Tuesday 04 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ক্রিকেট: অন্তরালে পুঁজিবাদী শোষণ ও শ্রেণিবৈষম্য

এম আর লিটন
৪ মার্চ ২০২৫ ১৭:১০

দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। কিন্তু এর আড়ালে লুকিয়ে পুঁজিবাদী শোষণ ও শ্রেণিবৈষম্য। গবেষণায় উঠে এসেছে ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণে সামাজিক বৈষম্য বাড়ার তথ্য। সমাধানে কঠোর নীতি, অন্যান্য খেলায় বিনিয়োগ ও গণসচেতনতা জরুরি। কার্ল মার্কসের ‘পুঁজি’ গ্রন্থে উল্লিখিত শোষণের ধারণা, অ্যান্টোনিও গ্রামশির ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ তত্ত্ব ও নোম চমস্কির মিডিয়া বিশ্লেষণের আলোকে এই লেখনীতে ক্রিকেটের বহুমাত্রিক প্রভাব আলোচনা করা হবে।

বিজ্ঞাপন

ক্রিকেটের রাজনৈতিক অর্থনীতি _

পুঁজিবাদী সমাজে ক্রিকেট কেবল একটি খেলা নয়। এটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম। কাল মার্কসের মতে, ‘পুঁজিবাদী শ্রেণি শোষণের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে’। এই দর্শন ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণে স্পষ্ট। যেমন, ভারতীয় প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) ২০২৩ সালে ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে (ইকোনমিক টাইমস, ২০২৩)। যেটা মূলত কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও ধনকুবেরদের হাতেই কেন্দ্রীভূত। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ৮৫ শতাংশ স্পনসরশিপ বহুজাতিক কোম্পানির দখলে (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, ২০২২)। এই বিনিয়োগের লক্ষ্য জনগণের মনোযোগকে বাণিজ্যিক স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করা। যেটা অ্যান্তোনিও গ্রামশির ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্য’ তত্ত্ব অনুযায়ী, ক্ষমতাশালী শ্রেণি তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এবং ভারতের বিসিসিআইর মতো সংস্থাগুলো রাজনৈতিক ও পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশে ২০২১ সালে ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের রাজস্ব ১২৩ কোটি টাকা অতিক্রম করে (বাংলাদেশ বিজ্ঞাপন সমিতি, ২০২১)। এই অর্থনৈতিক প্রবাহ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থেকে কর্পোরেট মুনাফায় রূপান্তরিত হয়। যেটা পুঁজিবাদী শোষণের একটি নিদর্শন।

অন্যদিকে ক্রিকেট ম্যাচগুলো জাতীয়তাবাদী আবেগকে উসকে দেয়। ২০১৫ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের সময় সামাজিক মাধ্যমগুলোতে উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য বৃদ্ধি পায় (ডয়চে ভেলে, ২০১৫)। ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ এরিক হবসবামের মতে, ‘ক্রীড়া জাতীয় পরিচয় নির্মাণের একটি হাতিয়ার’।

বিজ্ঞাপন

শ্রমিক শ্রেণি থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য উত্তোলন _

ক্রিকেট খেলোয়াড়দের মজুরিব্যবস্থা পুঁজিবাদী বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে। আইপিএলের শীর্ষ খেলোয়াড়রা মৌসুমে ২ কোটি ডলার আয় করেন। অথচ স্থানীয় ক্লাব পর্যায়ের ক্রিকেটারদের মাসিক আয় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা (ক্রিকইনফো, ২০২৩)। বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট লিগে ৭০ শতাংশ খেলোয়াড় আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভোগেন (প্রথম আলো, ২০২২)। এই বৈষম্য ডেভিড হার্ভের ‘নব্য-উদারবাদী নীতি’র প্রতিচ্ছবি। যেখানে পুঁজির কেন্দ্রীভবন শ্রেণিগত বিভাজনকে ত্বরান্বিত করে।

কর্পোরেট স্পনসরশিপের মাধ্যমে পণ্যের বিপণন কৌশলও শোষণমূলক। যেমন বাংলাদেশে ‘ডার্জি এক্সপ্রেস’ বিপিএলের স্পনসর হয়ে শ্রমিক শ্রেণিকে উচ্চমূল্যের সেবা ক্রয়ে প্ররোচিত করে। যেটা তাদের সঞ্চয় ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ন করে (ডেইলি স্টার, ২০২১)।

সময়ের অপচয় ও উৎপাদনশীলতার সংকট _

বাংলাদেশে একটি ওডিআই ম্যাচের গড় দর্শকসংখ্যা ২দশমিক ৫ কোটি (বিসিসি, ২০২৩)। কর্মঘণ্টার অপচয় সম্পর্কে বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তরের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্রিকেট মৌসুমে উৎপাদনশীলতা ১৮ শতাংশ হ্রাস পায়। একটি টেস্ট ম্যাচের পাঁচ দিনে আনুমানিক ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ লেবার স্টাডিজ, ২০২১)।

এই সময়ের অপচয় কাল মার্কসের ‘অবসর সময়ের শোষণ’ ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি যুক্তি দেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শ্রমিকদের অবসর সময়কেও পণ্যে পরিণত করে। ক্রিকেটের ম্যাচ, বিজ্ঞাপন ও জুয়ার প্ল্যাটফর্মে দর্শকদের সময় ‘মূল্যবান পণ্য’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

শারীরিক ও মানসিক চাপ _

ক্রিকেটের দীর্ঘসময় ধরে চলা ম্যাচ দর্শকদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা বাড়ায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (২০২২) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৬৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয়। এর একটি বড় কারণ টেলিভিশনে ক্রিকেট দেখা। অন্যদিকে ফুটবল বা বাস্কেটবলের মতো সক্রিয় খেলাধুলা অংশগ্রহণমূলক সুস্থতা বাড়ায়।

মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও ক্রিকেটের প্রভাব উদ্বেগজনক। ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৪২ শতাংশ তরুণ ক্রিকেট ম্যাচের ফলাফল নিয়ে উদ্বেগ ও অনিদ্রায় ভোগেন।

জুয়া ও অপরাধ _

বাংলাদেশে ক্রিকেট জুয়ার বাজার বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে (র‌্যাব, ২০২৩)। ২০২২ সালে শুধু ঢাকায় ১৭২টি জুয়া চক্র ভেঙে দেওয়া হয়। এর ৮০ শতাংশ ক্রিকেট ম্যাচকেন্দ্রিক (ডিবি, ২০২২)। জুয়া সংস্কৃতি খেলোয়াড়দের নৈতিকতাকে ক্ষুণ্ন করে। ২০২০ সালে বাংলাদেশের একজন জাতীয় খেলোয়াড় ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে নিষিদ্ধ হন (আইসিসি, ২০২০)।

ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো যুক্তি দেন, ‘ক্ষমতা কাঠামো সমাজের প্রতিটি স্তরে অনুপ্রবেশ করে’ (ফুকো, ১৯৭৫)। ক্রিকেট জুয়ার নেটওয়ার্ক এই ক্ষমতারই প্রতিফলন, যেখানে অপরাধী চক্র ও রাজনৈতিক মহল সমন্বিতভাবে লাভবান হয়।

স্থানীয় উদাহরণ _

• বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। যেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেটের ৩০ শতাংশ (বাংলাদেশ অর্থ মন্ত্রণালয়, ২০২৩)।

• গাজীপুরের একটি গার্মেন্টস কর্মী রিনা আক্তার (২৫) বলেন, ‘ম্যাচের দিনে আমাদের কারখানার উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমে যায়। অথচ ওভারটাইমের টাকাও কম পাই’ (জাতীয় শ্রম জরিপ, ২০২২)।

সচেতনতা ও নীতিগত পরিবর্তন _

১. নিয়মকানুন কঠোরীকরণ: জুয়া ও ম্যাচ ফিক্সিং প্রতিরোধে আইপিসির সঙ্গে সমন্বয় করে কঠোর শাস্তির বিধান প্রণয়ন।

২. শিক্ষা ও ক্রীড়ার সমন্বয়: ক্রিকেটের পাশাপাশি অন্যান্য খেলাধুলায় বিনিয়োগ বাড়ানো।

৩. মিডিয়া সচেতনতা: ক্রিকেটের বাণিজ্যিকীকরণের নেতিবাচক দিক নিয়ে গণসচেতনতা কর্মসূচি।

৪. শ্রম আইন প্রয়োগ: কর্মঘণ্টায় ক্রিকেট সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা।

ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা অনস্বীকার্য। তবে এর পুঁজিবাদী ব্যবহার সমাজে বৈষম্য ও শোষণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই খেলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। ভার্জিনিয়া উলফের বলেন, ‘স্বাধীনতা হলো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা’। ক্রিকেটের মোহনীয়তা অস্বীকার্য। তবে এর পেছনের পুঁজিবাদী কাঠামো সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘স্বাধীনতা হারে যে দেশ/ সকল দাসত্ব তারই শেষ’। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও স্বাধীনতা প্রয়োজন- শোষণমুক্ত, সুস্থ ও ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থার।

তথ্যসূত্র _

১. কার্ল মার্কস, ডাস ক্যাপিটাল, ১৮৬৭
২. বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, বিপিএল স্পনসরশিপ রিপোর্ট, ২০২২
৩. ক্রিকেট অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ ইন বাংলাদেশ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি জার্নাল, ২০২১
৪. মিশেল ফুকো, ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ, ১৯৭৫
৫. বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তর, প্রোডাক্টিভিটি লস রিপোর্ট, ২০২০

লেখক: সাংবাদিক

সারাবাংলা/এএসজি

এম আর লিটন ক্রিকেট পুঁজিবাদী শোষণ ও শ্রেণিবৈষম্য মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

এলো ‘জ্বীন ৩’র পোস্টার
৪ মার্চ ২০২৫ ১৯:০৮

বিএনপির ৪ নেতাকে শোকজ
৪ মার্চ ২০২৫ ১৮:৫৮

আরো

সম্পর্কিত খবর