Monday 17 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মোড়কজাত শিশু খাদ্যের বাজার ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির ভয়াবহতা

ড. কে এম আতিকুর রহমান
১৭ মার্চ ২০২৫ ১৭:০৬

শিশু ও নারীকে টার্গেট করে পৃথিবীর ব্যবসা-বাণিজ্যের একটা বড় অংশ পরিচালিত হয়ে থাকে। অনেকক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে ব্যবসায়ীগণ তাদের ব্যবসা পরিচালনায় বেশি মুনাফা করে। আমাদের দেশেও এটা অহরহ দেখা যায়। শিশু খাদ্যের প্যাকেটগুলোকে এমনভাবে দোকানের সামনে আলোকসজ্জার মত সাজিয়ে রাখা হয় যাতে কোমলমতি শিশু দেখেই প্রলুব্ধ হয়। ব্যবসার ক্ষেত্রে এটা অনৈতিক প্র্যাকটিস তা আমি বলছি না। কিন্তু বাস্তবতাটা তুলে ধরছি মাত্র। দোকানের সামনে এমন অনেক দরিদ্র মাকে দেখেছি যারা সন্তানকে শিশু খাদ্য কিনে দেবার বায়না মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

পর্যবেক্ষণে দেখা যায় শিশু খাদ্যের প্রায় সবগুলোতেই কমবেশি ভেজাল বা টক্সিক উপাদান আছে। আমি যদিও কেমিস্ট বা পুষ্টি বিশেষজ্ঞ নই; কিন্তু এই বিষয়গুলো সাধারণ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা থেকেই বোঝা সম্ভব। শিশুদের খাদ্যগুলোকে কয়েকটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন, বেভারেজ খাদ্য, বেকারী, চুঈং আইট্ম, চিপস ফুড, কুকিজ বিস্কিটস, স্ন্যাকস ইত্যাদি। এই খাদ্যগুলো আবাসিক এলাকা এবং স্কুল-কলেজের কাছেই বেশি পাওয়া যায় যেখানে শিশুরা খেলাধুলা এবং অহরহ যাতায়াত করে। এসব খাবারে কিছু কমন উপাদান ব্যবহার করা হয়। যেমন, চিনি বা স্যাকারিন, লবন (শিলা বা বিট লবন), ফুড কালার, ডালডা, সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, মসলা জাতীয় উপাদান (যেমন, মরিচ, লবঙ্গ , দারুচিনি) খাবার সোডা, বেকিং পাউডার ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীরা ঐসব খাদ্য উপাদানই বেশি ব্যবহার করে যেগুলোর দাম কম এবং উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সহজতর করে; অথচ লাভ বেশি। যেমন, চিনির বদলে স্যাকারিন, প্রাকৃতিক লবনের বদলে বিট লবন, ডালডা, পাম অয়েল, ফুড কালার, সোডা ইত্যাদি। স্যাকারিন ও বিট লবন কৃত্রিমভাবে প্রস্তুতকৃত রাসায়নিক উপাদান, যেগুলো খাবার উৎপাদনে ব্যবহার করা যেমন সহজ তেমনি দামও তুলনামূলক কম। ডালডা বা পাম অয়েলে আছে স্যাচুরেটেড ফ্যাটি উপাদান যা হজম না হয়ে সরাসরি রক্তে মিশে যায়। এতে রক্তের প্রবাহ কমে যায়, হৃৎপিণ্ডের কাজ করার ক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পায়; লিভারে ফ্যাটি উপাদান জমে তাকে ক্রমশ অকার্যকর করে ফেলে। আমাদের শিশুদের পেটে গ্যাস জমার ব্যাপারটা অতি কমন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সয়াবিন তেল আমাদের দেশে রিফাইন করা হয় ব্লিচিং পাউডার বা অন্য রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। উন্নত দেশগুলোতে সয়াবিন তেল রিফাইন করা হয় হাইটেক মেশিনে যা কম ক্ষতি করে। অনেক ব্যবসায়ী ফুড কালারের পরিবর্তে টেক্সটাইল কালার বা রং ব্যবহার করে যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। খাবার সোডা খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা এমনিতেই ক্ষতিকর, কিন্তু এর পরিবর্তে শিল্প সোডা ব্যবহার করা হলে ক্ষতি হয় সীমাহীন। আমাদের দেশে এই প্র্যাক্টিস সচরাচরই হচ্ছে। বেকারিজাত খাবারগুলোতে বেকিং পাউডার ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য দেশেও এগুলো একেবারে ব্যবহার হয় না তা নয়; কিন্তু তা হয় বৈজ্ঞানিক উপায় ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে। এখানেই তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য।

বাংলাদেশে ব্রান্ডেড কোম্পানিগুলোর খাদ্যের মান খুব ভাল না হলেও একেবারে মানহীন নয়। এই কোম্পানিগুলোও ভেজাল বা বিষাক্ত খাদ্য উপাদান ব্যবহার করে; কিন্তু কম পরিমানে ব্যবহার করে। তাদের খাদ্য পণ্য বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক না হলেও নিজেদের ল্যাবে অন্তত মান যাচাইয়ের পর বাজারে ছাড়া হয়। বাজারে তাদের প্রতিযোগী আছে বিধায় মানের বিষয়টা মাথায় রাখতে হয়। সমস্যা তৈরি হচ্ছে মূলত মাঝারি, ছোট ও নকল কোম্পানি নিয়ে। তাদের অনেকেই ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই ব্যবসা করে যাচ্ছে। অনেকে আবার নানা মহলকে টাকা-পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করে বিষাক্ত খাবার বাজারে ছাড়ছে।

মাঝারি, ক্ষুদ্র ও নকল কোম্পানিগুলো উপরোল্লিখিত বিষাক্ত উপাদান যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। যেমন, স্যাকারিন, বিট লবন, ফুড কালার , ডালডা, সয়াবিন তেল, পাম অয়েল , মসলা জাতীয় উপাদান (যেমন, মরিচ, লবঙ্গ , দারুচিনি) খাবার সোডা , বেকিং পাউডার ইত্যাদি নিজেদের সুবিধা মত ব্যবহার করছে। এসব কৃত্রিম ও বিষাক্ত উপাদান ব্যবহার করে খাবারকে মুখরোচক,কালারফুল ও সুগন্ধময় করা হয় যাতে শিশুরা সহজেই আকৃষ্ট হয়। এ প্রক্রিয়ায় তাদের উৎপাদন খরচ যেমন কম হয় তেমনি তাদের মুনাফাও বেশি হয়। ক্ষুদ্র ও নকল কোম্পানিগুলোর লোকেশন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে শহরতলি ও মূল রাস্তা হতে দূরে ও গলির ভিতরে। ধূর্ত মালিকগুলো জানে কোথায় প্রশাসনের আনাগোনা কম। এদের অনেকেই ব্রান্ডেড কোম্পানির ব্র্যান্ড লেভেল ব্যবহার করে বাজারে সরবরাহ করে। তাদের খাদ্যপণ্য অধিকাংশই সরবরাহ করা হয় গ্রামের বাজার ও মফস্বল শহরে।

আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক খাদ্য উৎপাদন কোম্পানির লাইসেন্সিং, খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ,মূল্য ও ওজন যাচাই করার পর বাজারে সরবরাহ করতে হয়। এছাড়াও বাজার দেখভাল করার জন্য আছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও ট্যারিফ কমিশন। সময়ে সময়ে পণ্যের মান ও মূল্য ঠিক আছে কিনা তা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নবায়ন করতে হয়। কিন্তু এখানে আইনের বা যাচাই-বাছাই করার ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি আছে কিনা জানা নাই। অন্যদিকে মাঠ লেভেলের প্রতিটি জেলাতে রয়েছে একজন নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা ও উপজেলাতে আছে একজন স্যানিটারি ইনস্পেক্টর। এই কর্মকর্তাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে বাজারে খাবারের আইনগত দিক, ওজনের সঠিক হিসাব, মূল্য ও স্বাস্থ্যগত দিক পরিদর্শন করা এবং যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে এ লেভেলে আছে সমঝোতা করে চলার অভ্যাস, আছে অনৈতিক লেনদেনের মত বিষয়ও। অনৈতিক লেনদেন ও শাস্তির যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় উভয় পক্ষই হয়েছে বেপরোয়া। ফলে মোড়কজাত শিশু খাদ্যের বাজার হয়ে পড়েছে মারাত্বকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।

বাজারের মোড়কজাত খাদ্যের বিষক্রিয়া ও ভেজাল পণ্যে শিশুরা বেশি ভূগছে পেটের পীড়ায়। শিশুদের পেটে গ্যাস ফর্ম হওয়া তো একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে ফলে তাদের মুখের রুচিও কমে যায়। রুচি না থাকাতে তারা হয়ে পড়ছে অপুষ্ট। অপুষ্টির কারনে তারা ঘন ঘন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। লিভার, শ্বাসযন্ত্র, হৃদযন্ত্র, ব্রেইন, হাড়-মাংসের গঠন মারাত্মকভাবে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সারাজীবন ঐ শিশুকে স্বাস্থ্যহীনতার কষ্ট বয়ে বেড়াতে হয়। স্বাস্থ্যহীন জাতি তৈরির ফলে স্বাস্থ্যহীন উন্নয়ন ও সভ্যতা তৈরি হচ্ছে।

এমতাবস্থায় প্রতি উপজেলাতেই প্রতিষ্ঠা করা উচিত খাদ্য ও স্বাস্থ্য আদালত এবং খাদ্য পরীক্ষাগার। এই অফিসগুলোতে থাকবে ওয়ান স্টপ সার্ভিস যেখানে তথ্য, অভিযোগ ও ডিস্পুট ম্যানেজমেন্ট সেল থাকবে। অফিসগুলোতে স্থানীয় অরাজনৈতিক প্রতিনিধি থাকবে যারা ঐ অফিসের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। প্রতিমাসে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, স্যানিটারি ইনস্পেক্টর, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারের প্রতিটি ‘খাদ্য আউ্টলেট’ পরিদর্শন করে খাদ্যমান স্কেলশিটে রেইট আউট করবে। স্কেলশিটের অর্ডার হবে ‘ভালো, মধ্যম ও খারাপ’। পরপর তিনবার কারো রিভিউ ‘খারাপ’ হলে তার লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে।

লেখক: শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষক

সারাবাংলা/এএসজি

ড. কে এম আতিকুর রহমান মুক্তমত মোড়কজাত শিশু খাদ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর