ভালোমন্দের দোলাচলে দেশ
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৯:৪৩
বর্তমানে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এক অস্থিরতার মধ্যে চলছে। কিছু ক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গেলেও, বেশ কিছু খারাপ দিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। মূল্যস্ফীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, বিনিয়োগের স্থবিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে, যেমন রিজার্ভে পতন নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা, খাদ্য মূল্যস্ফীতির কিছুটা হ্রাস এবং মুদ্রা পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর ব্যবস্থা। এই প্রবন্ধে দেশব্যাপী ভালো ও খারাপ দিকগুলোর গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হলো।
খারাপ দিকগুলো_
১. ঝুঁকিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি
বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বর্তমানে একটি গুরুতর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে, যা দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রধান কারণ। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শেষ সময় থেকে বাংলাদেশে প্রতি মাসে খাদ্যপণ্যের দাম ৫ শতাংশের বেশি থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এতে চাল, ডাল, তেল, শাকসবজি এবং মাংসের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং শুল্কছাড় দেওয়া সত্ত্বেও বাজারে তার প্রভাব না পড়া এই মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, যেখানে নীতি সুদহার (রেপো রেট) ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আশা প্রকাশ করেছেন যে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে এবং চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২০২৫) শেষ মাস জুন নাগাদ এটি ৭ থেকে ৮ শতাংশে নেমে আসবে। এছাড়া, আগামী বছরে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে, অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন যে, শুধুমাত্র মুদ্রানীতি পরিবর্তন করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যেতে পারে। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
২. আইন-শৃঙ্খলার অবনতি
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এবং ২০২৫ সালের শুরুতেই ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে মাদক চোরাচালান, সন্ত্রাসবাদ এবং গ্যাং কালচারের বিস্তারের ফলে নগর এলাকায় কিশোর অপরাধীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিচারহীনতা এবং দুর্বল আইন প্রয়োগের কারণে অপরাধীরা বারবার একই ধরনের অপরাধ সংঘটিত করছে, যা সমাজে ভয় ও অনিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ২০২৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে একটি বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য সন্ত্রাসবাদ দমন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। অভিযানের প্রথম চার দিনে প্রায় ২,৮৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে, এই অভিযানের পদ্ধতি ও পরিসর নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবেলায় নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা জরুরি, এবং অভিযানের নামে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন হওয়া উচিত নয়।
অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হওয়ার পটভূমিতে গাজীপুরে সংঘটিত সহিংস ঘটনা উল্লেখযোগ্য। সেখানে বিক্ষোভকারীরা প্রাক্তন মন্ত্রী আ. মোজাম্মেল হকের বাড়িতে আক্রমণ চালায়, যা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির একটি উদাহরণ। এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় শুধুমাত্র কঠোর অভিযানই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, আইন প্রয়োগের নিরপেক্ষতা এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান। অপরাধ দমনে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং যুবসমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব।
৩. বিনিয়োগে স্থবিরতা
বাংলাদেশের বিনিয়োগ খাত বর্তমানে স্থবিরতার সম্মুখীন, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বেসরকারি বিনিয়োগের হার হ্রাস, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ এবং নতুন প্রকল্প ও শিল্প কারখানার সম্প্রসারণে বিনিয়োগের অভাবে উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিনিয়োগকে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর অনুপাতে পরিমাপ করা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার ছিল ২৩.৬৪%, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ২৪.৫২%। এই নিম্নমুখী ধারা দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি, যা গত বছরের চেয়ে ১২.৬০% বেশি। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১৭৭ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯% কম। এছাড়া, শিল্পের প্রাথমিক কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানিও যথাক্রমে ৪% ও ১৬% কমেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি বিনিয়োগেও ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। দেশের বিদ্যমান উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছেন না। অনেকের বড় ধরনের ব্যাংক ঋণ রয়েছে, সুদহার বাড়ার সাথে সাথে তাদের উদ্বেগও বাড়ছে। সরকার স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে অনুধাবন করতে পারছে না। এ কারণে এখন নতুন বিনিয়োগের চিন্তা কেউ করছে না। কিছু উদ্যোক্তা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করলেও, তারাও এখন ভয়ে আছেন। ফলে উৎপাদন ও বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি সঙ্কুচিত হয়েছে অন্তত ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত। বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা, রাজনৈতিক ও নীতিগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, এবং ব্যবসায়িক খরচ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এছাড়া, ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি, সুদের হার নিয়ন্ত্রণ, এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক খারাপ হচ্ছে, যা বিনিয়োগ স্থবিরতার অন্যতম কারণ।
৪. কর্মসংস্থান সংকট
বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অভাব এবং তরুণ জনগোষ্ঠীর বিদেশমুখী প্রবণতা বর্তমানে একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও, তাদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে, অনেক তরুণই হতাশ হয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন, যা দেশের মেধা পাচারের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদের মতে, দেশে প্রতিবছর প্রায় দুই মিলিয়ন তরুণ কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) তথ্য অনুযায়ী, ৬৬ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ কর্মহীন। অপরদিকে, বিশ্বব্যাংকের মতে, টেকনিক্যাল খাতে দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি প্রায় ৬৯ শতাংশ। ফলে, দেশের শিল্পখাতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিতে হচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
কর্মসংস্থানের অভাবে তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ’ গবেষণা অনুযায়ী, দেশের ৪২ শতাংশ তরুণ বেকারত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন, এবং ৫৫ শতাংশ তরুণ পড়াশোনা বা কাজের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে যেতে আগ্রহী। তাদের মতে, বেকারত্বের প্রধান কারণ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগে বৈষম্য এবং পারিবারিক জীবন ও কাজের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা। দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে তরুণরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। ২০২৩ সালে রেকর্ড ১৩ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন, যা প্রতি ঘণ্টায় গড়ে দেড়শো কর্মীর বিদেশে যাওয়ার সমান। তবে, বিদেশে কর্মসংস্থান বাড়লেও, অনেকেই সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মানসম্মত শিক্ষা, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। শিল্পখাতের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে শিক্ষা ও শিল্পখাতের মধ্যে সুসমন্বয় সাধন করতে হবে। এছাড়া, বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে স্বল্প পুঁজিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে। সার্বিকভাবে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মেধা পাচার রোধে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
৫. বাংলাদেশে বেআইনি অস্ত্রের বিস্তার
আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক নিরাপত্তার সংকট: বাংলাদেশে জুলাই ২০২৪ সালে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে বেআইনি অস্ত্রের প্রসার একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনও আন্দোলনে ব্যবহৃত সমস্ত অস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি, যা দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এক গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেআইনি অস্ত্র সাধারণত চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করে বা স্থানীয়ভাবে অবৈধভাবে তৈরি হয়। বিভিন্ন গ্যাং, রাজনৈতিক দল এবং অপরাধ চক্র এই অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। ২০২৪ সালে র্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, গ্যাং কালচার ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেআইনি অস্ত্রের সহজলভ্যতা বৃদ্ধি করেছে। বেআইনি অস্ত্রের কারণে বাংলাদেশে খুন, চাঁদাবাজি, দাঙ্গা ও সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা বেড়েছে। এই অস্ত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন গোষ্ঠী প্রতিপক্ষকে দমন করার চেষ্টা চালাচ্ছে, যা জনসাধারণের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। পুলিশের নজরদারি থাকলেও অপরাধীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বেআইনি অস্ত্রের ব্যবহার অব্যাহত রাখছে। বেআইনি অস্ত্রের কারণে সাধারণ জনগণ আতঙ্কে বসবাস করছে। ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সহজেই টার্গেটে পরিণত হচ্ছে। অস্ত্রধারী গোষ্ঠীগুলোর কারণে রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। গ্যাং কালচার ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ায় তরুণ সমাজের একটি অংশ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।
বেআইনি অস্ত্রের বিস্তার বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। এই সংকট মোকাবিলায় শক্তিশালী আইন, প্রশাসনিক কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। অন্যথায়, এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে আরও হুমকির মুখে ফেলবে।
৬. রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি
বাংলাদেশে জুলাই ২০২৪ সালে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি ও সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার, যা মূলত ছাত্রনেতা ও সুশীল সমাজের সদস্যদের নিয়ে গঠিত, বর্তমানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে, দ্রুত নির্বাচন আয়োজন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। জুলাই আন্দোলনের পর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠিত হয়। এই সরকারকে প্রশাসনিক দুর্বলতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার মতো সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে, পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের পদত্যাগ এবং পরবর্তী সময়ে লুটপাটের ঘটনা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও অবনতি করেছে। নির্বাচন আয়োজন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। কিছু দল সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়, আবার অন্যরা সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে। এই মতবিরোধের ফলে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন ও বিক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অন্তর্র্বতীকালীন সরকারকে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে এবং দেশের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে দেশকে পুনরায় স্থিতিশীল পথে নিয়ে আসা সম্ভব। এছাড়া, অর্থনৈতিক সংস্কার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। সর্বোপরি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশ এই সংকট থেকে উত্তরণ করতে পারে এবং একটি সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করতে সক্ষম হবে।
ভালো দিকগুলো _
১. রিজার্ভে পতন কিছুটা ঠেকানো গেছে
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অন্যতম প্রধান মানদণ্ড। ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশে রিজার্ভের মারাত্মক পতন ঘটে, যা আমদানি ব্যয় মেটানো ও মুদ্রার মান রক্ষার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এর পেছনে মূল কারণ ছিল—অতিরিক্ত আমদানি ব্যয়, রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধীরগতি, প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ। ২০২৪ সালের শেষের দিকে অন্তবর্তীকালীন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার ফলে রিজার্ভ পতন আংশিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল- (ক) আমদানি নিয়ন্ত্রণ: অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যাতে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় কমানো যায়। প্রবাসী আয়ের উৎসাহ বৃদ্ধি: রেমিট্যান্স বাড়াতে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর জন্য নগদ প্রণোদনার হার বৃদ্ধি করা হয়। (খ) রপ্তানি খাতের সম্প্রসারণ: তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাতের জন্য নীতিগত সহায়তা দেওয়া হয়, যাতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়। (গ) বৈদেশিক ঋণের পুনঃতফসিল: কিছু বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক রিজার্ভের ওপর চাপ কমানো হয়। এই পদক্ষেপগুলোর কারণে রিজার্ভের অতিরিক্ত পতন রোধ করা সম্ভব হয়েছে, যদিও এটি এখনো কাঙ্খিত মাত্রায় পৌঁছেনি।
২. ব্যাংক খাতে সামান্য স্বস্তি
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে উচ্চ পরিমাণের খেলাপি ঋণ এবং লিকুইডিটি সংকট বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালে এবং ২০২৫ সালের শুরুতে ব্যাংকিং খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে, যার পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ- (ক) ঋণ বিতরণ নীতিমালায় পরিবর্তন: বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণের অনুমতি দেয়, বিশেষ করে এসএমই ও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য। (খ) নগদ অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি: ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে, যার ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া সম্ভব হয়। (গ) খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ: অনেক খেলাপি ঋণ পুনরায় কাঠামোবদ্ধ করার ফলে ব্যাংকগুলো আংশিকভাবে ঝুঁকি কমাতে পারে। তবে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখনো উচ্চমাত্রায় (প্রায় ১০%+) রয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। ব্যাংকগুলো এখনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার চেষ্টায় রয়েছে বর্তমান ইউনুস সরকারের।
৩. খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেছে
খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, জ্বালানি সংকট ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে গিয়েছিল। ২০২৪ সালে সরকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে, যার ফলে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসে- (ক) বাজার মনিটরিং: সরকারের কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজি কিছুটা কমে যায়। (খ) ভর্তুকি প্রদান: চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভর্তুকি বাড়ানো হয়, যাতে সাধারণ জনগণ কম দামে খাদ্য কিনতে পারে। (গ) আমদানি শুল্ক হ্রাস: কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমানো হয়, যাতে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পায় এবং দাম কমে। (ঘ) দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি: কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও সারসহায়তা বৃদ্ধি করা হয়, যাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ে। এই উদ্যোগগুলোর কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৯% থেকে কমে ৭-৮% এর মধ্যে নেমে এসেছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির বিষয়।
৪. মুদ্রা পাচারে স্থিতিশীলতা
বৈদেশিক মুদ্রা পাচার দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সমস্যা। যা বিগত হাসিনা সরকারের ১৭ বছরে চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। ২০২৩ সালে হুন্ডি ও অন্যান্য অবৈধ পথে বিদেশে টাকা পাচারের কারণে দেশের মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। ফলে টাকার মান দ্রুত অবমূল্যায়িত হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও চাপের মুখে পড়ে। ২০২৪ সালে অন্তবর্তিকালনি সরকার ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইঋওট) বেশ কিছু কড়া পদক্ষেপ নেয়, যার ফলে মুদ্রা পাচার কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছে- (ক) হুন্ডির বিরুদ্ধে অভিযান: অবৈধ অর্থপাচার ও হুন্ডি রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যার ফলে অনেক পাচারকারী ধরা পড়ে। (খ) ব্যাংকিং চ্যানেলের প্রণোদনা: প্রবাসীদের জন্য বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর উপর নগদ প্রণোদনা ২.৫% থেকে বাড়িয়ে ৩-৪% করা হয়, ফলে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পায়। (গ) বৈদেশিক লেনদেনে নজরদারি: ব্যাংকিং খাতে সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত করার জন্য আরও শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। (ঘ) টাকার মান স্থিতিশীল রাখা: বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কেট ইন্টারভেনশনের মাধ্যমে টাকার মানকে বেশি অবমূল্যায়ন হতে দেয়নি, যার ফলে বাজারে স্থিতিশীলতা আসে। এই পদক্ষেপগুলোর কারণে ২০২৪ সালে এবং ২০২৫ এর শুরুতে টাকা পাচারের প্রবণতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে এবং মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা এসেছে। তবে, এটি পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি, এবং দীর্ঘমেয়াদে আরও কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োজন।
দেশের বর্তমান অবস্থা ভালো-মন্দের দোলাচলে রয়েছে। মূল্যস্ফীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, রিজার্ভ কিছুটা স্থিতিশীল রাখা, ব্যাংক খাতে স্বস্তি, খাদ্য মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ এবং মুদ্রা পাচার রোধের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার আশা করা যাচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সরকারের কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা গেলে দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থা উন্নতির দিকে যেতে পারে
লেখক: সাংবাদিক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এএসজি