আলুর বাম্পার ফলনে চাষীর লাভ ক্ষতি
১৫ মার্চ ২০২৫ ১২:৪৬
আলুর অর্থনীতি
মাত্র কয়েক মাস আগেই বাংলাদেশের বাজারে ৮০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হতে দেখা গেছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রীতিমত হিমসিম খাওয়ার একপর্যায়ে ভারত থেকে আলু আমদানির সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে সরকারকে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিবছর পর্যাপ্ত উৎপাদন হওয়ার পরও সংরক্ষণের অভাবে দেশের আলুর বাজারে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে।এর জন্য সরকারের সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতাই প্রধানত দায়ী। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৮০ লাখ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টনের কাছাকাছি। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে বাংলাদেশে আলু উৎপাদন হয়েছিল চাহিদার চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ টন বেশি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য নির্ভুল হলে উৎপাদনের ১৫ শতাংশ নষ্ট হওয়ার পরও দেশে উদ্বৃত্ত আলু থাকার কথা। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আলু আমদানি করতে হয়েছে ৯৮ হাজার ৭৩১ টন। যদিও বিপরীতে একই সময়ে আলু রপ্তানি হয়েছে ১২ হাজার ৩৫২ টন। আলুর উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানির এইসব তথ্য-উপাত্তে হিসাব মেলানো খুব কঠিন। তবে রান্নার বাইরেও আলুর ব্যবহার বেড়েছে। এ দেশের মানুষের কাছে চিপস ও ফ্রেঞ্চফ্রাইয়ের চাহিদা বাড়ছে। আমরা সাধারণত যে আলু উৎপাদন করি তার বেশির ভাগই টেবিল পটেটো অর্থাৎ রান্নার কাজে ব্যবহার হয়। আলু প্রসেসিং শিল্পে ব্যবহার হয় ভিন্ন জাতের আলু। বাজার স্থিতিশীল রাখাসহ সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে কৃষকের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করা জরুরি।তা না হলে কৃষক পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ হারাবে, যার ফলে পণ্য সংকটে বাজার অস্থির হবে। সেটার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
মুন্সিগঞ্জ আলু উৎপাদনের সুতিকাগার
আলু উৎপাদনকারী জেলাগুলোর একটি হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ। অন্য বছরের মতো এবারও সেখানকার বহু কৃষক আলু চাষ করেছেন, যাদের একজন শফিকুল রহমান। ‘গত বছরের তুলনায় এবার ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু দাম না ওঠায় আমরা একেবারে ধরা খেয়ে গেছি’, বলছিলেন তিনি। অথচ ফলন ভালো হওয়ায় আমাদের খুশি হওয়ার কথা ছিল, অথচ তার বদলে এখন আহাজারি করতে হচ্ছে। বর্গা ও নিজের জমি মিলিয়ে তার. এবছর প্রায় ৯০ বিঘা আলু চাষ করেছেন। এক্ষেত্রে প্রতিকেজি আলু চাষে অন্তত বিশ টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।কিন্তু ফসল তোলার পর এখন তাকে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে গড়ে ১৩ টাকা দরে। ‘বীজ, সার, লেবার কস্টিং মিলায়ে বিঘাপ্রতি আমার খরচ পড়েছে লাখের ওপরে। আর এখন আলু বিক্রি করে পাচ্ছি গড়ে ৬৫ হাজার। বিঘায় ৩৫ হাজার টাকা লস,’ বলেন সেই চাষী।এখানে উল্লেখ্য মুন্সীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, জেলাটিতে চলতি বছর আলুর উৎপাদন সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর বিপরীতে সেখানকার ৫৮টি হিমাগারে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন আলু রাখা যাবে। এ অবস্থায় নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় কিছুটা লোকসান মেনে নিয়েই আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চাষীরা। ‘আমরা কী করবো? অন্যকোনো উপায় তো নেই। বিক্রি না করে ঘরে আলু রাখলে সব পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে’, বলছিলেন জেলাটির আরেক জন আলু চাষী মোহাম্মদ মাঈনুদ্দীন। এদিকে, হঠাৎ চাপ বেড়ে যাওয়ায় আলু রাখার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছেন হিমাগার মালিকেরা। এতে উৎপাদকদের মধ্যে যারা আলু সংরক্ষণ করতে চাচ্ছেন, তারা আরও বেকায়দায় পড়েছেন।
