একটি দেশের সহজাত মেধা যেখানে থেমে থাকে
১৫ মার্চ ২০২৫ ১৫:৩৪
সহজাত মেধা, যাকে ইংরেজিতে ইনেইট ট্যালেন্ট বলা হয়। পৃথিবীতে অনেকে আছেন যারা ইনেইট ট্যালেন্ট নিয়ে জন্মায়। আমাদের মাঝে অনেকেই কোনদিন আঁকার স্কুলে যায়নি কিন্তু ভালো আঁকতে পারে। অনেকে ভালো লিখতে পারে অথচ কোনদিন লেখার কোন কর্মশালা করেনি। গানের ওস্তাদের কাছে না গিয়েও ভালো গাইতে পারে। সচরাচর এমন ঘটনা আমাদের চারপাশেই দেখা যায় বা ঘটে থাকে। অনেক কিছু না শিখেই করতে পারে। আর এটাই হচ্ছে সহজাত মেধা বা ইনেইট ট্যালেন্ট । কিন্তু আমাদের দেশের মতো একটি দেশে যখন কোন একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভালো নম্বর না পেয়ে থাকে, তখন তাকে মেধাবী বলা হয় না। আসলে মেধার সংজ্ঞাটা কি এমনই হওয়া উচিত যেখানে পরীক্ষার বেশি বা কম নাম্বার পাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে? যে সমাজ এ ধরনের মেধাকে পরীক্ষা নম্বর দিয়ে বিচার করে সে সমাজ মূলত মেধাকে ধ্বংস করছে। মূলত একটি সম্ভাবনাকে গলাটিপে মেরে ফেলার মতই। অনেকেই আছেন যারা পরীক্ষায় ভালো লিখতে পারেন না, কিন্তু তারা ভালো ভাবতে পারেন। এমন এমন আইডিয়া তাদের থেকে বের হয় যা অবিশ্বাস্য। আমাদের শিক্ষাজীবনে চিন্তার সুযোগ খুবই কম। তেমন একটা ভাবারও সময় নেই। পরীক্ষা এলেই শর্টকাট সাজেশনস আর মুখস্থ। চাই বেশি নম্বর। এই নম্বরে খেতাব নিয়েই পরিবার ও সমাজকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়। নইলে মুখ দেখাবার সম্মানটুকু থাকে না। এই অচ্ছেদ্য চক্রের মধ্যে বন্দী করে রেখে, হাজার হাজার মগজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। থেমে যাচ্ছে একটি সম্ভাবনা। যেই সম্ভাবনা একটি জাতিকে দিতে পারে নতুন কিছু ডিজাইন। প্রসঙ্গের কারণে প্রশ্ন আসতেই পারে। আমরা সহজাত মেধার ছেলেমেয়েদের কিভাবে বাছাই করব? তরুণ বয়সে বাছাই করে বিভিন্ন রিচার্জ প্রজেক্ট বা গবেষণা সুযোগ করে দেওয়া। যেখান থেকে তারা একটি সৃষ্টিশীলতার দিকে এগিয়ে যাবে। তাদের ধৈর্য এবং আগ্রহকে পর্যবেক্ষণ করেও এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। যখন আমরা ১০ থেকে ১৫ বছর বছরের শিশুকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বপ্ন দেখাই তখন তার মগজে পরীক্ষায় ভালো নম্বর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নটুকু থেকে যায়।
এ ছাড়া দ্বিতীয় কোন চিন্তায় তার মগজে আসে না। আমরা শৈশব থেকেই কম নম্বরের ও বেশি নম্বরের ব্যর্থতা ও সফলতার গল্প শোনাই। কম পেলে তুমি ব্যর্থ এবং বেশি পেলেই তুমি সফল। কিন্তু এই শিশুর ভেতরে যে একটি সহজাত মেধা লুকিয়ে আছে সেটা আমরা কতজনই ভাবি বা দেখি। যখন বেশি নম্বরে পাল্লায় পড়ে একটি শিশু মুখস্থ বিদ্যার দিকে ধাবিত হয়, আর মুখস্থকরণ যখন বছর কয়েক চলে, তখন তার মগজ একটা ধারার নির্ভরশীল (Dependent) হয়ে যায়। সে মগজ দিয়ে আর বড় কিছু ভাবতে পারেনা। আর ভাবতে পারলেও তার ভিতরে একটা ক্লান্তিকর বিষয় থেকে যায়। কি ভয়ংকর একটি মেধার দিকে আমরা সম্মুখীন হচ্ছি।
মুখস্থ বিদ্যায় ভালো ফলাফল করার চাইতে বুঝে শুনে পড়াটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। একজন প্রবীণ শিক্ষক বলেছিলেন, আজকাল ছেলেমেয়েরা প্রশ্ন করার চাইতে শুনতে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু তারা প্রশ্ন করে না। বারবার বলা হয় তোমরা প্রশ্ন করতে শেখো। যা পড়াচ্ছি তা বুঝে শুনেই পড়। কিন্তু তিনি আফসোস করে বলেছিলেন, মুখস্থ বিদ্যায় ভালো ফল চাই ভালো ফল। না এখানেও থেমে থাকেনি। একেকজনের কয়েকটা গৃহ শিক্ষক থাকার পরেও শিক্ষার যে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল সেটা পাওয়া পাচ্ছে না।একজন কিশোর বয়সের স্টুডেন্ট বহু কারণে পরীক্ষায় কম নম্বর পেতে পারে। সে বয়সে তার শারীরিক পরিবর্তন হয়। মনোজগতের একটা পরিবর্তন হয়। এটা অনেক প্রভাব ফেলে। আর এই পরিবর্তনটাই জীবনে একবারই আসে। এছাড়া একজন শিক্ষার্থীকে গণিত, বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, সমাজবিজ্ঞান ধর্ম, কৃষি শিক্ষা ইত্যাদি বহু বিষয় পড়তে হয়। এই বিষয়গুলো থেকে কেউ হয়তো একটি বিষয় বা দুইটি বিষয়ে নাম্বার কম পেয়ে যায়।তারমানে এই নয়, সে খুব খারাপ শিক্ষার্থী। শিক্ষা জীবনটা অনেক বড়। এখানে লেগে থাকাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের জীবন একটি -দুইটি পরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। জীবনে চলার পথে পরীক্ষার ভালো করার চেয়ে পরীক্ষার মুখোমুখি হয়, নির্ভয়ে মোকাবেলা করাই সবচেয়ে বড় সফলতা!
বর্তমান দেশের তরুণরা বিদেশমুখী বেশি ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। দেশের শিক্ষিত যুবকেরা পাড়ি জমাচ্ছে ভিন্ন কোন দেশে। আর সে দেশেই তারা শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সে দেশেই রয়ে গেছে।দুনিয়াতে কেউ যখন কোন কিছুতে সমস্যা দেখে, কেউ দেখে সম্ভাবনা। আমরা যেটাকে বলি ব্রেইন ড্রেইন, চীন সেটাকে বলে ব্রেইন গেইন।চীন সরকার চায়, তাদের দেশের ছেলে মেয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ুক। সে লক্ষ্যেই তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। চীন সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মেধাবী তরুণদের ইউরোপ আমেরিকা পাঠায়। আর যখন তারা একটি নির্দিষ্ট রিসার্চ সেন্টার থেকে নতুন নতুন কিছু আবিষ্কার করা শিখে। এবং চীন সরকার মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বহু প্রকল্প চালু করে থাকেন। সেই মেধাবীরা দেশে ফিরে এসে প্রকল্পের জন্য আবেদন করেন। এতে চীনের তরুণ গবেষকরা নিজ দেশে কাজের জন্য সুপারিশ পেয়ে থাকেন। শুধু চীন নয়।চীন ছাড়াও অন্যান্য দেশেও এ প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। আমাদের দেশেও ঠিক এরকম হওয়া উচিত। যাতে আমরা বড় বড় প্রকল্পগুলো আমাদের মেধাবীদের হাত থেকেই হয়ে থাকে।তা ছাড়া যে সমাজ তার সম্ভাবনাকে পরিচর্যা করে না, সে সমাজ একটা সম্ভাবনাকে খুন করছে। শিক্ষা গবেষণা জোর দিয়ে আজ ভারত, চীন এবং অন্যান্য দেশ শক্তিশালী হচ্ছে।আমাদের দেশেও সে সম্ভাবনা অফুরান। দেশের ছেলে মেয়ে প্রচুর সহজাত মেধা ও আগ্রহী, পরিশ্রমী। সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই বাংলাদেশ যেন সে লক্ষ্যেই এগিয়ে যাবে এমনটা আশাবাদী।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাউবি
সারাবাংলা/এএসজি