ধর্ষণের ইতি টানতে শাস্তিই শেষ কথা নয়
১৫ মার্চ ২০২৫ ১৩:৪০ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫ ১৩:৪৩
দেশে বেশিমাত্রায় অপরাধ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই সময়ে। গুম, খুন, লুট, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, মামলা হামলা, অগ্নিসংযোগ, বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার সাথে যুক্ত হয়েছে জ্যান্ত মেরে ফেলা, প্রকাশ্য রাস্তায় ছুরি চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম কিংবা মৃত্যু নিশ্চিত করতে উপর্যুপরি আঘাত এবং গুলি করে টাকা স্বর্ণ লুটের ঘটনায় যখন রাষ্ট্রযন্ত্র খাবি খাচ্ছে ঠিক তখনই শুরু হলো একের পর এক ধর্ষণের মতো ঘটনা। যার বিভৎসতা দেখলে শিউরে উঠবে যে কেউ! প্রশ্ন জাগবে যে কারো মনে, আমরা এ কোন সমাজে বাস করছি! এই দেশ কি আমাদের? আমরা কি এমন দেশই চেয়েছি? প্রত্যাশা করেছি? যেখানে বিশ্বের মানুষ প্রযুক্তি জ্ঞান আহরণ করে শীর্ষে পৌঁছে গেছে রাতারাতি। আর আমরা পড়ে আছি প্রাগৈতিহাসিক যুগে কিংবা অনগ্রসর কালের কোন এক গহীন অরণ্যে ঘেরা অন্ধকার দুনিয়ায়। যদি না-ই হবে তবে এত এত ধর্ষণ ঘটনা কেনই বা ঘটতে যাবে? যেসব ঘটনার অধিকাংশই পরিচিত আত্মীয়স্বজন তথা নিকটজনের দ্বারা! তার চেয়েও বর্বরোচিত বিষয় হচ্ছে নিজ পিতা কর্তৃক ধর্ষণের মতো ঘটনা। যা বিবেককে নির্বিকার করে দেয় রীতিমতো! আমরা হেরে যাই। এ কেমন মানসিক বিকারগ্রস্ত চিন্তা লালন করে চলেছি আমরা? নিজ ঔরসজাত সন্তানও যদি ‘চোখের নজর’ এড়িয়ে বেড়ে উঠতে না পারে তবে কোথায় তারা নিরাপদ? আমরা কবে তাদের সেই বহুল কাঙ্খিত নিরাপদ পৃথিবী তথা এই পৃথিবীকে নিরাপদ করে বাসযোগ্য করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে দিতে পারবো? তা নিশ্চিত করেই বলি আমাদের দ্বারা হয়তো সম্ভবপর না-ও হতে পারে!
সম্প্রতি মাগুরায় ধর্ষণের শিকার ৮ বছরের শিশুটি ভগ্নিপতি ও বোনের শ্বশুর কর্তৃক এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটার অভিযোগ উঠেছে। দেশবাসী তথা পরিবারের উচিৎ হবে বাস্তবতা মেনে নিয়ে মানসপট শক্ত রাখা! সেই সাথে আমার মনে পড়ে গেলো, নির্মাণ কাজের জন্য খুঁড়ে রাখা গর্তে যখন শিশু জাহিদ পড়ে নিখোঁজ হলো, তখন আমরা দেখতে পেয়েছি, রাষ্ট্র কতো অসহায়! কারণ শিশু জাহিদকে উদ্ধারে কোন রকম সক্ষমতা তো দেখাতে পারেইনি, উল্টো আর কত শত গল্পের খোরাক জুগিয়েছে। কেউ বলেছে শিশু জাহিদ খাবার খেয়েছে, কেউ বলেছে জুস খেয়েছে, কেউ বলেছে কথা বলেছে। ফায়ারসার্ভিস তো শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারলোই না, বরং সন্দেহের তীর তারই পিতার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ তাকেই রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করতে মরিয়া যে শিশু জাহিদ সেই গর্তে পড়েনি! এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট গল্প! আদতে আমরা কি দেখতে পেলাম? যখন ফায়ারসার্ভিস উদ্ধারকাজ সমাপ্ত করলো তখনই একজন মেকানিক স্বীয় উদ্ভাবনী সত্তা কাজে লাগিয়ে কোন প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়াই বানিয়ে ফেললেন একটা রেকার। যার সাহায্যে শিশু জাহিদকে উদ্ধার করা সম্ভব হলো! আর পিতাও প্রশাসনের আক্রোশ থেকে বেঁচে ফিরলেন। তবে পুত্রশোকে আচ্ছন্ন হয়ে।
এখনও মেয়েটি গভীর কোমায় রয়েছে। মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে প্রতিনিয়ত। সে কি হেরে যাবে? আমরা কি সেই শিশু মেয়েটিকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবো? যদি বেঁচে ওঠে সেই মেয়েটি কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে? তাকে কি নিকট অতীতের বিভৎসতা তাড়া করে ফিরবে না? সেই প্রশ্ন তোলা থাক সময়ের খাতায়। আমরা চাই, প্রার্থনা করি মেয়েটি বেঁচে উঠুক। সমুদয় সত্তা নিয়ে মানবতাকে চপেটাঘাত করে জানান দিক, এই পৃথিবী শিশুদের নয়!
ইতোমধ্যে সারাদেশে একের পর এক ঘটনা প্রকাশ ও প্রচার পেতে শুরু করায় মানুষ শিশুদের বেড়ে ওঠা নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন। দাবি উঠতে শুরু করেছে, ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কেউ কেউ প্রকাশ্য শাস্তির দাবিও করতে শুরু করেছেন। চলছে প্রতিবাদ, মিছিল। তাতেও কি সরকারের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়ছে!
এদিকে একশ্রেণির ইউটিউব কিংবা ফেসবুক সর্বস্ব সাংবাদিক সময়ের ওপর থেকে দায় সরাতে বুলি আওড়াতে শুরু করেছে, ধর্ষণ আগেও হয়েছে, তবে খবর চাপা দেয়া হয়েছে। যা বর্তমানে হচ্ছে না। এই ধরণের উক্তি নির্ভরতা থেকে বোঝা যায়, তারা প্রকারান্তরে ধর্ষণকে হাল্কা করে উপলব্ধি করছেন। যদি না-ই হবে, তবে কেন এমন অগ্রহণযোগ্য কথা বলে অপরাধীকে অপরাধের পরিক্রমা থেকে পার পেতে সাহায্য করছেন। অতীতের যে কোন কৃতকর্মের দায় যদি বিগত সরকারের হর্তাকর্তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বর্তমান সরকারকে দায়মুক্ত করার কি সুযোগ থাকছে? নাকি এতে কাজের কাজ কিছু হবে? এই সিটিজেন জার্নালিজমের যুগে এখন আর মিডিয়ার ওপর নির্ভর করেও থাকতে হচ্ছে না, কোথাও কোন ঘটনা ঘটতে দেরি মিডিয়ায় আসতে দেরি নেই। তবে, তথাকথিত মিডিয়াও ভিউ ব্যবসায়ের ঘেরাটোপে পড়ে কবেকার ঘটনা কখন পাবলিশ করে তার কোন বাচবিচার ব্যতিরেকে শুরু হয় হৈ-হুল্লোড়! তথাকথিত সেইসব ইউটিউবার তথা ইনফ্লুয়েন্সাররা তাদের বিকৃত ইমেজকে ব্যবহার করে বিদেশে বসে দেশে দাঙ্গা লাগিয়ে গোঁফে তা দিয়ে হাসে। এই যদি হয় দেশের মানুষের বিবেকের বিবেচনাহীন উত্থান, তারে আর কি দিয়ে বধ করা যাবে?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারো বিরুদ্ধে যদি ধর্ষণ মামলা করা হয় তবে তার বিচার হয় ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি অনুযায়ী। দণ্ডবিধি’র ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া আছে। এই সংজ্ঞাটিই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে গ্রহণ করা হয়েছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী একজন নারীর প্রতি একজন পুরুষ যদি আইনে বর্ণিত পাঁচ অবস্থায় কোনো শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এরমধ্যে প্রথমেই রয়েছে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক করা। এরপরই রয়েছে, নারীর সম্মতির বিরুদ্ধে কিংবা মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্মতি আদায় করা। তবে কোনো নারীর বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে হয় তবে তার সম্মতি নেয়া হোক বা না নেয়া হোক, তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে। কোনো নারী যদি ভুল করে একজন পুরুষকে নিজের আইনসঙ্গত স্বামী ভেবে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সম্মতি দেন, এবং পুরুষটি জানেন যে তিনি তার স্বামী নন, আইনের দৃষ্টিতে এমন শারীরিক সম্পর্কও ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে।
তবে আইনটিতে কিছু অপ্রতুলতা বেশ লক্ষণীয়। কারণ এই ধরণের অসম্পূর্ণতার কারণে একই ধরণের অপরাধের শিকার হয়েও বিচারবঞ্চিত থাকছে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী! প্রশ্ন উঠতে পারে কে বা কারা এই ধরণের জনগোষ্ঠী? আসা যাক আলোচনায়, দেশে বিদ্যমান আইনে জোরপূর্বক কোন পুরুষকে কিংবা কোন ছেলে শিশুকে যদি আরেক পুরুষ পায়ুপথের মিলনে বাধ্য করে তবে সেটা বলাৎকার হিসেবে বিবেচিত। এই অপরাধের ধারা হচ্ছে দণ্ডবিধির ৩৭৭। কিন্তু ইতোমধ্যে দাবিও উঠতে শুরু করেছে, কোন নারী যদি কোন সক্ষম পুরুষকে জোরজবরদস্তি মিলনে বাধ্য করে সেটা কেন ধর্ষণের মতো অপরাধ হবে না? তাই আইনটি সংস্কারের দাবি উঠতে শুরু করেছে। আবার কোন প্রাপ্তবয়স্ক নারী যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক কোন শিশুর সাথে যৌন মিলন করে সেক্ষেত্রে কেন ধর্ষণ হবে না? অনেকসময় আমরা দেখি পিতামাতা চাকুরীজীবী হওয়ায় সন্তানের দেখভাল করার জন্য একজন গৃহপরিচারিকাকে পরিবারে এনে দায়িত্বে রাখেন। তখন সেই নারীটি যদি চাকুরীজীবী দম্পতির সন্তানের সাথে লালসাস্বরূপ মিলন করে তাহলে কেন ধর্ষণ হবে না? এমন ঘটনা হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। যা মিডিয়াতে ফলাও করে ছাপা হয়ে থাকে। অন্যদিকে অনেক পুরুষ এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়েও বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে চেপে যান। আবার উল্টো দায়ে উল্টো অভিযোগের তীর পরিবারের সেই পুরুষটির দিকে ছুটে এলে সম্মানহানিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে বলেই এড়িয়ে যান। তাই বলে এই সংখ্যা নেহায়েত কম নয়!
এরই মধ্যে দাবি উঠতেও শুরু করেছে, বলাৎকারকে ‘পুরুষ ধর্ষণ’ গণ্য করতেও উচ্চ আদালতে রিট করার খবরও খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় সম্প্রতি রিটটি করেন। মানবাধিকার কর্মী তাসমিয়া নূহাইয়া আহমেদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক ড. মাসুম বিল্লাহ এবং সমাজকর্মী ড. সৌমেন ভৌমিকের পক্ষে তিনি রিটটি দায়ের করেন। রিটকারীদের ভাষ্য মতে দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় নারী ধর্ষণের অপরাধের পাশাপাশি ‘পুরুষ ধর্ষণকেও’ অপরাধ হিসেবে সংযুক্ত করতে এই ধারাটির সংশোধন চেয়েছে।
রিটের বিষয়টি নিশ্চিত করে ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, ‘সম্প্রতি দেশে ছেলে শিশু তথা পুরুষকে যৌন নির্যাতন ও বলাৎকারের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু এই ধরনের নির্যাতনকে ধর্ষণের অপরাধ হিসেবে বিচার করা যাচ্ছে না। তাই দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় সংশোধন এনে ‘নারী ধর্ষণ’ এর অপরাধের পাশাপাশি অপরাধ হিসেবে ‘পুরুষ ধর্ষণ’ বিষয়টিকে যুক্ত করার আবেদন করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, রিটে দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে পুরুষ কর্তৃক শিশুদের বলাৎকারকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করে এ ধরনের অপরাধ ধর্ষণের মতোই শাস্তিযোগ্য যাতে করা হয়। সেটি আমরা চাই। তাহলে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার, অহরহ ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে দুয়েকটা হয়তো পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। অন্যটা আসে না। অথবা আসতে দেয়া হয় না। কেউ সামাজিক পারিবারিক সম্ভ্রমের কথা চিন্তা করে, অন্যরা গ্রামের মাতবরদের কথিত শালিস(নেপথ্যে বাণিজ্য) এর কারণে ধামাচাপা দিতে বাধ্য হয় পরিবার। না হলে নেমে আসে ‘একঘরে’ করে রাখার অতিপরিচিত শাস্তির খড়্গ! আর এতেই দমে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবার চাইতে পারে না বিচার। দিতে পারে না নালিশ। গুমরে কেঁদে মরে আরও কেউ কেউ!
এদিকে প্রতিবেশী কর্তৃক ২০ বছরের যুবক ধর্ষিত মর্মে গত ১২ মার্চ কালের কন্ঠ পত্রিকায় সংবাদ করেছে। যার বিবরণ থেকে জানা যায়, রাস্তা থেকে ডেকে নিয়ে ২০ বছরের এক যুবককে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার শাহী মসজিদ পল্লী বিদ্যুৎ রোড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।ধর্ষণের শিকার ওই যুবকের মা বাদী হয়ে সোমবার (১০ মার্চ) রাতে বন্দর থানায় মামলা করেছেন। এধরণের কয়টা ঘটনা নিয়ে ঠিক মামলা হয়?
নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণের বিচারের দাবিতে ঢাবিতে মানববন্ধন করেছে “এইড ফর মেন ফাউন্ডেশন”। তেমনই খবর প্রকাশ করেছে দৈনিক সংবাদ নামক প্রাচীণ পত্রিকাটি। যা গত ৮ জানুয়ারী, ২০২২ তারিখের। খবরটির শিরোনাম দেখলে চোখ তো কপালে উঠবেই সাথে বিশদ পড়লে শিউরে উঠবে যে কেউ! জেনে নেয়া যাক কি সেই খবরের বৃত্তান্ত, গাজীপুরের ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন একাধিক কিশোর ও যুবককে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে, ‘ধর্ষক’ ফিরোজা নাজনীন বাঁধনের (৩৫) দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, আইনে ধর্ষণের লিঙ্গ-নিরপেক্ষ সংজ্ঞা এবং দন্ডবিধি ৩৭৫ ধারার লিঙ্গনিরপেক্ষ সংস্কার চেয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে “এইড ফর মেন ফাউন্ডেশন” নামের একটি সংগঠন। মানববন্ধনে বক্তারা নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের বিচার দাবি করেন। স্পষ্টতই এই ঘটনার ভিকটিম এক বা একাধিক পুরুষ! আর যিনি ঘটিয়েছেন তিনি একজন নারী! তাহলে প্রশ্ন করার যথেষ্ট সুযোগ থাকছে, নারীরাও যৌন নিপীড়ন করে থাকতে পারে বা করেও। আর এটা বাস্তবতা। ভুক্তভোগীদের মানববন্ধনটি রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে করা হয়েছিল। যা জনাকীর্ণ এলাকায়। তাহলে এমনটা ভাবার অবকাশ নেই যে, গোপনে কিংবা কোন গোপন স্থানে মানববন্ধন করে কাউকে অপবাদ তথা ভিকটিমাইজ করার সুযোগও কম থাকে। জানা যায়নি সেই ঘটনাসমূহের জন্য যাকে দায়ী করা হয়েছিল, তিনি কি কোন প্রতিকারপ্রার্থী কিংবা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কি-না!
এইড ফর মেন ফাউন্ডেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আহ্বায়ক মাহিন মূর্তজা বলেন, একাধিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি যে, গাজীপুরের “ভাওয়াল মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রে” আশ্রিত অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের উপর পাশবিক যৌন নির্যাতন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফিরোজা নাজনীন ওরফে বাঁধন (৩৫)। এছাড়াও চিকিৎসা দেওয়ার নামে, পছন্দের পুরুষ রোগীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের সাথে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার এই বিকৃত আচরণ ও জঘন্য অপরাধকে ‘ধর্ষণ’ ব্যতীত অন্যকিছু বলার সুযোগ নেই। একজন ধর্ষক, ধর্ষণের অপরাধের জন্য যেই শাস্তি পান, ফিরোজা নাজনীন বাঁধনকেও একই শাস্তি প্রদান করার দাবি জানাচ্ছি।”
ব্রিটেনের ল্যাংক্যাস্টার ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর সিওভান উইয়ার একটি গবেষণায় দেখান নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণ সম্ভব। বরং অসম্ভব মনে করাটাই একটা মিথ বা কাল্পনিক উপকথা। উক্ত গবেষণাটি ২০১৭ সালে প্রতিবেদন আকারে বিবিসিতে প্রকাশিতও হয়েছে।
এ সংক্রান্তে বিবিসি নিউজ বাংলা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে উঠে এসেছে আরও কিছু তথ্য। প্রতিবেদনটিতে বিবিসি উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে এরকম ছেলেশিশুর উপর যৌন র্নিযাতনের ঘটনা বিভিন্ন সময়ই শোনা যায়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১১ জন ছেলেশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিলো ৯ জন। আর ২০১৭ সালে ১৫ জন। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ বলেই মনে করে শিশু অধিকার সংগঠনগুলো।
বেসরকারি শিশু সংগঠন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সে’র নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা মনে করেন, বাংলাদেশে সামাজিকভাবেই ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের বিষয়ে একধরণের নিরবতা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে।
ছেলেশিশু ধর্ষণের মামলা কোন আইনে? নিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুর বাবা তার ছেলেশিশুর ধর্ষণের ঘটনায় থানায় যে মামলাটি করেছিলেন সে মামলাটি দায়ের হয়েছিলো দণ্ডবিধির-৩৭৭ ধারায়। অথচ মামলাটি হওয়ার কথা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। কারণ ৩৭৭ ধারায় শিশুর উপর যৌন নির্যাতনের বিষয়ে কোন বক্তব্য নেই। ধারাটি মূলত: প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে স্বেচ্ছায় যৌন সঙ্গম বা সমকামিতার অপরাধ বিষয়ে। কিন্তু নারী কর্তৃক পুরুষের প্রতি ধর্ষণের বিষয়টি কোন আইনেই সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। তার মানে কি এসব অপরাধ ঘটছে না? নিশ্চয়ই ঘটছে! উপরের আলোচনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বলা যায় মূলতঃ বহুবিধ কারণে বিষয়টিকে একজন পুরুষ এড়িয়ে যেতে চান। যা কাম্য নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যা-ই কিছু ঘটুক না কেন তা-ই অপরাধ। আর এ ধরণের অপরাধের প্রতিকার না চাইতে থাকলে মহামারী আকারে ছড়িয়ে যেতে পারে!
এদিকে ১৩ মার্চ বাংলাদেশ আর্মির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জানানো হয়েছে মাগুরার সেই শিশু মেয়েটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। একই দিন সকালে পরপর ৩বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হয়ে ৩য় বার তার জ্ঞান ফিরেনি। শিশুটি এই রঙিন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরতরে অনন্ত অসীমের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছে। আমরা শোকাহত হয়েছি। স্তম্ভিত হতে হয়েছে! বিবেকের পর্দা ভেদ করে পৌঁছে না এমন এমন ঘটে যাওয়া আরও কত শত ঘটনাপঞ্জী। নিশ্চয়ই সে মহান স্রষ্টার কাছে নালিশ করেছে ততক্ষণে ওই মানুষরূপী অমানুষগুলোর বিরুদ্ধে! আমরা সেই পিশাচদের শাস্তি চাই। আইনানুগভাবে এর বেশি আর কিইবা চাওয়ার থাকতে পারে? আল্লাহ শিশুটিকে জান্নাতের বাসিন্দা হিসেবে নিশ্চয়ই কবুল করবেন। আমীন।
তা-ই সকলকেই সোচ্চার থাকতে হবে, শাস্তি দিয়েই অপরাধ থেকে নিবৃত করা যায় না। সামাজিক পারিবারিক সচেতনতা বাড়াতে এবং যাদের মিধ্যে এ ধরণের অপরাধ প্রবণতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যাবে তাদের শুরুতেই প্রতিহত করার ব্যবস্থা করে এর বিরোধী বলয় তৈরি করা। যাতে করে অপরাধী মাত্রই বুঝতে পারে যে, অপরাধ করে হয়তো আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যেতে পারে কিন্তু সমাজের মানুষজন তাকে ঠিকই চিহ্নিত করেছে, সে নিপীড়নকারী, যৌন হেনস্তাকারী, সে ধর্ষক, সে বলাৎকারকারী, সে ইভটিজার! এতে করে অপরাধ করতে যাওয়া লোকটির মনের ভেতর হয়তো প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। আর এতে করে সে ভালো পথে ফিরেও আসতে পারে। তবে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তিই কাম্য, কিন্তু তড়িঘড়ি বিচার-প্রক্রিয়ার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিও যাতে ন্যায়বিচার বঞ্চিত না হয়! চাঞ্চল্যকর মামলায় মিডিয়া ট্রায়ালের ঝুঁকিতে যেন নিরপরাধ কাউকে শাস্তির খড়্গ পোহাতে না হয়। সর্বোপরি রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা কাম্য। অন্যথায় অপরাধ পরিক্রমার কারণে মানুষের ভেতর আক্রোশ জমে নিজেই বিচার করার প্রবণতায় আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে। এতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে। যা সুখকর নয়।
লেখক: অ্যাডভোকেট ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি