিনয়ের বদলে অতিরঞ্জিত অভিনয় করেন। গুণী শিল্পীদের পরিবর্তে অনেক সময় সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটিদের দিয়ে নাটক বানানো হয়, ফলে মান কমে যায়। নাট্যকারদের সৃজনশীলতার অভাব এবং ভালো স্ক্রিপ্ট লেখার প্রতি অনাগ্রহও বড় সমস্যা।

ইউটিউবে নাটক মুক্তি দেওয়া সহজ বলে নির্মাতারা বাজেট কমিয়ে ফেলে, ফলে সেট, সিনেমাটোগ্রাফি ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত দিক দুর্বল হয়ে যায়। যার ফলে প্রোডাকশন কোয়ালিটি ভালো না হওয়ায় নাটকের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাচ্ছে।

ইউটিউব ও ফেসবুকে জনপ্রিয় কিছু ইনফ্লুয়েন্সারকে নাটকে নেওয়া হয়, যদিও তাদের অভিনয়ের অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা কম। এতে গুণী অভিনেতাদের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ফলোয়ার বেশি থাকলেই এখন কাস্টিং হয়ে যায়।

নির্মাতারা একের পর এক একই অভিনেতা-অভিনেত্রী ও চর্বিতচর্বণ গল্প দিয়ে নাটক বানাচ্ছেন। ইউটিউবের এলগরিদমের কারণে সস্তা, বিতর্কিত বা ভাইরাল হওয়ার মতো নাটকই বেশি ভিউ পায়। যা রীতিমতো একঘেয়ে হয়ে গেছে।

তাছাড়াও পুরোনো গুণী অভিনেতাদের এখন আগের মতো নাটক প্ল্যাটফর্মে কম দেখা যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। যদিও চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিম, আফজাল হোসেন, জাহিদ হাসান, তৌকীর আহমেদ, অপি করিম, আজাদ আবুল কালাম, ইরেশ যাকের নাটক করে থাকেন —তবে সংখ্যায় কম।

ওটিটিতে গল্পনির্ভর এবং দর্শক জনপ্রিয়তার কারণে নাটক থেকে নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে ফেলেছেন। এখনকার নির্মাতারা নাটক বা ওটিটি কনটেন্ট তৈরির সময় তরুণ দর্শকদের পছন্দকে বেশি গুরুত্ব দেন।

নতুন প্রজন্মের সোশ্যাল মিডিয়া জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাস্ট করলে ভিউ বেশি আসে, ফলে গুণী অভিনেতাদের অনেক সময় বাদ দেওয়া হয়। যার ফলে তারা গুণী অভিনেতাদের নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। গুণী অভিনেতারা সাধারণত শক্তিশালী স্ক্রিপ্ট ও চরিত্রে অভিনয় করতে চান, যা এখন তুলনামূলকভাবে কম লেখা হয়। অনেক সিনিয়র অভিনেতা নিম্নমানের স্ক্রিপ্ট, বাজে পরিচালনা বা সস্তা ট্রেন্ডভিত্তিক কনটেন্টে কাজ করতে চান না। তারা বুঝতে পারেন, এই ধরনের নাটক সিরিজ তাদের ক্যারিয়ারের মান কমিয়ে দেবে বলে।

যার ফলে নতুন প্রজন্মের দর্শকরা অনেক সময় গুণী অভিনেতাদের না চেনার কারণে তাদের নাটক বা ওটিটি সিরিজে দেখার প্রতি আগ্রহ দেখান না। নির্মাতারা মনে করেন, গুণী অভিনেতাদের চেয়ে নতুন মুখ আনলে আলোচনা বেশি হবে।