সারাদেশে আলু উৎপাদনের পরবর্তি পরিস্থিতি
পটুয়াখালীর গলাচিপার বোয়ালিয়া গ্রামের কৃষকরা আলু উত্তোলনের পর মাঠেই স্তূপ করে রেখেছেন। আলু বেচার পর কৃষিকাজ চালিয়ে যেতে পারছেন না বোয়ালীয়া গ্রামের কৃষকরা। কারণ আলু বেচে বিনিয়োগই উঠে আসছে না। আলুর দাম কম হওয়ায় দিশাহারা গলাচিপার কৃষকরা। তাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আলুর ভালো ফলন হলেও সঠিক দাম পাচ্ছে না কৃষক। ফলে ক্ষেত থেকেই পাইকারদের কাছে কম দামে আলু বেচতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। কেউ কেউ আবার আলু জমাট করে রাখতে টাল তৈরি করেছেন। কেউ-বা গাছ কেটে মাটির নিচে সংরক্ষণ করছেন। কিন্তু তাতেও ভয় কাটছে না। আবহাওয়া প্রতিকূল হলে হাজার হাজার মণ আলু ক্ষেতেই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গলাচিপায় আলু চাষের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালের দিকে। প্রথমদিকে ভালো ফলন ও লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা এতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। উপজেলার মুরাদনগর, বোয়ালীয়া ও চরখালী গ্রামে সবচেয়ে বেশি আলুর চাষ হয়। এ বছর উপজেলায় ৩৭০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার (৩৬৫ হেক্টর) চেয়ে বেশি। প্রতিটি হেক্টর জমিতে ২৮ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। এতে চাষিদের উৎফুল্ল হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা হয়নি। কারণ ক্রেতা নেই। সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নেই। এ অবস্থায় সুযোগ নিচ্ছে পাইকাররা। ফলে পাওয়া যাচ্ছে না ন্যায্য দাম। উত্তর চরখালী গ্রামের মোজাম্মেল হোসেন ৮০ কড়া জমিতে আলু চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘লাভ তো দূরের কথা, পুঁজি উঠে আসাই কঠিন হয়ে পড়বে। এখনও ক্ষেত থেকেই আলু তুলতে পারিনি।’এদিকে উপজেলার আলুক্ষেতে শ্রমিকদের মধ্যে নারী শ্রমিকই বেশি। মিতু বেগম, লিজা আক্তার, শাহিনুর বেগম ও রিনা বেগম প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করেন। কিন্তু পুরুষদের সমান পরিশ্রম করেও তারা মজুরি পান অর্ধেক। পুরুষ শ্রমিকরা যেখানে ৬০০ টাকা পান, সেখানে নারীরা পান ৩০০ টাকা। নারীশ্রমিক মিতু বেগম বলেন, ‘আমরা সমান কাজ করে মজুরি অর্ধেক, এটা কি ঠিক? রোজার দিনে এত কাজ করেও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছি না।’ মেহেরপুরের আলু চাষী সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘কেজিপ্রতি বিশ টাকা খরচ করে আলু ফলায়ে এখন আট টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাহলে আমরা বাঁচবো কী করে?’ বাম্পার ফলন হলেও সেই পরিমাণ আলু সংরক্ষণের জন্য যত সংখ্যক হিমাগার প্রয়োজন, সেটা কোনো জেলাতেই নেই। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার বিরাহীম আইএপিপি কৃষক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মোকসেদুল ইসলাম জানান, প্রতি বছর প্রায় ২০০ একর জমিতে আলু চাষ করেন। তাদের উৎপাদিত আলু এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রফতানিও হচ্ছে। ২০১৯ সালে তাদের স্বর্ণসময় ছিল। ওই সময় প্রায় দুই হাজার টন আলু রফতানি হয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম অন্যতম। কিন্তু মানসম্মত ও কাঙ্ক্ষিত বীজ না পাওয়ায় তারা চাহিদামতো আলু রফতানি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। মো.মোকসেদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি একরে বীজের প্রয়োজন প্রায় ৮০০ কেজি। জমিতে সবসময় বিএডিসির আলুবীজ ব্যবহার করি। কিন্তু রংপুর অঞ্চলে বিএডিসির বরাদ্দ কম থাকায় প্রয়োজনীয় বীজ সহজে পাচ্ছি না আমরা।’ গত ১০ বছরে নওগাঁয় আলুর আবাদ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে। জেলায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় কার্ডিনাল, এস্টোরিক, গ্রানোলা ও দেশি জাতের লাল আলু। হেক্টরপ্রতি কার্ডিনাল উৎপাদিত হয় ২০ থেকে ২২ মেট্রিক টন পর্যন্ত। এ ছাড়া হেক্টরপ্রতি এস্টোরিক ১৮ থেকে ২০, গ্রানোলা ১৭ থেকে ১৮ ও দেশি জাতের আলু উৎপাদিত হয় ১৬ থেকে ১৭ মেট্রিক টন। উৎপাদন বেশি হওয়ায় জেলার অধিকাংশ চাষিই কার্ডিনাল আলু চাষে বেশি আগ্রহী। জেলার সমতল জমির পাশাপাশি আত্রাই, ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গা নদীর চরেও আলু আবাদ হয়েছে। চলতি (২০২৪-২৫) রবি মৌসুমে ২১ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কৃষকেরা তাদের জমিতে আলু চাষ করেছেন। সারা নওগাঁ জেলার মধ্যে আলু উৎপাদনে বদলগাছী আর মান্দা উপজেলার পরই আত্রাইয়ের স্থান। সেখানে এবার আলুর আবাদ হচ্ছে ২ হাজার ৭২৫ হেক্টর জমিতে। নওগাঁর কৃষি কার্যালয়ের ধারণা, প্রতি হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১৮ দশমিক ৮২ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই হিসাবে চলতি রবি মৌসুমে জেলায় মোট ৪ লাখ ৩০১ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হবে। সম্প্রতি ডেইলি স্টার–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশের রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া ও জয়পুরহাটের চাষিরা জানিয়েছেন, কেজিপ্রতি আলুর দাম এখন ১১ টাকার কম। এবার প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে ১৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ১৩ টাকা। চাষিরা উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না। তারা আলুর দাম বাড়াতে বা তাদের সহায়তার জন্য সরকারি উদ্যোগ আশা করছেন।
এরমধ্যেই লাল মনিরহাটের চাষিরা গত শনিবার ১ মার্চ ২০২৫ রাস্তায় আলু ফেলে সড়ক অবরধ করে বসেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ২০২৪ সালে ৬০ কেজির এক বস্তা আলু সংরক্ষণে হিমাগারের ভাড়া ছিল ৩৫০ টাকা। চলতি বছর হিমাগার কর্তৃপক্ষ ভাড়া ৪৮০ টাকা নির্ধারণ করেছে। এই একতরফা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাদের সড়ক অবরোধ। বর্তমানে বাজারে আলুর কেজি ১০ টাকা। ১০ টাকার মধ্যে যদি ৮ টাকাই হিমাগার মালিক নিয়ে নেয় তাহলে কৃষকরা পাচ্ছেন মাত্র ২ টাকা। অবরোধকারীদের দাবি আলু সংরক্ষণে হিমাগারের বাড়তি ভাড়া বাতিল করে আগের ভাড়া বহাল রাখা হোক।
হিমাগার মালিকদের বক্তব্য
আলু সংরক্ষণের খরচ বৃদ্ধির জন্য হিমাগার মালিকদের দুষছেন চাষীরা। তবে মালিকরা অবশ্য দাবি করছেন যে, তারা অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াননি। ‘আমরা যে দাম চাচ্ছি সেটা মোটেও অযৌক্তিক নয়,’ বলছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের একটি হিমাগারের কর্ণধার সালাম হাওলাদার। তিনি আরও বলেন, ‘এখন যে টাকাটা চাওয়া হচ্ছে, সেটাই আমাদের সত্যিকারের খরচ। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কথা ভেবে এতদিন আমরা নিজেরা লস দিয়ে কম টাকা নিয়েছি। হিমাগারের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের খরচ দিতেই তো সাত টাকা চলে যায় ।এ পরিস্থিতিতে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান হিমাগার মালিকরা। আত্রাইয়ের আগে আলু ওঠে নীলফামারী এলাকায়। নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার আলুচাষিদের মাথায় হাত! কিশোরগঞ্জের এক চাষি বলেন, ‘বর্তমানে আলুর দাম কম হওয়ার কারণে না পারছি বেচতে, আবার না পারছি হিমাগারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে।’ তিনি একটা হিসাব দিলেন। হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করতে গেলে ৫০ কেজির একটি বস্তার দাম ৫৫ টাকা, আলু প্রসেসিংয়ে খরচ বস্তাপ্রতি ২০ টাকা, হিমাগারের ভাড়া প্রতি কেজি ৮ টাকা হিসাবে ৪০০ টাকা, হিমাগারে নিয়ে যাওয়ার পরিবহন খরচ বস্তাপ্রতি ৪০ টাকা—সব মিলিয়ে হিমাগারে সংরক্ষণ করতে গেলেও প্রতি ৫০ কেজির বস্তায় ব্যয় হবে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। অনেকেই তাই বাধ্য হয়ে কম দামে মাঠেই আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন। কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১২ টাকায় নেমে এসেছে আলুর দাম।
সরকার বিষয়টি কি ভাবে দেখছেন
