ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে কেন চীনে ঝুঁকছেন বাংলাদেশিরা?
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৭:৪৫
চিকিৎসার জন্য এতোদিন বাংলাদেশি রোগীদের প্রধান গন্তব্য ছিল প্রতিবেশি দেশ ভারত। তবে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণে দেশটিতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভিসা জটিলতায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশিদের। এ পরিস্থিতিতে বিকল্প নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে চীন। ভারতে বাংলাদেশি রোগীদের বছরে চিকিৎসা বাবদ খরচের পরিমাণ ৬ হাজার কোটি টাকা। এবার তাতে ভাগ বসাতে চলেছে চীন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা সঙ্কটে পরে। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ রাখে ভারত সরকার। গুরুতর অসুস্থতার প্রমাণ দিতে পারলেও অনেক সময় দেশটি মেডিক্যাল ভিসা দিচ্ছেনা। আর ট্যুরিস্ট ভিসা তো একেবারে বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশিদের মধ্যেও ভারতবিরোধী মনোভাব বেড়েছে। সবমিলিয়ে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য চীনের কুনমিং কলকাতার বিকল্প হয়ে উঠছে। যদিও ভারতের ভিসা জটিলতার কারনে এরই মধ্যে অনেকে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে যাচ্ছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তুরস্কেও যাচ্ছেন বলে গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে।
সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বাংলাদেশি নাগরিকদের উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতার ‘বিকল্প’ব্যবস্থা করে দিতে চীনকে অনুরোধ করেন। তাতে সাড়া দিয়ে চীন সরকার কুনমিং শহরের ৩টি হাসপাতালকে বাংলাদেশি রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে বলে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১০ মার্চ প্রথম দফায় চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ৩১ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা ছেড়েছে। প্রতিনিধিদলে রয়েছেন ১৪ জন রোগী, ৬ জন পরিবারের সদস্য, ৫ জন চিকিৎসক, ৫ জন এইচইউসি প্রতিনিধি ও সাংবাদিক। এ উপলক্ষ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক সংবাদ সম্মেলনের ঢাকাস্থ চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, বাংলাদেশি রোগীদের জন্য আমাদের দরজা উন্মুক্ত। আমরা চাই, বাংলাদেশিরা উন্নত চিকিৎসা পান এবং সুস্থ হয়ে দেশে ফেরেন। বাংলাদেশি রোগীদের জন্য চীনে চিকিৎসার সুবিধা বাড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তাদের জন্য আমরা ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করেছি। পাশাপাশি চাইনিজ এয়ারলাইন্সও বিশেষ ছাড়ে টিকিট দিচ্ছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে যে চীন বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার বাজার ধরতে কতোটা আগ্রহী।
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশী রোগীদের যাতায়াতে কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল (মূলত ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস সংলগ্ন) তাদের বাণিজ্য বাড়িয়েছে। শুধু হাসপাতালই নয়, হাসপাতালসংলগ্ন এলাকায় চালু হয়েছে বিভিন্ন লজ, ট্র্যাভেল এজেন্সি, খাবারের দোকানসহ অন্যান্য ব্যবসা। গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাবে কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কলকাতার বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর হিসাব বলছে, বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ! এর ফলে মুখ থুবড়ে পড়ছে কলকাতার স্বাস্থ্য ও পর্যটন খাতে।
কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলো প্রথমে ভেবেছিল এই ধাক্কা সাময়িক। দ্রুত বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা দেওয়া শুরু হবে এবং আগের মতই রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে। কিন্তু ভিসা জটিলতায় উল্টো পথে হাটতে শুরু করেছে রাজ্যটির অর্থনীতি এ কথা বলাই যায়।
গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, প্রতিবছর ৩ থেকে ৫ লাখ বাংলাদেশি রোগী উন্নত চিকিৎসা নিতে ভারতে যান। সেখানে চিকিৎসা করাতে বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করেন বাংলাদেশীরা। ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বিদেশি রোগীদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৭০ ভাগ। ভারতের দিল্লি, চেন্নাই বা বেঙ্গালুরে বাংলাদেশি রোগীরা যে পরিমাণ অর্থ খরচ করেন, তার কাছাকাছি খরচে যদি চীনে চিকিৎসা পাওয়া যায়, তাহলে চীনই হতে পারে বাংলাদেশি রোগীদের পরবর্তী চিকিৎসার গন্তব্য স্থল।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১৫ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশিদের জন্য ৮ লাখ ভিসা ইস্যু করে ভারত। এর মধ্যে মেডিকেল ভিসার পরিমাণ ছিল ২ লাখ। এর আগের বছর ২০২৩ সালে দেশটিতে মোট চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া বিদেশিদের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৩৫ হাজার। এর মধ্যে বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যাই ছিল ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৫৭০ জন, যা দেশটিতে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া রোগীদের মোট সংখ্যার প্রায় ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ।
যেসব পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে
ঢাকা থেকে ভারতের কলকাতায় সড়কপথ বা রেলপথে আসা যায় কয়েক ঘণ্টায় তবে চীনের কুনমিংয়ে সেভাবে পৌঁছনো সম্ভব না। একমাত্র মাধ্যম আকাশপথ। তাও সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর হয়ে কুনমিং যাওয়ার কয়েকটি ফ্লাইট রয়েছে। এছাড়া ঢাকা থেকে চীনের পিকিং বিমানবন্দর বা গুয়াংঝো বিমানবন্দরে যেতে হবে এবং সেখানে ৭ ঘণ্টা বা ১০ ঘণ্টার বিরতির পর কুনমিংয়ে যেতে হয়। সরকারকে এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে।
এছাড়া চীনে আকাশপথে যেতে যেহেতু খরচ বেশি তাই এয়ার টিকিটে কিভাবে ছাড় দেয়া যায় বিষয়টি নিয়ে এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা যেতে পারে।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা একটি বড় বাধা হতে পারে, সে ক্ষেত্রে চীন সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে দোভাষী চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো এগিয়ে নেয়া যেতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি
চিকিৎসা ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে চীনে মুক্তমত সাইফুল ইসলাম শান্ত