সুন্দরবন: দক্ষিণ পশ্চিমের ভরসারস্থল
১৩ মার্চ ২০২৫ ১৭:০৪ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫ ১৭:০৬
বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সুন্দরবনের বৃহদাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। আমরা যদি বর্তমান সময় থেকে শুরু করি তা হলে দেখা যায় যে বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির উপর আমরা নির্ভরশীল এবং সুন্দরবন অক্সিজেন ও কার্বনের এক সুবিশাল ভাণ্ডার। প্রাণীর জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের আদান-প্রদানের মাধ্যমে সুন্দরবন স্থানীয় জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। কিন্তু আমরা তাকে কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছি- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সারাদেশে বনভূমি যেখানে ২৫% থাকার কথা তা এখন ১০%-এর নিচে নেমেছে, যা এক মহাবিপদ সংকেত বলে বিবেচিত। সংরক্ষিত বনাঞ্চল মধুপুরের গড় ও ভাওয়ালের গড়সহ বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে- যা রক্ষায় এখনই ভাবনার সময়। এদিকে সুন্দরবন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী একটি বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বনভূমি। বঙ্গোপসাগরের উত্তরে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার উপকুলীয় অঞ্চলে সুন্দরবনের প্রধান অংশ অবস্থিত। এর মোট আয়তনের প্রায় ৬২% বাংলাদেশ অংশে।
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র
এটি পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল। এখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমির, বানর, উভচর প্রাণীসহ বিভিন্ন প্রজাতির বিরল ও বিপন্ন প্রাণীর বসবাস। এই বনে ৩২২টিরও বেশি প্রজাতির মাছ, প্রায় ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাস রয়েছে। এছাড়া, সুন্দরবনে ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে, যা এর পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। জলজ, প্রাণিজ ও বনজ সম্পদের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ সুন্দরবন। এটি বিশ্বের অন্যতম লবণাক্ত বনাঞ্চল (ম্যানগ্রোভ বন)। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা সুন্দরবনকে বৈচিত্র্যময় করেছে উজানের জলপ্রবাহ, লবণাক্ত সামুদ্রিক স্রোতধারা ও কাদা চর। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি সেসব প্রাকৃতিক সম্পদ অবদান রাখে দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে।
সুন্দরবন কেন্দ্রীক অর্থনীতি ও পরিবেশ
‘সুন্দরবন সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ বনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কমপক্ষে ৩৫ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। এছাড়া সরকার প্রতি বছর এ বন থেকে মোট বনজ রাজস্বের ৪১ শতাংশ আহরণ করে এবং উপকূলীয় এলাকার মানুষের জ্বালানি কাঠ সরবরাহ করে। সুন্দরবন গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় বদ্বীপ অঞ্চলে। ফলে বদ্বীপ অঞ্চলের গঠন প্রক্রিয়া প্রভাব বিস্তার করে সুন্দরবনের ওপর। দিনে দুবার জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হয় এ বনের নদী-খাল। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জোয়ারের চেয়ে চলমান সময়ে ভাটার ¯স্থয়িত্ব দীর্ঘ সময় থাকে। এছাড়া পলি জমে জায়গা ভরাট হওয়ায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। ফলে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। অবশ্য নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া এবং শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে ভারতের ফারাক্কা বাঁধসহ নদীর আন্তঃসংযোগমূলক প্রকল্পগুলোর দায়কে অস্বীকার করা যায় না। এ নাব্য সংকট আগামীতে আগুনের ঘটনা বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ বনের চারপাশে মানুষের বসতি। ফলে বন উজাড়ের নজিরও কম নয়। নগরায়ণ, বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, বনসম্পদের (কাঠ, কাঁকড়া, ঝিনুক ইত্যাদি) অতি আহরণ বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে সুন্দরবনকে। এছাড়া নৌপরিবহন ব্যবহার ত্রুটি এ সংকট আরো গভীর করেছে। সুন্দরবনের পাশে বয়ে চলা নদীতে জাহাজ ডুবে তেল, ফার্নেস ওয়েল, ফ্লাই অ্যাশ, কয়লা, সারসহ রাসায়নিক দ্রব্যে নদীর পানি দূষিত করে এবং বনের জলজ প্রাণীদের জীবন বিপন্ন করে। এছাড়া পলি জমে নদীর অববাহিকা ভরাট হলে সেখানে মানুষ দখলদারিত্বের মাধ্যমে বসতিসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করছে। সুন্দরবন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি প্রাকৃতিক ঢাল। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস এবং সামুদ্রিক ঝড়ের সময় সুন্দরবনের ঘন বৃক্ষরাজি বাফার জোন হিসেবে কাজ করে। এর ফলে উপকুলীয় এলাকার জনবসতি, চাষাবাদ ও অবকাঠামো ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। সুন্দরবন যে পরিমাণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করে, তার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা কঠিন। সিডর, আইলা ও আম্ফানের সময় সুন্দরবন না থাকলে উপকুলীয় অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কয়েক গুণ বেশি হতো। সুন্দরবন থেকে মধু, কাঠ, গোলপাতা, মাছ ও কাঁকড়াসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা হয়, যা লাখো মানুষের জীবিকার উৎস। পর্যটন খাতেও সুন্দরবনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবছর দেশীবিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু সুন্দরবন আজ নানা রকম হুমকির মুখে পড়েছে, যার বেশিরভাগই মানবসৃষ্ট। সুন্দরবনের কাঠ ও গোলপাতার ব্যাপক চাহিদার কারণে প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ সুন্দরবনের বিরল প্রাণীগুলোর শিকার ও পাচার এই বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি। সুন্দরবনের আশপাশে শিল্পকারখানার বর্জ্য ও তেল নিঃসরণ সরাসরি নদীতে পড়ায় জলজ পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, এতে মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনচক্র ব্যাহত হচ্ছে। সুন্দরবনের কাছাকাছি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সুন্দরবনে আগুন: একটি সমস্যা
বাংলাদেশের ফুসফুসখ্যাত ওয়াার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবনে গত ২২ বছরে ২৪ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জের মধ্যে কেবল শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে আগুন লাগে না, লাগানো হয় তা নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।বনে আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে প্রতিবার করা হয় তদন্ত কমিটি। তবে বনের সুরক্ষায় তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো থেকে যায় ফাইলবন্দি। বন বিভাগের হিসাব মতে, কেবল শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের বিভিন্ন ¯’স্থানে ২৩ বার লাগা আগুনে পুড়েছে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমি। সর্বশেষ এবারকার আগুন লাগার ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়নি। প্রতিবার আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান ক্ষতি নিরূপণ ও ভবিষ্যতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। তবে সেসব তদন্তের প্রতিবেদন ও দুর্ঘটনা এড়াতে করা সুপারিশগুলো বাস্তবায় হতে দেখা যায়নি। সুপারিশ হলো সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া নদী খাল খনন, অগ্নিকান্ড প্রবণ এলাকার প্রতি দুই কিলোমিটার পর পর ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে নজরদারির ব্যবস্থা।করা খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ড এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের জোরালোভাবে এবং ভোলা নদীর পাশ দিয়ে কাঁটাতার অথবা নাইলনের রশি দিয়ে বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এ বিষয়ে সেফ দ্যা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান বলেন, সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষার জন্য লোকালয় সংলগ্ন নদীখাল খনন ও কাঁটাতারের বেড়া দেওযা জরুরি। একই সঙ্গে বন অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে বনরক্ষীদের তৎপরতা বৃদ্ধি করা ও অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সুন্দরবনকে রক্ষায় কতিপয় বিষয়
সুন্দরবনের নদী অববাহিকায় যেসব জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া হতে পারে সুন্দরবন রক্ষায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। সেসব জনগোষ্ঠীকে বিকল্প কর্মসংন্থানের ব্যবস্থা করে দিতে পারলে বনের ভেতরে মানুষের আনাগোনা কমবে। বনজ সম্পদ আহরণের চাপ কমবে। এতে বন উজাড়ও রোধ করা সম্ভব হবে। অসৎ ব্যবসায়ীদের রুখতে এ পদক্ষেপ সহায়ক হতে পারে। সারকথা, সুন্দরবনকে বাঁচাতে ও সমৃদ্ধ রাখতে বন বিভাগকে যাবতীয় সুপারিশ বাস্তবায়নে আশু পদক্ষেক নিতে হবেসুন্দরবন সংরক্ষণে বন বিভাগের কার্যক্রমকে আরও কার্যকর ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। ড্রোন ও স্যাটেলাইট মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। অবৈধ কাঠ আহরণ, বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার বন্ধে কঠোর আইনের সঠিকভাবে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সুন্দরবনের আশপাশে শিল্প ও অবকাঠামো নির্মাণে কঠোর পরিবেশগত মূল্যায়ন ও পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে হবে। ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় সুন্দরবনের টেকসই সংরক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব হলো এই অমূল্য সম্পদকে আগামী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা, যাতে সুন্দরবন সবসময় আমাদের রক্ষাকবচ হয়ে থাকতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি
সারাবাংলা/এএসজি