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জানিয়েছেন যে, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যেই কোল্ড স্টোরেজগুলোর ভাড়া নির্ধারণ করাসহ আরও কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে মালিকপক্ষ যেন বেশি টাকা নিতে না পারেন এবং কোনো হিমাগার যেন খালি পড়ে না থাকে, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সোহাগ সরকার বলেন ইতোমধ্যেই আমরা প্রাকৃতিকভাবে আলু সংরক্ষণের বিভিন্ন এলাকায় কিছু ঘর তৈরি করে দিচ্ছি। সেখানে অন্তত পাঁচ মাস আলু সংরক্ষণ করা যাবে। সরকারিভাবে সেটির কাজ শুরু হয়েছিল বছর দু’য়েক আগে। সারা দেশে ইতোমধ্যেই এ ধরনের কয়েকশ ঘর তৈরি করা হয়েছে। এলাকার একজন কৃষকের জমিতেই সরকারি খরচে এটি নির্মাণ করা হয়। সেখানে ওই এলাকার অন্য কৃষকরাও আলু রাখতে পারেন।এছাড়া সাধারণ কৃষকরা নিজেদের ঘরেই কীভাবে আলু সংরক্ষণ করতে পারবেন, সেই ধরনের কিছু প্রশিক্ষণ ও পরামর্শও গ্রামে গ্রামে গিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এগুলোর বাইরে সরকারিভাবে কিছু হিমাগার নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক। কিন্তু ততদিন চাষীরা নিজেরা কীভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে আলু সংরক্ষণ করতে পারেন, সেটি তাদের শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও আলু রপ্তানির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এখান থেকে ইতোমধ্যে নেপাল, দুবাই এবং মালয়েশিয়ায় বেশ কয়েক টন আলু রপ্তানি করা হয়েছে, বলছিলেন ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক। তবে যত পদক্ষেপই সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হোক না কেন, পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা না গেলে কৃষিক্ষেত্রে সংকট পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। জানা গেল, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে রংপুর বিভাগসহ দেশের ১৬টি জেলায় ৪৫০টি অহিমায়িত মডেল ঘরে আলু সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল। গত অর্থবছরে রংপুর জেলায় ৭৫টি অহিমায়িত মডেল ঘরের মধ্যে ৪৫টিতে আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আলুঘরগুলো কাজ করছে। সরকারের টাকা না থাকলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি তহবিল এই বিরল সফল প্রকল্পে আরও অর্থলগ্নি করেতে পারে। আত্রাইয়ের চাষিরা সহজ শর্তে ঋণ পেলে নিজেরাই ঘর বানিয়ে নেবেন বলে জানালেন। ক্ষুদ্রঋণ সংগঠনগুলো এ কাজে এগিয়ে আসতে পারে না
উপসংহার
রপ্তানি করুক না করুক, সরকারকে আলুচাষিদের রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার অন্যতম স্তম্ভ আলু নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। দেরি না করে বসতে হবে হিমাগারের মালিকদের সঙ্গে। আমাদের বিকল্প কিছুও ভাবতে হবে। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া এবং ভারতের কতগুলো রাজ্যে লম্বা সময়ের জন্য আলু সংরক্ষণের জন্য চাষিদের বাড়িতেই বিশেষ এক ধরনের ঘর বানানো হয়। বাংলাদেশে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আগ্রহে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর আলু উৎপাদন অঞ্চলে এ রকম কিছু ঘর তৈরির পরিকল্পনা নেয়। তারা এটার নাম দেয় ‘অহিমায়িত মডেল ঘর’। নওগাঁর ধামইরহাটের আলমপুরে এ রকমের একটা ঘর দেখেছিলাম। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, এটি একটি বিজ্ঞানসম্মত মিনি কোল্ড স্টোরেজ। তাদের নকশা করা ঘরে ২৫ থেকে ৩০ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণে কৃষকের সাশ্রয় হবে বছরে প্রায় দেড় লাখ টাকা। একটি অহিমায়িত ঘর তৈরি করলে ১৫ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে। একেকটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল দেড় লাখ টাকা। খুব সহজেই এসব ঘরে আলু চার থেকে ছয় মাস সংরক্ষণ করা যায়। এতে প্রতিবছরে একেকজন আলুচাষির দেড় থেকে পৌনে দুই লাখ টাকা হিমাগার খরচ সাশ্রয় হবে। তা ছাড়া এসব ঘর থেকে চাষি ইচ্ছেমতো আলু বিক্রি করতে পাবেন। কোল্ড স্টোরেজের আলু রাখলে অনেক সময় আলু মিষ্টি হয়ে যায়, কিন্তু এই ঘরে সে সুযোগ নেই। অহেতুক পোকামাকড়ের আক্রমণ, পচন ধরা ও গন্ধও ছড়ায় না।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
সারাবাংলা/এএসজি