এইতো গেলো নাটকের হতশ্রী অবস্থার কথা। হতশ্রী অবস্থানের কথা বলতে গেলে বাংলাদেশের কর্মাশিয়াল ঘরণার সিনেমার নাম আসবে এরপরই।একটা সময় ছিলো স্বল্প বাজেটে বাংলাদেশে কর্মাশিয়াল সিনেমার ঘরণার ছবি মানেই পারিবারিক এবং সামাজিকগতভাবে ভালো গল্প এবং সেইসাথে ভালো মানের কিছু অ্যাকশন দেখার সুযোগ হতো দর্শকদের। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে কাজী হায়াৎ, মনতাজুর রহমান আকবর, সুভাষ দত্ত, এহতেশাম, দিলীপ বিশ্বাস কিংবা মালেক আফসারীর মতো পরিচালকরা দৃষ্টিনন্দন কর্মাশিয়াল সিনেমা উপহার দিয়েছেন।

রিয়াজ-শাবনূর-পূর্ণিমা-মান্না-শাকিল খান-বাপ্পারাজদের অভিনেতাদের অবসানের পর, মাঝে শাকিব খান-অপু বিশ্বাস জুটি কিছু রোমান্টিক সিনেমার পাশাপাশি শাকিব খানকে আলাদা করে কিছু অ্যাকশন ঘরণার ছবি করতেও দেখা যায়। কিন্তু সময়ের সাথে তা দর্শক জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে।

কিন্তু এরপর থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশে কর্মাশিয়াল সিনেমার নামে মানহীন কিছু সিনেমা। কেন সন্ত্রাসী, রংবাজী-দ্যা লাফাঙ্গা, তুমি আছো তুমি নেই, প্রেমিক ছেলে এইসবের মতো লো বাজেটের সিনেমার জন্য কর্মাশিয়াল সিনেমার আর্দশটায় যেনো হারিয়ে যেতে বসেছিল। পরবর্তী সময়ে এসে অবশ্য তরুণ পরিচালক রায়হান রাফী এসে কর্মাশিয়াল সিনেমা নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এক পরিচালক দিয়ে তো আর গোটা বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কর্মাশিয়াল সিনেমা চালানো সম্ভব নয়। শুধু পরিচালক নয়, বাংলাদেশে স্বল্প বাজেটে ভালো মানের কমার্শিয়াল সিনেমা না হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ পরিলক্ষিত করা যায়।

প্রযোজকের ঝুঁকি না নেওয়া প্রচলিত ধারণা হলো, কম বাজেটে বানানো সিনেমা ভালো ব্যবসা করতে পারবে না। অনেক প্রযোজক মনে করেন বর্তমান সময়ে কর্মাশিয়াল সিনেমা বানাতে গেলে, বড় তারকা, বিশাল সেট, এবং ব্যয়বহুল গান বা লোকেশন ছাড়া সিনেমা হিট হবে না। তাছাড়া প্রযোজকরা নতুন পরিচালকদের ফান্ডিং দিতে চায় না। যা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়।

তারা নতুন বা অপ্রতিষ্ঠিত নির্মাতার চেয়ে পরিচিত পরিচালকদের ওপর বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশের ফিল্ম প্রোডিউসাররা সাধারণত নিরাপদ পথে হাঁটতে চান। ফলে নতুনদের জন্য জায়গা তৈরি হয় না।

অনেক সময় দেখা যায়, কম বাজেটের সিনেমার জন্য যে ধরনের ইনোভেটিভ গল্প দরকার, সেটা পাওয়া যায় না। ভালো গল্পকার এবং চিত্রনাট্যকারের সংকটও একটা বড় সমস্যা।

কম বাজেটে আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো অনেক নির্মাতা প্রযুক্তি নিয়ে স্বচ্ছন্দ নন, বা ভালো টেকনিশিয়ান পাওয়া কঠিন। ফলে কম বাজেটের সিনেমা অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশি দর্শক এখনো বড় তারকা বা পরিচালকদের চেনাজানা ফর্মুলার ওপর বেশি নির্ভরশীল। ফলে নতুন পরিচালকদের প্রতি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির আস্থা তৈরি হতে সময় লেগে যায় এবং অনেক নতুন পরিচালক ভালো কনটেন্ট তৈরি করলেও সেটার জন্য যথেষ্ট প্রচারণা করতে পারেন না, যার ফলে তাদের কাজ আলোচনায় আসে না।

ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো কিছু নতুন নির্মাতাকে সুযোগ দিলেও, বড় বাজেটের ফিল্মে কাজ করার সুযোগ এখনো সীমিত। হলভিত্তিক সিনেমায় প্রবেশ করাটাও বেশ কঠিন হয়ে যায়।

সরকার অনুদানের সিনেমার ক্ষেত্রে কিছুটা সহায়তা করলেও, কমার্শিয়াল স্বল্প বাজেটের সিনেমার জন্য তেমন উৎসাহ দেওয়া হয় না। সেন্সর বোর্ড বা অন্যান্য প্রশাসনিক বাধাও অনেক সময় স্বল্প বাজেটের নির্মাতাদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।

কম বাজেটেও অনেক দেশের পরিচালকরা দারুণ সিনেমা বানিয়ে ফেলেন। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সে ধরনের টেকনিক্যাল দক্ষ নির্মাতা কম, যাদের সীমিত সম্পদ দিয়েও বড় প্রভাব ফেলতে পারেন।

বর্তমান সময়ে এসেও নাটকের মধ্যে মিজানুর রহমান আরিয়ান, শিহাব শাহীন, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ, ইমরাউল রাফাত, আশফাক নিপুণরা নিজেদের অবস্থান শক্ত করে ধরে আছেন। এরই মাঝে নতুন করে ভিকি জাহেদ, কাজল আরেফিন অমি তাদের অনবদ্য কাজের মাধ্যমে দর্শকদের মধ্যে আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন।

বছরের পর বছর কম সংখ্যক কাজ দিয়ে হলেও দর্শকদের বিভিন্নভাবে বিনোদিত করে যাচ্ছে। পুরোনো-নতুন অভিনেতাদের সংমিশ্রণে তথাকথিত গল্প থেকে বেরিয়ে নতুনধারার থ্রিলার-রোমান্টিক-পারিবারিক গল্প উপহার দিয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু কোথাও না কোথাও গিয়ে যেনো এই গল্পগুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ইউটিউব ভিউয়ার্স, ওভারেটেড নাটকের কাছে। তাই এই অবস্থার সংস্কার করতে হলে, গুণী নির্মাতাদের কাজের পরিধি বাড়াতে হবে, বাড়াতে হবে সিরিজধর্মী ধারাবাহিক নাটকের চাহিদা। সেইসাথে নতুন পরিচালকদের তুলে আনতে হবে যারা পরবর্তী সময়ে এই গুণী নির্মাতাদের জায়গাটা ধরে রাখতে পারে।

অন্যদিকে স্বল্প বাজেটে কর্মাশিয়াল সিনেমা সংস্কার করতে হলে তরুণ প্রজন্মের পরিচালকদের সুযোগ দিতে হবে। বর্তমান সময়ে কর্মাশিয়াল সিনেমাকে যেরকম রায়হান রাফী ধীরে ধীরে আলাদা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে ঠিক তেমনি কর্মাশিয়াল সিনেমার মধ্যে ভিন্ন ধারার গল্প বলার জন্য আগামী তরুণ পরিচালকদের সেইরকম গল্প বলার স্বাধীনতা দিতে হবে। সেইসাথে অভিনেতাদেরও সুষ্ঠু স্ক্রিপ্ট নির্বাচন ও ডেভেলপমেন্টের দিকে নজর দিতে হবে।

সেইসাথে স্ক্রিপ্ট ডেভেলপমেন্টের জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ওয়ার্কশপ আয়োজন করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক মানের গল্প বলার কৌশল ও স্ট্রাকচার ব্যবহার করতে হবে। যেমনটা ভারতের কন্নড় ইন্ডাস্ট্রি করে দেখাচ্ছে।

পরিচালককে শুধু পরিচালনা নয়, চিত্রনাট্য, ক্যামেরা পরিচালনা, এডিটিং বা প্রোডাকশন ডিজাইনেও পারদর্শী হতে হবে এবং কম খরচে সিনেমা নির্মাণের কৌশল জানতে হবে; যাতে করে ব্যয়বহুল সেট, বিশাল ক্রু, এবং ব্যয়বহুল ভিএফএক্স এড়িয়ে বাস্তব লোকেশন এবং সংলাপ, চরিত্র, শক্তিশালী চিত্রনাট্য ও গল্পের গভীরতা দিয়ে প্রোডাকশন দুর্বলতা ঢাকতে পারেন।

কম পরিচিত বা নতুন অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে ভালো অভিনয় বের করা এবং তাদের মেইনস্ট্রিমে সুযোগ দিতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সিনেমা প্রচার করার স্ট্র্যাটেজি জানা থাকতে হবে। লোকাল ব্র্যান্ড ও স্পন্সরদের যুক্ত করার পরিকল্পনা থাকতে হবে। ট্রেলারের মাধ্যমে আগ্রহ তৈরি করতে হবে। সেইসাথে সিনেমাটোগ্রাফি, এডিটিং, সাউন্ড ডিজাইন, প্রোডাকশন ডিজাইন—এসব ক্ষেত্রে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল নিয়োগ করা উচিত।

সিনেমাগুলো শুধু দেশীয় দর্শকের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের জন্যও তৈরি করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার ধরার জন্য প্রফেশনাল সাবটাইটেল, ডাবিং ও উপযুক্ত মার্কেটিং স্ট্রাটেজি ব্যবহার করা উচিত। এভাবে পরিকল্পিত ও পেশাদার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে কর্মাশিয়াল সিনেমার মধ্যে থেকেও বিশ্বমানের কাজ বেরিয়ে আসতে পারে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ গল্পনির্ভর সিনেমার দিকেও এগিয়ে আছে। তাই গল্পনির্ভর সিনেমা যাতে আরো বৃদ্ধি পায় সেইদিকে নজর রাখতে হবে এবং উন্নতমানের গল্পের দিকেও মনোনিবেশ করতে হবে।

তাছাড়া অদূর ভবিষ্যতে ভালো অভিনেতা এবং ভালো পরিচালক তৈরি ও বের করে আনতে হলে একটি সুসংগঠিত, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে। যার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ভালো মানের অভিনয় ও পরিচালনা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অভিনয় ও পরিচালনার জন্য প্রতিযোগিতা বা রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে নতুনদের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। থিয়েটার অভিনেতাদের সিনেমায় আসার সুযোগ তৈরি করতে হবে, কারণ তারা সাধারণত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত হন।

শক্তিশালী গল্প ও চিত্রনাট্য ছাড়া ভালো অভিনেতা বা পরিচালক গড়ে তোলা কঠিন। এজন্য পেশাদার চিত্রনাট্যকারদের জন্য প্রশিক্ষণ ও অনুদান দেওয়া দরকার। গল্প বাছাইয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মানসম্পন্ন ও আকর্ষণীয় চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ হয়। তাছাড়া নতুন পরিচালকদের জন্য অভিজ্ঞ পরিচালকদের মাধ্যমে মেন্টরশীপ প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে, যেখানে অভিজ্ঞ নির্মাতারা নতুনদের গাইড করবেন।

প্রকৃত মেধাবীদের অনুদান দিতে হলে স্বচ্ছ ও যোগ্যতাভিত্তিক নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। পরিচালকদের জন্য অনুদানের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা ও পর্যবেক্ষণ জোরদার করতে হবে। ওটিটি ও বিকল্প প্ল্যাটফর্মকে গুরুত্ব দিতে হবে। নতুন পরিচালক ও অভিনেতাদের জন্য ওটিটি (হইচই, বিঞ্জ, বঙ্গো, চরকি) ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমার জন্য তৈরি করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের নাটক-সিনেমায় সংস্কারমূলক কাজ আসতে বাধ্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি

সারাবাংলা/এএসজি

বাংলা নাটক-সিনেমা মুক্তমত সুমন বৈদ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর