স্কুল ব্যাংকিং: সঞ্চয়ী করছে শিক্ষার্থীদের
৩ মার্চ ২০২৫ ১৮:৩৬
গত কয়েক বছরে দেশে স্কুল ব্যাংকিং ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ২০১০ সালের নবেম্বরে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারী-বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু এবং এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। এর আগে দেশব্যাপী মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার উদ্যোগ নেয়া হয় কৃষিজীবী তথা কৃষকের জন্য। দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে এ দুটি কার্যক্রম চালুর পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের উৎসাহ ও উদ্যোগ অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে। দেশের মোট জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটা অংশ শিক্ষার্থী। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীই ৪ কোটির বেশি। তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রমের বাইরে রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মধ্যে শৈশবকাল থেকেই সঞ্চয়ের মনোভাব গড়ে তুললে তাদেরও যেমন লাভ, তেমনি গতি সঞ্চার হয় দেশের অর্থনীতিতেও। প্রধানত এই দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাংকগুলোকে স্কুল ব্যাংকিং চালু করার অনুমোদন দেয় সরকার তথা বাংলাদেশ ব্যাংক। স্কুল ব্যাংকিংয়ে টার্গেট গ্রুপ ১১-১৭ বছরের তরুণ-তরুণী ও ছাত্রছাত্রীদের কোনো আয়ের উৎস নেই। তারা তাদের মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণে উপহার বা নগদ অর্থ পেয়ে থাকে, অথবা নিয়মিতভাবে দুপুরের টিফিন বাবদ যে অর্থ পেয়ে থাকে, তা থেকে কিছু অর্থ বাঁচিয়ে জমা রাখার নিমিত্তে স্কুলের নিকটস্থ ব্যাংক শাখায় একটি সেভিংস হিসাব খোলার উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করাই স্কুল ব্যাংকিংয়ের উদ্দেশ্য।
স্কুল ব্যাংকিং এর গতিপ্রকৃতি _
বর্তমানে দেশের ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে স্কুল ব্যাংকিং চালু করেছে। ইয়ং স্টার, ফিউচার স্টার, প্রজন্ম স্টার ইত্যাদি নানা আকর্ষণীয় নামে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিম চালু করেছে ব্যাংকগুলো। স্বভাবতই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাতে আকৃষ্ট হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য আরও কিছু করা যায় কিনা, তা ভেবে দেখতে হবে ব্যাংকগুলোকে। সত্য বটে, দেশে সঞ্চয়ের বিপরীতে সুদের হার অনেক কম। অথচ আমানত আকৃষ্ট করতে হলে সুদের হার বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই বললেই চলে। সরকার তথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এহেন আর্থিক নীতি সমালোচিতও হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। সে অবস্থায় সঞ্চয়ের বিপরীতে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের সুদের বিকল্প হিসেবে কিছু প্রণোদনা দেয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখতে পারে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। অবশ্য কতিপয় ব্যাংক প্রতিবছর দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সুবিধাসহ বিভিন্ন বৃত্তি দিয়ে থাকে। এর আওতা আরও সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। মোটকথা, সঞ্চয়ের প্রতি আগ্রহী ও আকৃষ্ট করার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। আর তাহলেই স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রমের সাফল্য সুনিশ্চিত হবে। এর মাধ্যমে শিশু ও কিশোর শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। তদুপরি মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বৃত্তি পেয়ে ইতিবাচক অবদান রুখতে পারে এ জাতীয় সঞ্চয়।
স্কুল ব্যাংকিং-এর সংখ্যাতাত্বিক বিশ্লেষন _
গত ১০ বছরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ‘স্কুল ব্যাংকিং’ কার্যক্রম। এ পর্যন্ত (২০২০) শিক্ষার্থীদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা সাড়ে ২৮ লাখ ছাড়িয়েছে। একই সময়ে সঞ্চয়স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ২০৫ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বিভাগের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। স্কুল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্থ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি ও সঞ্চয় করার মনোভাব ও অভ্যাস গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এ লক্ষ্যে বেশ সাড়াও ফেলছে। শিক্ষার্থীরা দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠেছে। স্কুল ব্যাংকিং শুরু হওয়ার পর থেকে তথ্যে দেখা যায়, গত ১০ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে ২৮ লাখ ৬৬ হাজার ৮৭৩টি। আর এতে শিক্ষার্থীদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২০৫ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ছেলে শিক্ষার্থীদের আছে ১ হাজার ২০২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আর মেয়েদের ১ হাজার ৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। যার মধ্যে ৫২ শতাংশ হিসাব শহরাঞ্চলে এবং ৪৮ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে। এ সময়ে গ্রামীণ পর্যায়ে এই প্রান্তিকে হিসাব বেড়েছে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ। তবে শহরে ৬ দশমিক ০৯ শতাংশ কমেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ৫৫টি ব্যাংকে বিদ্যমান এই স্টুডেন্ট ব্যাংকিং স্কিম। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সরকারি ব্যাংকের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে আছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। স্কুল ব্যাংকিং হিসাবে এগিয়ে পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে যথাক্রমে প্রথম রয়েছে বেসরকারি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। যাতে হিসাব রয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৫৩৭; এরপর রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, যার হিসাব সংখ্যা ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬০টি; অগ্রণী ব্যাংকে হিসাব সংখ্যা ২ লাখ ৬৩ হাজার ৪১১টি; এশিয়া ব্যাংকে হিসাব সংখ্যা ১ লাখ ৯২ হাজার ৯৬৬টি এবং সর্বশেষ রয়েছে রূপালী ব্যাংক, যাদের হিসাব সংখ্যা ১ লাখ ৬৬ হাজার ২৩৬টি। ভবিষ্যতে অর্থের সংকট মেটাতে সবার সঞ্চয় করার অভ্যাস করা জর“রি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চয় উদ্বুদ্ধ করতে ‘স্কুল ব্যাংকিং’ কার্যক্রম ভূমিকা রাখছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে এ জাতীয় সঞ্চয়ে।
করোনায় স্কুল ব্যাংকিংয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে _
করোনায় সারাবিশ্বই লকডাউন পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। বাংলাদেশেও ২০২০ এর মার্চ-এপ্রিল মাস থেকে লকডাউনের কারণে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে বর্তমানে ফের ঘুরে দাঁড়ায়েছে। তবে স্কুল কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে স্কুল ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে স্কুল ব্যাংকিংয়ে হিসাব সংখ্যার প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমেছে যা অন্য প্রান্তিকের তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, দেশে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে মোট ৫৫টি ব্যাংক। চলতি ২০২০ বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের স্কুল ব্যাংকিং হিসাবে শিক্ষার্থীদের জমা টাকার পরিমাণ ১ হাজার ৮২১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। শিক্ষার্থীদের মোট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ২৪ লাখ ৫০ হাজার ৫৬৪টি। জুন প্রান্তিকের তুলনায় সেপ্টেম্বর শেষে অ্যাকাউন্টের পরিমাণ বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং আমানত বেড়েছে ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বৃদ্ধির এই হার বছরের অন্য বছরের তুলনায় তিন শতাংশের বেশি থাকে। গত জুন প্রান্তিকে মোট হিসাব সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৩১ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থীর, মোট আমানতের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭৬২ কোটি ৮২ লাখ টাকা। মার্চ প্রান্তিকে জুনের তুলনায় হিসাব সংখ্যা বেড়েছিল ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। স্কুল ব্যাংকিংয়ে নগরে রয়েছে ৬০ দশমিক ৭৩ শতাংশ আর তৃণমূল অঞ্চলে রয়েছে ৩৯ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্ট। এরমধ্যে ছেলে শিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্ট ৫৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ আর মেয়ে শিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৪৩ দশমিক ২৬ শতাংশ। এই সময়ে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীর অ্যাকাউন্টের হার বেড়েছে যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে স্কুল ব্যাংকিংয়ে প্রবৃদ্ধির হার খুবই কম। অন্য প্রান্তিকে এ হার গড়ে তিন শতাংশ থাকে। এই সময়ে আমানত বেড়েছে ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। এ পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের অধিকাংশই