Monday 24 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গাজায় বর্বরতা এবং দর্শক ভূমিকায় বিশ্ব

অলোক আচার্য
২৩ মার্চ ২০২৫ ১৪:৪০

গাজার মানুষের কাছে এই মুহূর্তে তাদের প্রিয় মাতৃভূমি বেঁচে থাকার নয় মৃত্যুর অপর নাম। যুদ্ধ বিরতির পরেও নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে ইসরাইল। অথচ বিশ্ব নির্বিকার। এখানে মানবতা অন্ধ, মানবতাবাদী সংগঠনগুলো অন্ধ। পুরো বিশ্ব এখন চোখ বুজে আছে অন্ধকারে। গত ১৫ মাসের যুদ্ধে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৪৯ হাজার ৬১৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৯৫০ জন। সেইসঙ্গে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া হয়েছে। গত ১৫ মাসের যুদ্ধে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৪৯ হাজার ৬১৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৯৫০ জন। সেইসঙ্গে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ঘরছাড়া হয়েছে। এখনও পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান এ সব কিছুই রয়েছে কিন্তু কোনো কিছু আমলে নেয় নি ইসরাইল। ইসরাইলের জন্য এ যেন পৃথিবীর তাবৎ রাষ্ট্র, আইন এবং সংস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখানো। এসব মাথায় না নিয়েই ফিলিস্তিনের গাজায় নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। সেখানকার শিশুরা এখন আর বাঁচতে চায় না। ওরা চায় একটু শান্তি। বহুদিন ধরে তো সেখানকার শিশুরা স্কুলে যায় না, খেলাধূলা করে না, পুষ্টিকর খাবার পায় না এবং শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারে না। সুতরাং এখন তারা চায় মৃত্যু! সম্ভবত পৃথিবীর কাছে এটাই তাদের পাওনা। সভ্যতার কাছে এটাই একমাত্র দাবী এবং আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। পৃথিবী নিশ্চুপ রয়েছে গাজা প্রশ্নে। উপত্যকাটিতে নিহত ফিলিন্তিনির সংখ্যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। শনিবার থেকে আগের ৪৮ ঘণ্টায়ও ১৩০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এরপরও ইসরায়েল বলছে, হামাসকে নির্মূল করতে তাদের এ হামলা। দশকের পর দশক ধরে চলে আসা ফিলিস্তিন-ইসরাইলের মধ্যেকার অমিমাংসিত বিষয় নিয়ে চলা যুদ্ধে প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির তৈরি করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরীহ ফিলিস্তিনিরা এর নির্মম শিকার হচ্ছে। ইসরাইল সর্বাত্বক অভিযান চালাচ্ছে। ফলিস্তনে ইসরাইলের ব্যাপক অভিযানে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। হামাসের এই হামলা ৫০ বছরের আগের একটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মিশর ও সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট অভিযান চালায় ইসরাইলে। সেই সংঘাত ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, অক্টোবর যুদ্ধ, রমজান যুদ্ধ, ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

এখন আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে। গাজার একমাত্র ক্যান্সার হাসপাতালটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধের একটি নীতি হলো হাসপাতাল বা সেবাখাতগুলো ধ্বংস না করা। এটা মানবতার বিষয়। ইসরাইল মানবতার কোনো শর্তই পালন করেনি। বা এখনও করছে না। হয়তো এ হামলায় কেউ কেউ বেঁচে যাবেন। যদি বেঁচেও থাকেন যারা ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে বেঁচে থাকবেন তাদের এই ক্ষত দীর্ঘ হবে। সেটা এত দীর্ঘ যে মরে যাওয়া এর থেকে বেশি ভালো মনে হবে। ক্ষতিগ্রস্থ অবকাঠামোগুলো পুনর্নিমাণে লেগে যাবে বহু সময়। সেটা এত দীর্ঘ যে মানুষগুলোকে পশুর মতো জীবন যাপন করতে হবে। আজকের এই পরিস্থিতির পেছনেও রয়েছে ইতিহাস। এর শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ হাজারের বেশি মানুষ। যাদের ৮৭ শতাংশই ফিলিস্তিনি। বিভিন্ন সময় এসব যুদ্ধে রক্ষপাত ঘটে। সাথে সাথে জীবনযাত্রাও ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়। বাস্তুচুত্য হয় হাজার হাজার মানুষ। মায়ের কোলে থাকা শিশুরাও এই নির্মমতা থেকে বাদ যায়না। এবারের যুদ্ধেও ৬৪ শিশু এই নিমর্মতার শিকার হয়েছে। ১৯৮৭ সালে ফিলিস্তিনিদের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন বা ইনতিফাদার মধ্য দিয়ে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। সে সময় এই সংঘর্ষে নিহত হয় বহু মানুষ। যা স্থায়ী হয়েছিল ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ সম্মেলন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। যদিও এর সমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির স্বাক্ষরের মাধ্যমে। এরপর বড় সংঘাত হয় ২০০০ সালে। যার কারণ ছিল ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির ব্যর্থতা।

বিজ্ঞাপন

ইসরাইলের আধুনিক প্রযুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে হামাস এই হামলা চালায়। বরাবরই ফিলিস্তিনের ওপর হামলার ঘটনায় বিশ্বে ধিক্কার ওঠে। কারণ বছরের পর বছর ধরে তারা নিগৃহীত হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলো ঘনিষ্টভাবে জোটবদ্ধ। যে কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে কার্যকর করা সম্ভব না। উভয় পক্ষের দ্বিমতের যে জায়গাগুলো যেমন জেরুজালেম, শরণার্থী ফিরে আসার অধিকার এবং সীমান্তের মতো মৌলিক ইস্যুগুলোর সমাধানে পৌছানো প্রয়োজন। উভয় পক্ষের মধ্যে তৈরি করতে হবে বিশ্বাসের সম্পর্ক। গাজায় একটি স্থায়ী সমাধান করতে হলে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশ ও অন্যান্য দেশ একত্রে শান্তির পথ তৈরি করতে হবে এবং তা স্থায়ীভাবে মেনে চলতে ইসরাইলকে সম্মত করাতে হবে। যুদ্ধ বিরতি হলো অথচ তা ইসরাইল পালন করছে না। আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেটি পালন করাতেও খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করছে না। কেন করছে না? ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। অথচ ফিলিস্থিনিদের সাথে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। ফিলিস্তিনিদের অধিকার বিষয়ে বিশ্বকে একমত হতে হবে এবং তাদের ভূমির অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এভাবে আর কত নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটবে যাদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিনি? ইসরাইলের একের পর এক আক্রমণে ফিলিস্তিনের অনেক এলাকা আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কতদিনে ঐ অঞ্চলে একটি স্থায়ী সমাধান আসবে সেটাও নিশ্চিত নয়। যুদ্ধ এবং শান্তি পরস্পর বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বর্তমান বিশ্বে দুটো বিষয়ই পাশাপাশি চলছে। একদিকে একে অন্যকে আক্রমণাত্বক বক্তব্য ছুড়ছে অন্যদিকে শান্তির বুলি। মানুষ আসলে কি চায় তা মনে হয় নিজেও জানে না। যাদের মাথার ওপর ছাদ ছিল। আজ নেই। মানুষের তৈরি অস্ত্র সেই ছাদ ধ্বংস করে দিয়েছে। পৃথিবীর মানুষকে আসলে গভীরভাবে ভাবতে হবে যে তারা কি চায়, যুদ্ধ না শান্তি? অস্ত্র না মানবতা?

এসব তো পাশাপাশি চলতে পারে না। হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে চলা যুদ্ধবিরতি অতীতেও কার্যকরের পর ফের উভয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। অতীতেও ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিরসনে বিশ্বে দাবি জোরালো হয়েছে। পরিকল্পনা হয়েছে, প্রস্তাব হয়েছে কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ফল পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুই একটি স্বাধীন ভূমির প্রত্যাশা করে। যুদ্ধ বা হানাহানি জন্ম থেকে প্রত্যাশা করে না। কিন্তু ফিলিস্তিনে জন্ম নেওয়া একটি শিশু কেন সেই স্বপ্ন দেখতে পারবে না এর উত্তর কারও কাছে নেই। ফলে পৃথিবীর স্বার্থে পৌছাতে হবে কোনো স্থায়ী সমাধানে। এভাবে পক্ষ-বিপক্ষ একটি বিশ্বযুদ্ধে অথবা ব্যাপক যুদ্ধে রুপ নিতে পারে। এর মধ্যে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সুতরাং পৃথিবীর স্বার্থেই ইসরাইলের এই হামলা বন্ধ করতে হবে এবং মানবিক উপায়ে সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। ভবিষ্যতে পৃথিবীকে এর উত্তর দিতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হলেও কেউ কোনো কর্ণপাত করছে না। একটি অন্যায় আরও শত শত অন্যায়ের জন্ম দেয়। এটাও দিবে। তখন বিশ্ব এভাবে চুপ থাকবে তো? ফিলিস্তিনে জন্ম নেওয়া শিশুটিও কিন্তু আমার এবং আপনার শিশুর মতোই!

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

অলোক আচার্য গাজায় বর্বরতা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর