Monday 03 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিশু আদালতের বিচার প্রক্রিয়ার আইনি ও বাস্তবিক দিক

অ্যাডভোকেট গাজী তারেক আজিজ
৩ মার্চ ২০২৫ ১৭:২৭ | আপডেট: ৩ মার্চ ২০২৫ ১৭:৩৩

বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৮ বছর বয়সসীমা পর্যন্ত শিশু হিসেবে নির্ধারণ করা রয়েছে। যদিও ভিন্ন ভিন্ন আইনে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান পূর্বক বয়সের হেরফের লক্ষ্য করা যায়। যদি শিশুর বয়সের সর্বোচ্চ সীমা ধরি সে হিসেবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক শিশু। যারা বাংলাদেশের উজ্জ্বল আগামী।

জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০-১১-১৯৮৯ কনভেনশন অব দ্য রাইট অব দ্য চাইল্ড সম্মেলনেও শিশুর বয়স ১৮ নির্ধারণ করা হয়। সে আলোকে শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী একটি শিশুর বয়স ১৮ বছর নির্ধারিত হয়েছে। শিশু আইন-১৯৭৪ এ শিশুর বয়স নির্ধারিত ছিল ১৬ বছর। বাংলাদেশের পেনাল কোডের-৮২ ধারা মোতাবেক ৯ বছরের নিচে কোনো শিশুর আইনবহির্ভূত ব্যবহারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। একই আইনে ৮৩ ধারা মোতাবেক বিচারকের দৃষ্টিতে ৯ বছরের নিচে ১২ বছরের বেশি না হলে কোনো শিশুর যদি ম্যাচিউরিটি সনাক্ত না হয় সে ক্ষেত্রেও শিশুটি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান ডিজিটাল যুগে ১৬-১৮ বছরের একজন কিশোর যথেষ্ট ম্যাচিউরিটি লাভ করে। অথচ এরা যত বড় অপরাধই করুক না কেন তাদের শিশু আইনে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। ওই আইনে হত্যাকাণ্ডের মতো গুরুতর অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর। ফলে তারা নানা অপরাধমূলক কাজ করেও আইনের সুবিধা ভোগ করার সুযোগ তাদের অনেককেই আরো বেশিমাত্রায় উৎসাহী করে তুলছে বলেও বিশ্লেষকদের ধারণা। যদিও আমাদের আজকের আলোচনা এই প্রসঙ্গে নয়। অধিকন্তু, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটি ভোটারের বয়স পুনঃনির্ধারণ করে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। সেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে ভোটার হতে পূর্বের নির্ধারিত ১৮ বছরের স্থলে ১৭ বছর করার জন্য। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যদি ভোটারের বয়স ১৭ হয় তাহলে শিশুর বয়সও পুনরায় নির্ধারণ জরুরি। কারণ ভোট প্রদানে তার মতামত এবং মানসিক সক্ষমতা থাকা দরকার।

বিজ্ঞাপন

অন্য কোন আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, আইনানুগ নিয়ম হচ্ছে যখন যে আইনে বিচার-প্রক্রিয়া চলমান থাকবে সে আইনেই তার ব্যাখ্যা দেয়া থাকে। আর বিচার-প্রক্রিয়া পরিচালনাকালীন যদি মনে হয়ে থাকে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন, অন্য আইন থেকে ব্যাখ্যা নেয়ার বিধান রয়েছে। সে দিক বিবেচনায় নিলে কোন আইনই অসম্পূর্ণ নয়। অথবা উচ্চ আদালতের রেফারেন্স থেকেও সমাধান পাওয়া যায়।

আসা যাক মূল আলোচনায়, জুভেনাইল কোর্ট, যা তরুণ অপরাধীর বিচারের জন্য আদালত যা শিশু আদালত নামেও পরিচিত, একটি ট্রাইব্যুনাল যার বয়স পূর্ণ হয়নি এমন শিশুদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য রায় দেওয়ার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। বেশিরভাগ আধুনিক আইনী ব্যবস্থায়, যে শিশুরা অপরাধ করে তাদের সাথে আইনগত প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে ভিন্নভাবে আচরণ করা হয়, যারা একই অপরাধ করেছে।

যদিও প্রচলিত ও ধারণাগতভাবে অনেকের মনে হতে পারে ১২ বছর পর্যন্ত শৈশব। ১২ বছর থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কৈশোর। তার পরবর্তী সময় তারুণ্য কিংবা যৌবন। কিন্তু আইনে নির্ধারিত মতে শৈশবের পরই প্রাপ্ত বয়স্ক। এখানে আলাদা করে আর যৌবনকে স্থান দেয়া হয়নি। সবাইকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এর ঊর্ধ্বে যত যা-ই বয়স হোক না কেন। এক্ষেত্রে যদি সোজাসাপ্টা কথায় বলি তাহলে ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ আর ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ এই দুইটাই থাকে বয়সভেদে।

যদি কোন শিশু অথবা কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে শিশু আদালতে তার বিচার প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে কিশোর আদালতের কথা বলা হলেও মূলতঃ শিশু আদালতকেই বুঝানো হয়েছে। শিশুদের শাস্তির বিধান রয়েছে নির্ধারিত। রয়েছে কিশোর সংশোধনাগার।

আবার আইনে নারী ও বৃদ্ধদের জন্যও কিছু অধিকার সুরক্ষিত। সেটাও যথাযথ নয়। শুধু জামিনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়ার কথা বলা রয়েছে। কিন্তু নারীদের প্রতি সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নামে পৃথক বিশেষ আদালত(ট্রাইব্যুনাল) রয়েছে।

বিচার ব্যবস্থার মধ্যে আইন নির্ধারিত একটি বিশেষ বিভাগ, ‘কিশোর আদালত’। অপ্রাপ্তবয়স্ক অভিযুক্তদের মামলার বিচার করার দায়িত্বপ্রাপ্ত, যারা ফৌজদারি অপরাধ থেকে শুরু করে অবহেলা পর্যন্ত অভিযোগের সম্মুখীন হন, অথবা পিতামাতার নিয়ন্ত্রণের বাইরে কিংবা সমাজের স্বাভাবিক ধারায় না থাকাদের বলে মনে করা হয়। সাধারণত, এই অভিযুক্তদের বয়স ১৮ বছরের কম হয়, যদিও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আইনি সীমা এখতিয়ার অনুসারে পরিবর্তিত হয়। তদন্তকার্যে এবং যথাযথ বয়স প্রমানসাপেক্ষে একই মামলায় যদি প্রাপ্তবয়স্ক কোন অপরাধী ব্যক্তি থেকে থাকে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলেও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য ‘অভিযোগ পত্র’ আর শিশুদের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত করে ‘দোষী পত্র’ প্রদান করা হলে আলাদা বিচার-প্রক্রিয়ায় বিচার অনুষ্ঠিত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে কেবল শিশু আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

শিশু যদি কোন ঘটনাচক্রে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তাহলে প্রচলিত আইনে আদালতে বিচার করার সুযোগ নেই। শিশুদের বিচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়। এসব বিবেচনা থেকেই ২০১৩ সালে ‘শিশু আইন’ প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১৮ সালে তা সংশোধনও করা হয়। সংশোধিত আইনে শিশুদের জন্য আলাদা আদালত বা পৃথক এজলাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখনো তেমন কোনো ব্যবস্থা দেশের কোন আদালতে লক্ষ্যণীয় হয়নি। যা প্রণিত আইনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার শামিল বলেও মনে করা হয়ে থাকে।

শিশুদের জন্য পৃথক সংশোধনাগার থাকলেও অপরাধের তারতম্য বিবেচনায় না নিয়ে সাধারণ ও গুরুতর অপরাধ তথা অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটানো কিংবা সংঘটন করা শিশুদের একই সাথে রাখা হচ্ছে। যাতে করে অপেক্ষাকৃত কম অপরাধ করা শিশু আর বেশি অপরাধ করা শিশু থেকে ‘ধারণা’ শেয়ার করে নিজেও ‘অপরাধ পরিক্রমায়’ জড়িয়ে পড়ার আশংকা থেকে যায়। যার ফলে মূল লক্ষ্য বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর এতে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। পড়তে পারে ভয়ংকর বিপর্যয়ে। বিনষ্ট হতে পারে আশার আগামী!

কিশোর আদালত প্রাপ্তবয়স্ক আদালতের থেকে আলাদাভাবে কাজ করে বলেই আমরা জানি। যেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে নাবালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, সেসব মামলার বিচারের এখতিয়ার তাদের নেই। যদিও কিশোর আদালতের কার্যক্রম সবসময় প্রতিপক্ষীয় বিন্যাস মেনে চলতে পারে না, তবুও নাবালকদের বিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে আইনি প্রতিনিধিত্বের অধিকার দেওয়া হয়। অতিরিক্তভাবে, ইতিবাচক ফলাফল অর্জন এবং পুনরাবৃত্তি রোধ করার লক্ষ্যে অভিভাবক, সমাজকর্মী এবং প্রবেশন অফিসাররা কার্যক্রমে অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিকতার কারণে শিশুদের মনো-দৈহিক কোন প্রভাব পড়ছে কি-না আমরা কেউই সে খবর রাখি না। বিচার চলাকালীন শিশুদের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে কথাবার্তার মাধ্যমে তাদের চিন্তা-চেতনায় কোন বিরূপ প্রভাব কিংবা নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠছে কি-না তা-ও নজর রাখতে হবে। অন্যথায় উক্ত শিশুদের সাথে মিশতে থাকা অপরাপর শিশুরাও প্রভাবিত হতে পারে। তবে, গুরুতর বা বারবার অপরাধের ক্ষেত্রে, কিশোর অপরাধীদের কারাদণ্ড হয়ে থাকলে আইনি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে রাষ্ট্রীয় সংশোধনাগারে স্থানান্তরিত হতে পারে।

কিশোর আদালত বহুমুখী, যা নাবালকদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং নির্ভরশীলতা উভয়কেই মোকাবেলা করে, যেখানে নাবালকের কল্যাণের জন্য পিতামাতার বাইরের অভিভাবকত্ব প্রয়োজন এমন পরিস্থিতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে তাতেও অপরিচর্যার ফলে সুযোগ পেলেই শিশু-কিশোররা তেমন অপরাধ কর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইতেও পারে। সেদিকটায়ও নজরদারি করা সমীচীন বলে মনে করি।

আমরা এক্ষেত্রে শিশু আইন-২০১৩ এর আলোকে বাদবাকি আলোচনা এগিয়ে নিতে পারি। যেখানে বলা আছে ১৮ বছরের নিচে যে কাউকে শিশু বিবেচনা করে আইনটির পঞ্চম অধ্যায়ে ‘শিশু-আদালত ও উহার কার্যপ্রণালি’ শিরোনামে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

আইনটিতে ‘শিশু-আদালত’ নামে বিশেষ আদালতের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬, ১৭ ও ১৯ ধারায় এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ধারা ১৬(১) অনুসারে আইনের সঙ্গে সংঘাত জড়িত শিশু কর্তৃক সংঘটিত যেকোনো অপরাধের বিচার করার জন্য দেশের প্রতিটি জেলা সদরে শিশু আদালত নামে এক বা একাধিক আদালত রাখতে বলা হয়েছে। অন্যথায় উপধারা (২) অনুসারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ -এর অধীন গঠিত প্রত্যেক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্বীয় অধিক্ষেত্রে উপধারা (১) এ উল্লিখিত শিশু আদালত হিসেবে গণ্য হবে বলে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো জেলায় এ রকম কোনো ট্রাইব্যুনাল না থাকলে সেই জেলার জেলা ও দায়রা জজ স্বীয় অধিক্ষেত্রে উপধারা (১) এ উল্লিখিত শিশু আদালত হিসেবে গণ্য হবে বলেও আইনে বলা হয়েছে।

অর্থাৎ একটি বিষয় খুব পরিষ্কার! শিশু আদালতের বিচারক হিসেবে একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি থাকবেন। যিনি ব্যক্তিজীবনে একজন বিবাহিত, সমাজ সচেতন, পারিপার্শ্বিক জ্ঞানসম্পন্ন ও মানবিক হবেন। এই ধারণাটির কথা যদিও কোন আইন কিংবা অপর কোথাও উল্লেখ নেই তথাপিও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সেটাই ইঙ্গিত করে। কারণ একজন বিচারক যদি বিবাহিত হন স্বভাবতই তাঁর সন্তান থাকবে, আর তিনি বিচারিক মনোভাবে যতটুকু বিচারক সুলভ চিন্তা-চেতনা প্রয়োগ করার ঠিক ততোধিক থাকবে পিতৃত্বের সুশীতল স্নেহের আবরণে। আর এজন্যই একজন শিশুকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনায় না নিয়ে অভিযুক্ত হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়ে থাকে। আর তা-ই আইন নির্ধারিত ‘এজলাস’ অন্যান্য আদালতের আদলে হবে না মর্মে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন! বাংলাদেশের কোথাও এমন শিশুবান্ধব এজলাস রয়েছে কি-না জানা নেই।

