আবেগের কাছে বিবেক হারানো যাবে না
১৫ মার্চ ২০২৫ ১৫:১১
এবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবস- ২০২৫ এর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন; নারী ও কন্যার উন্নয়ন’। এই প্রতিপাদ্য এবারের নারী দিবসের সঙ্গে একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়, ছিল না। সাত মাস আগের জুলাই-আগস্টের লাল গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া নারীদের এখন প্রধান সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে নিরাপত্তা। নারীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে অধিকার, সমতা আর ক্ষমতায়ন; সবই কাগুজে গল্প। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে আসছে মেয়েদেরকে মাতালের বেশে, উন্মাদের বেশে হেনস্থা করা হচ্ছে, লাঠি দিয়ে মারা যাচ্ছে; এমনকি কোনো কারণ ছাড়াই। এতে করে এটা স্পষ্ট যে, নারী সমাজের এখন রাস্তাঘাটে বের হওয়াই এখন আতঙ্কের কারণ হয়ে গেছে। কেন হঠাৎ করে কিংবা সাত মাসের মধ্যেই এটির আস্ফালন কেন? সে প্রশ্ন তো আছেই বটে।
এছাড়া ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন, পিতা কর্তৃক, চাচা কর্তৃক, মামা কর্তৃক কিংবা আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক এমন সব ঘটনার খবর আসছে প্রতিনিয়ত। এতে স্পষ্ট যে, সমাজের একটা বড় অংশের নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে। মনুষ্যত্ব বিসর্জন গেছে। কেবল ধর্ষণই নয়, বাংলাদেশে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি বহু পুরনো। দৃষ্টান্তমূলক কিংবা ন্যায়বিচার; দুইটার যে কোনো একটা হয়েছে সেই উদাহরণ খুবই কম। ব্যতিক্রম ঘটনা আছে খুবই কম। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই কৃত্তিকা ত্রিপুরা, তনু হত্যা, নোয়াখালীর সুবর্ণচরের বিভৎস ঘটনাগুলো ঘটেছিল। অজানা রয়ে গেছে আরও কত ঘটনা। সেই দিনগুলিতে মিছিল-মিটিং, সমাবেশ-বিক্ষোভে শেষ নয়, লংমার্চ পর্যন্ত টানা হয়েছে। লংমার্চে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এত এত জনক্ষোভ প্রকাশের পরও বিচারের বাণী নিভৃতেই কেঁদেছে।
সাম্প্রতিক সময়ের বিভৎস ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে দেশের মানুষ আপ্রাণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে। নানাভাবে সামাজিক অবক্ষয় নিবারণের চেষ্টা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জুলাইয়ের মতন সরব হচ্ছে বিক্ষোভ-প্রতিবাদে। এত এত জনক্ষোভের মধ্যেই নতুন নতুন ধর্ষণের ঘটনা আসছে। যেন ফেসবুক স্ক্রল করলেই একেকটি ঘটনা আসছে। মানুষের এই প্রতিবাদ, ঘৃনা প্রকাশের প্রতি আমার জোর সমর্থন আছে অতীতের মতন।
তবে কয়েকটি এলাকায় ধর্ষণের আসামির পক্ষে আইনজীবী আদালতে দাঁড়ানোয় তোপের মুখে পড়েছে, গণমারধরের শিকার হয়েছে। আইনজীবী হলে আমি নিজেও এমন আসামির পক্ষে দাঁড়াতাম না। অর্থই জীবনে সব না। নীতি-অনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অর্থ উপার্জনই সব নয়। কিন্তু এই ব্যাখ্যা সবার ক্ষেত্রে একও নয়। ধর্ষণের আসামির পক্ষে আদালতে দাঁড়ানোকে কেন্দ্র করে জনরোষ তৈরি ভিকটিমের প্রতি, ন্যায্যতার প্রতি জনতার এক ধরণের সমর্থনও। কিন্তু এটা যদি দীর্ঘস্থায়ীভাবে চলতে থাকে সেখানে সমাজে আরও বিশৃঙ্খলা বাড়বে।
এই আলোচনাটা একটু ক্রিটিক্যালই। এর আগে, সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে কিছু আলোচনা আছে। যেমন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অর্থাৎ আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আইন হচ্ছে, ধর্ষণের আসামির জামিন হবে না, বিচার হবে ৯০ দিনের মধ্যেই। তদন্ত হবে ১৫ দিনের মধ্যেই’। মূলত আলোচনাটা এটাকে ঘিরেই। বাংলাদেশের গ্রামীণ কিংবা শহুরে সমাজ ব্যবস্থা এতটা অগ্রসর হয়নি, আইন মন্ত্রণালয়ের আশু সিদ্ধান্তকে নৈতিকভাবে নেওয়ার মতো। এই আইন যদি কার্যকর হয়, সেক্ষেত্রে বিশেষত গ্রামে-গঞ্জে ধর্ষণের মামলা বেড়ে যাবে। যার একটা বড় অংশই আসবে ভুয়া মামলা। যেহেতু জামিন অযোগ্য মামলা, সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের একটা সুযোগ। এবং যতদূর জানি, আদালতের বিচার হয় সাক্ষী আর প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে ভুয়া সাক্ষী, ভুয়া মামলায় জেলে অন্তরীণের সংখ্যাও বাড়ার আশঙ্কা আছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনার তদন্ত ১৫ দিনে সম্ভব নয়। ৯০ দিনে সাজা নিশ্চিত করা হলে নিরাপরাধ ব্যক্তিও অবিচার পেতে পারেন; সেই সুযোগ তৈরি হবে এবং এই দায়ও কিন্তু তখন রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
ধরুন, আপনাকে কেউ একজন জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ধর্ষণের মামলা দিল। ধরে নিন মামলাটি মিথ্যা মামলা। সেক্ষেত্রে আপনি কী বিচার কাজ শেষ না পর্যন্ত হওয়া জামিন নিতে পারবেন না বা চাইতে পারবেন না। যদি না পারেন তাহলে সেক্ষেত্রে আপনার সঙ্গেও তো ন্যায়বিচারের বদলে অবিচার হবে। ধরুন এখন যেভাবে ধর্ষণের আসামির আইনজীবীর ওপর মব হচ্ছে, এটি যদি চলমান থাকে সেক্ষেত্রে সামনের দিনে কী হতে পারে? আপনার কেউ কী দাঁড়ানোর সাহস পাবে? সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রসঙ্গ এনে এক্ষেত্রে কিছুটা উদাহরণমূলক হতে পারে। সাইবার নিরাপত্তা আইনের নামে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়েছে, হাজার হাজার মামলা এখনো ঝুলে আছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ভিকটিমের বছর যাচ্ছে আদালতের বারান্দায়-বারান্দায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই আইনটি বাতিলের কথা জানালেও এখনো সেটি বলবৎ আছে।
তাই বস্তুত, সরকারের উচিত হবে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা করনীয়নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আগে আলোচনা করা। যে কোনো বিষয়ের ওপর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে সামনে রেখে অগ্রসর হওয়া। একই সঙ্গে সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি, বিশেষত স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় এসব নিয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরা। আর সবচেয়ে যেটা বেশি জরুরি, ধর্মীয় ওয়াজ-মাহফিলসহ অন্যান্য সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নারী বিদ্বেষীবক্তব্য আইন করে বন্ধ করা। ৯০ দিনের মধ্যে বিচারের খবর দিয়ে, জামিন অযোগ্য ধারা তৈরি করে সমাজের পশুদের সংবর্ধনা দেওয়া সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করা এতটা সহজলভ্য হবে না। সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। সরকার দৃষ্টান্ত দেখাতে গিয়ে বড় বড় দৃষ্টান্তের ইতিহাসের সৃষ্টি যেন না হয় সেই প্রত্যাশা। দিনশেষে আবেগের কাছে বিবেককে হারাতে দেওয়া যাবে না।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এএসজি