খোলা হয়েছে সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে। সব হিসাবের ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। গত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় হিসাব বেড়েছে ৩২ দশমিক ২৫ শতাংশ, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানত বেড়েছে ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। এসব হিসাবের মধ্যে ঢাকা বিভাগে হিসাবধারীর সংখ্যা ৭ লাখ ৩৯ হাজার ৭৩৫ হাজার, যার আমানতের পরিমাণ ৮২১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম বিভাবে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৮১টি হিসাবে আমানতের পরিমাণ ৪২০ কোটি ২২ লাখ টাকা। রাজশাহী বিভাগে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৪৯৪টি হিসাবে আমানতের পরিমাণ ১৩৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে মোট হিসাবের মধ্যে ৩০ দশমিক ১৯ শতাংশ ঢাকা বিভাগে, ১৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগে, ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ রাজশাহী বিভাগে, ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ময়মনসিংহ বিভাগে, রংপুরে ৭ দশমিক শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, সিলেটে ৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ, বরিশালে ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং খুলনা বিভাগে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ।বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, এসব হিসাবের ৪৫ দশমিক ১০ শতাংশ আমানত ঢাকা বিভাগের শিক্ষার্থীদের, ২৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগে, রাজশাহী ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ৭ দশমিক ২৬, বরিশালে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ, সিলেটে ৬ দশমিক ৬১ শতাংশ, রংপুরে ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ।উল্লেখ্য, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান ছুটি ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর আগে করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি কয়েক ধাপে বাড়িয়ে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছিল। গত ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে টিভিতে ক্লাস সম্প্রচার করা হয়েছিল। আর উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষাস্তরে অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়েছে স্কুল ব্যাংকিংয়ে।
স্কুল ব্যাংকিংয়ের সাম্প্রতিক চিত্র _
উচ্চ মূল্যস্ফীতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝে। অনেকে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ মেটাতে হিমশিম খান। এদিকে প্রতিমাসেই দেশে শিক্ষা ব্যয় বেড়েই চলছে। যার প্রভাব পড়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের সঞ্চয়েও। তবে নতুন বছরের শুরু থেকেই স্কুল শিক্ষার্থীদের আমানত ও হিসাব সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রায় সব সূচকেই ইতিবাচক প্রবাহ দেখা গেছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে এ খাতের আমানত বেড়েছে ৩০ কোটিরও বেশি। আর হিসাব সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩৮ হাজার। যেখানে এক মাস আগেও প্রায় ৪৬ কোটি টাকা সঞ্চয় কমেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে স্কুল শিক্ষার্থীদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭১ কোটি টাকা- নভেম্বরে ছিল দুই হাজার ৪১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসে আমানত বেড়েছে ৩০ কোটি টাকা। তবে এর আগের বছর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে আমানতের স্থিতি ছিল দুই হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে আমানতের স্থিতি কমেছে প্রায় ১০৮ কোটি টাকা। তবে গত নভেম্বরে বছরের ব্যবধানে ফারাক ছিল ১৫৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে ফারাক কিছুটা কমেছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের শুরুতে তথা জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাংক আমানতের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা আগস্টে কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ১৭২ কোটি, সেপ্টেম্বরে দুই হাজার ১৩৫ কোটি টাকা, অক্টোবরে কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে আমানত কমলেও ডিসেম্বর মাসে কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে।সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাধারণত যে কোনো শ্রেণির হিসাবে আমানত অল্প হলেও বাড়তে থাকে। কারণ কেউ যদি নতুন করে টাকা জমা নাও দেয়, তবুও আগের জমাকৃত আমানতের সুদ যোগ হয়ে মোট অঙ্ক বাড়তে থাকে। আর যদি গ্রাহকরা তার মুনাফার টাকা উত্তোলন করে ফেলে তাহলে হিসাব অপরিবর্তিত থাকে। তাছাড়া নতুন বাড়তে থাকা হিসাবের আমানত যোগ হয়। গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হলো নতুন করে যেসব হিসাব খোলা হয়েছে কিংবা আগের হিসাবে যে পরিমাণ টাকা জমা হয়েছে তার চেয়ে বেশি অঙ্কের টাকা উত্তোলন হচ্ছিল। অর্থাৎ আর্থিক চাপের কারণে শিক্ষার্থীরাও তাদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। তবে ডিসেম্বরে কিছু নতুন হিসাব খোলা হয়েছে এবং যুক্ত হয়েছে কিছু নতুন আমানত।
তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছর ডিসেম্বরে ব্যাংকে শিক্ষার্থীদের হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩ লাখ ৮০ হাজার ১৫৯টি। তার আগের মাস নভেম্বরে হিসাব সংখ্যা ছিল ৪৩ লাখ ৪২ হাজার ২৫৯টি। সে হিসাবে এক মাসে হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৩৭ হাজার ৯০০টি। গত নভেম্বরেও আগের মাসের তুলনায় ২২ হাজার হিসাব কমেছিল। এর মধ্যে সর্বশেষ ছেলেদের হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ৩২ হাজার ৬৭২টি আর মেয়েদের হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৮৭টি। তার আগের মাস নভেম্বরে ছেলেদের হিসাব সংখ্যা ছিল ২২ লাখ ৫ হাজার ৯৮৪টি আর মেয়েদের হিসাব সংখ্যা ছিল ২১ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৫টি। সে হিসাবে ডিসেম্বরে ছেলেদের হিসাব বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৮৮ ও মেয়েদের হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ১১ হাজার ২১২টি।
ব্যাংকাররা জানান, সাধারণত বছরের শুরুতে কিংবা শেষের দিকে অনেকের টাকা উত্তোলনের চাপ থাকে। অনেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়ে বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় বেড়াতে যান। আবার অনেকে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধ করতে গিয়ে আমানত ভাঙেন। কিন্তু বছরের পুরো সময়জুড়ে শিক্ষার্থীদের আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে নিয়মিত খরচ মেটাতে হিমশিম অবস্থার মধ্যেই আমানত উত্তোলন করতে হচ্ছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি ও ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতি এমনটাই ইঙ্গিত করছে। এত কিছুর পরও ডিসেম্বরে যে উন্নতি হয়েছে তা বেশ ইতিবাচক।বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ( মুখপাত্র) বলেন, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আমাদের ব্যাংক খাতের ওপর অনেক গ্রাহক আস্থা হারিয়েছিল। এর প্রভাবও কিছুটা স্কুল ব্যাংকিংয়ে পড়ে। তবে এখন তা ধীরে ধীরে কেটে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। সে কারণে শিক্ষার্থীদের আমানত ও হিসাব সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনা ও তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয়। এ কার্যক্রমের লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে টাকা জমানোর অভ্যাস তৈরি করা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় তাদের আরও উপযোগী করে তোলা। ২০১০ সালে স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হলেও শিক্ষার্থীরা টাকা জমা রাখার সুযোগ পায় ২০১১ সাল থেকে। প্রথম বছরে ২৯ হাজার ৮০টি স্কুল ব্যাংকিং হিসাব খোলা হয়। পরের বছর ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় ব্যাংকগুলোতে ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৭টি হিসাব খোলা হয়। এ পর্যন্ত ৫৯টি ব্যাংক স্কুল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করেছে। ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা এ ধরনের অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে।এই অ্যাকাউন্টগুলোর সঙ্গে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। যেমন- সব ধরনের ফি ও চার্জের ক্ষেত্রে রেয়াত পাওয়া, বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধা পাওয়া, ন্যূনতম স্থিতির বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে ছাড় ও স্বল্প খরচে ডেবিট কার্ড পাওয়ার সুযোগ। মাত্র ১০০ টাকা আমানত রেখেই এ ধরনের অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।
স্কুল ব্যাংকিংয়ের প্রবৃদ্ধি দিনদিন বাড়ছে এবং এক আকর্ষনীয় করে তোলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অগ্রনী ভূমিকা জরূরী ।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক; বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
সারাবাংলা/এএসজি