শিশু আদালতের অধিবেশন ও ক্ষমতা সম্পর্কে ১৭ ধারায় বলা হয়েছে। ১৭(৪) ধারা মতে, যেসব দালান বা কামরায় এবং যেসব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তা ব্যতীত যতদূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের ন্যায় কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা বহুল প্রচলিত চিরায়ত আদালত কক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু-আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে।

বর্তমানে আদালতে নেই পর্যাপ্ত এজলাস। এই একটি কারণ দেখিয়ে এখনো শিশু আদালত নামে পৃথক কোনো এজলাস কক্ষ গড়ে ওঠেনি। যা শিশুবান্ধব হিসেবে শিশুদের বিচারকালীন সময়ে শিশু মনে কোন প্রভাব ফেলতে পারে, এমন হবে না। একই এজলাসে বিচার চলছে ভাগাভাগি করে। যার কারণে অন্য আর দশজন অপরাধীদের সাথে একই বিবেচনায় বা শিশুদের প্রতি অবহেলা নির্দেশ করবে না, এমন নয়। এত এত আইনের গুরুত্বারোপ করা সত্ত্বেও অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের বিচার চলছে একই গৎবাঁধা নিয়মের সে-ই এজলাস কক্ষে। প্রায়ই দেখা যায়, শুনানির দিনে অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুরা তাদের অভিভাবক বা প্রবেশন কর্মকর্তার মাধ্যমে আদালতের বারান্দায় অপেক্ষা করতে থাকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গুরুতর সব অপরাধের বিচার চলে। যেহেতু একই এজলাস ভাগাভাগি করতে হয় তাই আদালতের বাইরে সবাইকে একসঙ্গেই অপেক্ষা করে থাকতে হয়। এরপর নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ডাকেই ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। কোনো আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শিশুকে কাঁঠগড়ায় তুলে দেওয়া হয়। ধারা ১৯–এর উপধারা (৪) বলছে, শিশু আদালত কর্তৃক শিশুর বিচার চলাকালে আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালত কক্ষে তাহাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরিধান করতে পারবেন না, এমনকি বিচারকও তেমন থাকবেন। কিন্তু সে বিধান কি আদৌ মেনে চলার চেষ্টা করা হয়? ন্যুনতম বোধসম্পন্ন হলেও আইনি নির্ধারিত ও নির্দেশনা মোতাবেক কাঠামোগত শিশু আদালত এজলাস স্থাপন জরুরি।

সারা দেশের আদালতগুলোয় নানা রকম অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু এরপরও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। এ ছাড়া বিচারকের সংখ্যা যেমন কম, মামলার সংখ্যা সে তুলনায় অনেক বেশি। এসব কারণে নিম্ন আদালতের কোনো কোনো বিচারক একই সঙ্গে দুটি আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও শিশু আদালতের বিষয়টি উপেক্ষা করা মোটেও সমীচীন নয়। শিশু আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক আলোচনা আমরা শুনতে পাই। অন্য মামলার বিচার শেষে শিশু আদালতের বিচার পরিচালনা করতে হয় বিচারকদের। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের মামলার বিচারের প্রভাব শিশুদের ওপর যেন না এসে পড়তে পারে, এ জন্য বিচারকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। যদি একই বিচারক শিশু আদালতে বিচারকার্য পরিচালনা করে থাকেন সেক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তত একটা দিন নির্ধারণ করা গেলে সেইদিন আদালতের পরিবেশ শিশু উপযোগী করে রাখা যেতে পারে বাহ্যিকভাবে। তবে আমার মতে শিশু আদালত প্রচলিত আদালতের আঙ্গিনায় পরিচালনা না করে ভিন্ন কোন পরিবেশে করা গেলে মনে হয় ভালো হতো। এতে করে প্রাপ্তবয়স্ক কিংবা দাগী কোন অপরাধীর সাথে শিশুদের আদালত অঙ্গনে দেখা কিংবা সাক্ষাৎ হতো না। একটি সমাজের প্রকৃত চরিত্র প্রকাশ পায় সেখানকার শিশুদের প্রতি আচরণের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তিপর্যায়ে সবার। তাই পূর্ণাঙ্গভাবে শিশু আইন বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত।

লেখক: অ্যাডভোকেট, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এএসজি

অ্যাডভোকেট গাজী তারেক আজিজ মুক্তমত শিশু আদালত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর