ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন কতটা যুক্তিসঙ্গত?
২৩ মার্চ ২০২৫ ১৫:১০ | আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫ ১৬:৫৬
ঈদ উৎসব মানেই খুশি, আনন্দ আর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সুন্দর মুহূর্ত কাটানো। এটি এমন একটি উৎসব, যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে ভালোবাসা, সহমর্মিতা আর বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে এমন কিছু প্রতিবেদনের ঝলক দেখা যাচ্ছে, যা এই আনন্দের মাঝে অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করছে।
অনেক রিপোর্টার রাস্তায় সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করছেন, ‘আপনার ঈদের বাজেট কত?’ — এই প্রশ্নের উত্তর দিতে স্বচ্ছলরা হাস্যরসে ভরিয়ে দিচ্ছেন, তাদের বিলাসবহুল কেনাকাটার গল্প শোনাচ্ছেন। ব্র্যান্ডের পোশাক, দামি গ্যাজেট, বিদেশি পণ্যের নাম যখন তারা গর্বের সঙ্গে বলেন, তখন সেটা অনেকের জন্য নিছক বিনোদন হলেও, পাশের দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য তা রীতিমতো অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কেউ কেউ হাসতে পারেন না, মাথা নিচু করে নীরব থাকেন। কারও চোখে হতাশা আর দুঃখের ছায়া পড়ে যায়। কেউ কেউ চোখের জলও আটকে রাখতে পারেন না। যারা জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে, তাদের জন্য ঈদের কেনাকাটা মানেই সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে সন্তানদের জন্য নতুন জামাকাপড় আর সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা। তাদের জন্য এই ধরনের প্রশ্ন যেন এক ধরনের মানসিক আঘাত।
প্রশ্ন উঠছে, এমন প্রশ্নের আদৌ কি প্রয়োজন আছে? একজন মানুষ কত টাকা খরচ করবেন, কী কিনবেন — তা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এই বাজেট দিয়ে তার সামাজিক অবস্থান মাপা অনুচিত। মধ্যবিত্ত শ্রেণি এমনিতেই নানান অর্থনৈতিক চাপে দিন পার করে — কারও চাকরির অনিশ্চয়তা, কারও সংসারের খরচ সামলে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার লড়াই। তাদের জন্য ঈদে নতুন জামাকাপড় কেনা, পরিবারের জন্য একটু ভালো খাবার তুলে আনা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের সামনে অন্যদের আকাশছোঁয়া বাজেট তুলে ধরে তুলনামূলক প্রশ্ন করা যেন তাদের এই কষ্টকে আরও স্পষ্টভাবে সামনে নিয়ে আসে।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, কিছু রিপোর্টার এমন প্রশ্নও করছেন, ‘বয়ফ্রেন্ড/গার্লফ্রেন্ডের জন্য শপিং করেছেন কি না?’ বা ‘গিফট পেয়েছেন কি না?’ — এই ধরনের ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তরে অনেকে বিব্রত হন। বাংলাদেশে এখনও ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা অনেকের জন্য অস্বস্তিকর। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের জন্য এমন প্রশ্ন সামাজিকভাবে চাপ তৈরি করে। কারও ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে এভাবে প্রশ্ন করা শুধু অশোভনই নয়, এটি সাংবাদিকতার নৈতিকতার সঙ্গেও বেমানান।
গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব হলো সমাজের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা, মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। সংবাদমাধ্যমের কাজ শুধু খবর প্রচার করা নয়, বরং সমাজের অসংগতি দূর করে সঠিক বার্তা পৌঁছানো। একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন বা আর্থিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে বিব্রত করা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বরং তাদের গল্পগুলো তুলে ধরাই হবে সঠিক সাংবাদিকতার পরিচয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে — ঈদের আনন্দ সবার জন্য সমান। কেউ কম খরচ করলেই তার আনন্দ কমে যায় না, আর বেশি খরচ করলেই তার আনন্দ বেশি হয় না। ঈদের আসল সৌন্দর্য হলো পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও প্রিয়জনদের সঙ্গে ভালোবাসা ভাগাভাগি করা, যতটুকু সামর্থ্য আছে তা নিয়ে খুশি থাকা। অনেক সময় একজন বাবা তার সন্তানের জন্য সস্তা একটা জামাকাপড় কিনেও যে আনন্দ পান, তা কোনো ব্র্যান্ডেড পোশাকের আনন্দের চেয়ে কম নয়।
সাংবাদিকদের উচিত হবে জনসাধারণের অনুভূতিকে সম্মান জানিয়ে, বিব্রতকর প্রশ্নের পরিবর্তে উৎসবের মানবিক ও ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা। এই ঈদে যারা নতুন কাপড় কিনতে পারেননি, তাদের ঈদের আনন্দও যেন সমানভাবে মূল্যায়িত হয়।
গণমাধ্যম যখন মানুষের পাশে দাঁড়াবে, তখনই সমাজে আরও সুন্দর এবং সমতাভিত্তিক মূল্যবোধ গড়ে উঠবে। আসুন, ঈদের আনন্দকে সবার জন্য সহজলভ্য, সুন্দর আর সমানভাবে উপভোগ্য করে তুলি — বাজেট নয়, ভালোবাসা আর মানবিকতাই হোক ঈদের প্রধান বার্তা।
লেখক: শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর
সারাবাংলা/এএসজি