দেশ গঠনে চরিত্রবান ও মননশীল মানুষের প্রয়োজন
২৩ মার্চ ২০২৫ ১৫:৫৫
মননশীল আর চিন্তাশীল দুটি সমার্থক শব্দ। ইংরেজিতে বলা হয় Thoughtfu. আর চরিত্র শব্দের অর্থ Character. একজন ব্যক্তি দীর্ঘ সাধন প্রক্রিয়ার মধ্যে নিবিড় চর্চায় নিয়োজিত থেকে অর্জিত যে জ্ঞান মানুষের সম্মুখে অবারিত করে থাকেন এদেরকে বলা হয় মননশীল বা চিন্তাশীল মানুষ। আর জীবন চলার পথে একটি স্রোতধারায় নিজেকে পরিচালিত করার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চরিত্র। চরিত্র হচ্ছে একেকজন মানুষের অলংকার সদৃশ্য। স্বর্ণ যেমন চকচক করে মানুষের চরিত্রও ঠিক তেমনি। তবে অলংকারের চমৎকারিত্ব দেখা যায় আর অন্যদিকে চরিত্রের চমৎকারিত্ব দেখা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়। এই অনুভবের মধ্যে দিয়ে একেকজনের চরিত্র মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করে। কেউ ভালো চরিত্রের অধিকার হয় আবার কেউ কেউ খাড়াপ চরিত্র বা দুষ্টু চরিত্রের অধিকারী হয়। এই ভালো আর খাড়াপ বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলীর কারণে স্থান কাল পাত্রভেদে ব্যক্তি বিশেষের নিকট মূল্যায়িত হয়। চরিত্র আর মননশীলতা এই দুটি শব্দ মানুষের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তবে অর্থগত তারতম্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কেউ মননশীলতাকে প্রধান্য দেয়, আর কেউ দেয় চরিত্রকে। সমাজে দেখা যায় চিন্তাশীল সম্পন্ন মানুষরা অত্যন্ত শান্ত ও নীরব প্রকৃতির। তাদের মধ্যে কোনোরকম হাঁকডাক থাকেনা। কাজ করেন নীরবে নিভৃতে।
সমাজে প্রত্যেক মানুষ সমান মর্যাদায় পরিগণিত হয় না। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ মিল থাকলেই যে সেজন মানুষ হবে একথা ঠিক নয়। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পার্থক্য দেখা দেয়। মানুষ হতে গেলে মানুষের গুণ থাকা চাই। বর্তমান সময়ে মানুষরুপী কিছু অমানুষের কারণে সর্বক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল, নৈরাজ্য চলছে। এরা খুব ধুর্ত প্রকৃতির। এজাতীয় মানুষেরা দ্রুত বোল পাল্টিয়ে দলে উপদলে আবার মিশেও যায়। তাদের কাছে স্বসম্মান বলতে কিছু নেই। এরা ভেবে থাকেন তাদের এই ধুর্তামি কেউ বুঝে না। প্রাণীদের মধ্যে শিয়াল হচ্ছে একটি ধূর্ত ও বুদ্ধিমান প্রাণী। ছোটকালে এই শিয়াল প্রাণীকে হাতির সাথেও মশকারা করতে দেখেছি। তাই বলে সেকি কখনো হাতির সমান হতে পেরেছে ? দেশ ও সমাজে এরকম মানুষরুপী কিছু শিয়াল আছে তারা মনে করে থাকেন সমাজ-সংগঠন সব রাজত্ব তাদের দখলে। আরে ভাই, আগে বিচার করো তোমাদের মধ্যে মৌলিকত্ব কিছু আছে কিনা। মৌলিকত্ব বিষয় ছাড়া মানুষ কখনো কারো মনে স্থায়ী আসন গড়তে পারেনা। শিয়াল পণ্ডিত যতই চালাক হোক সেই শিয়াল কখনো হাতির সঙ্গে গা ঘেঁষতে পারবেনা।
চরিত্র বিবর্জিত লেজুড়বৃত্তি মার্কা মানুষগুলোকে দেখবেন সর্বক্ষেত্রে পই পই টই টই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা শান্ত সহজ মানুষদের বোঁকাভাবে আর নিজেদেরকে স্মার্ট মনে করে। বুঝতে পারছ না যে দিন দিন তোমাদের পায়ের নীচে থেকে মাটি সড়ে যাচ্ছে। কারণ, ধুর্তামি বলি আর চালাকি বলি এই জাতীয় চরিত্রের সাথে যাদের জীবনকে গুলিয়েছেন একদিন না একদিন পরাস্ত হবেনই। একথা নিশ্চিত জেনে রেখো। অন্যজনের মাথা খাটিয়ে নিজের পকেটে অর্থ ঢুকাতে পারলেই যে সব জয় করে ফেলেছেন একথা ঠিক নয়। এই ধুর্তামি দিয়ে সাময়িক ঠিকে থাকা যায় কিন্তু স্থায়ীভাবে ঠিকতে পেরেছে তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। চারিত্রিক ও পারিবারিক গুণাবলীর অনুপস্থিতির কারনে আমাদের আশেপাশের সমাজের কিছু সংখ্যক মানুষ পরিবেশকে অসহনীয় দুষ্ঠু-দুরাচারে বিষাক্ত করে তুলেছে। গ্রাম্য ভাষায় এজাতীয় মানুষদেরকে বলা হয় ইতর! ইতর জাতীয় মানুষদের কাছে মান-সম্মান বলতে কিছু থাকেনা। তারা যতক্ষণ অন্যজনের কাছ থেকে ছলচাতুরি করে যা পায় তাই লাভ মনে করে। তারা একবার ভাবে না ভবিষ্যতের জন্য কিযে ভুল করছে। এরা মনে করে আমাদের সাথে তো সবাই কথা বলছে, হাসি-উল্লাসের ভাগীদার হচ্ছে। কিন্তু না, পরক্ষণে তোমার ইতর স্বভাবটি তাকে আঘাত করছে। এরকম ইতর জাতীয় মানুষগুলো প্রত্যেকের আশেপাশে আগেও ছিল এখনো আছে। যারা ইতর হিসেবে রেকর্ড গড়েছে তাদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছি আর এখনো যেসব ইতর আশপাশে ঘুরাফেরা করে মাত্রাতিরিক্ত ডোস ধরা পড়লে তাদের বেলায়ও একই পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখাযায়, চারিত্রিক বৈশিষ্ঠাবলীর কারণে এজাতীয় মানুষদের সংসার ভাসমান ভেলার মতো টলমল করে। এরা বাইরের মানুষের কাছে ছলচাতুরির নানান রং ধারণ করে কখনো মহাজ্ঞানী মহাপ-িত সাজে আবার কখনো দেশ দরদী সোমাজবোদ্ধা সেজে সুক্ষ্ম প্রতারণায় মেতে ওঠে। নষ্ট চরিত্রের মানুষগুলো হচ্ছে ইতর প্রাণীর সমতুল্য। যতটুকুন সম্ভব এই ইতরদের কাছ থেকে সময়ে সময়ে নিজেকে দূরে সড়িয়ে রেখে মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞানের দিকে ব্যস্ত রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।
চরিত্র হচ্ছে মানুষের বড় সম্পদ। চরিত্রের মধ্যে সৎ ও অসৎ এর আসল অবয়ব ফুটে ওঠে। কথায় আছে সৎ চরিত্রে মানুষ, অসৎ চরিত্রে অমানুষ। এই সৎ আর অসৎ এর পার্থক্য বুঝতে বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার আশেপাশের নিকট আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের দিকে একটু নজর কাড়লেই এ সব মানুষের পুর্ণাঙ্গ অবয়ব দেখতে পাবেন। চরিত্র হচ্ছে একটি স্বচ্ছ আয়না। যে আয়নার সামনে দাঁড়ালে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য কি। বিশেষক্ষেত্রে দেখাযায়, সমাজের অতি নোংরা, নিকৃষ্ট জঘন্য প্রকৃতির মানুষগুলো ধুঁয়া তুলসী পাতা সেজে নিজেকে সাধু স্বজ্জন হিসেবে পরিচিতি পেতে ঢাকডোল পিঠিয়ে চেষ্টা চালায়। আর তার বিপরীতে দেখবেন সত্যিকার অর্থে একজন সুশিক্ষায় শিক্ষিত গুণী কিংবা বংশ পরম্পরা যাদের আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে তাদের কিংবা পরিবারের সন্তানদের সেই সবের প্রয়োজন পড়ে না।
সে জন্য বলি, চরিত্র হচ্ছে মানুষ চেনার একটি সহজ উপায়। নাটক কিংবা সিনেমায় দেখবেন একেকজন অভিনেতা একেক চরিত্রে অভিনয় করছে। এই অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলি দেখতে পাই। এগুলো দেখবেন কারো না কারো জীবনে সাথে মিলে যাচ্ছে। আবার নাটকের শেষ প্রান্তে গিয়ে এর পরিণতি কি হয় তারও কিন্তু ইঙ্গিত থাকে। এই নাটক দেখে কি আমরা জীবনকে পরিশুদ্ধ করি? আবার অনেককে দেখবেন ধর্মের বুলি আওড়াতে আওড়াতে মুখে ফেনা ওঠে যাচ্ছে। ধর্মগুরুদের পাশে গিয়ে কত হাজার রকম ধর্ম বয়ান শুনে তারা কি সেই সব কথা জীবনে প্রতিপালন করে? আবার দেখবেন প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীরা তীর্থ করে ইসলাম ধর্মের মানুষেরা হজ পালন করে। ওখানে গিয়ে পাপমোচনের জন্য কত কান্নাই না করে ধর্মস্থান থেকে ঘুরে আসার পর তাদের মধ্যে থেকে ক’জন মানুষ সত্যিকারভাবে সৎ নির্মোহ জীবন অতিবাহিত কওে? যদি করতো, তাহলো আমাদের প্রত্যেকের পরিবার, আশাপাশ কত সুন্দর হতো তাই নয় কি? তার কি আমরা ছিটেফোঁটা দেখতে পাই? পাই না, তাহলে প্রশ্নজাগে এই লোক দেখানো ধর্ম কেন, কার স্বার্থে। আজকে পুরো দেশ-সমাজ ঠকবাজদের আনাগোনায় ভরে গেছে। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে আমাদের আগামীর ভবিষ্যত কি? কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে আমাদের আগামী প্রজন্ম। একবার ভেবে দেখেছেন কি?
দেশ, সমাজ, সংগঠন কিংবা পেশাগত কাজে যুক্ত হলে বুঝতে পারবেন চরিত্রের হেরফের ওয়ালা মানুষগুলো সম্পর্কে। আজকে দেশজুড়ে ধর্ষকদের যে বেপরোয়া গতি অথচ দেখবেন তাদের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। অথচ এই গুটি সংখ্যক অপচরিত্রের মানুষদের কারণে পুরো দেশজুড়ে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি ও কলংকিত হতে হচ্ছে পুরুষশাষিত সমাজকে। ঠিক স্বার্থলোভী নিকৃষ্ট চরিত্রের কিছু সংখ্যক মানুষের কারণে সুন্দর সমাজ আজ অসুন্দরে পর্যবসিত হচ্ছে। সর্বক্ষেত্রে এই ইতর নামক দুশ্চিরত্রদের বেপরোয়া দাপট! মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র সুন্দর কাপড়-চোপড় পড়লে মানুষ হওয়া যায় না, সুন্দর মানুষ হতে গেলে সুন্দর মন আর সুশিক্ষা প্রয়োজন। জীবনের প্রথম সুশিক্ষার পাঠ নিতে হবে পরিবার থেকেই। পরিবারের শিক্ষার ওপর নির্ভর করবে জীবনের চলার পথ। দামি স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় কখনো পারিবারিক শিক্ষার ওপরে নয়। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা হচ্ছে সার্টিফিকেট নির্ভর আর পারিবারিক শিক্ষা হচ্ছে জীবন নির্ভর। নৈতিক গুণাবলীর শিক্ষা যদি পরিবার থেকে না হয় প্রতিষ্ঠান থেকে আশাকরা বৃথা। আসুন, অসৎ, মিথ্যাবাদী, ঠকবাজ চরিত্র বিক্রেতাদের কাছ থেকে নিজেকে সজাগ এবং সুরক্ষা রাখি। অসৎ চরিত্রের মানুষের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রেখে সৎ চরিত্রবান মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে সুন্দর স্বচ্ছ জীবন গড়তে প্রচেষ্টা চালাই। সুশিক্ষা নির্ভর সংস্কৃতিবান মানুষই পারে মননশীল পরিবেশ উপহার দিতে। জীবনকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্নতায় গড়ে তুলতে হলে সৎ চরিত্রবান হওয়া যেমন দরকার, তেমনি দরকার মননশীল মানুষ হওয়া।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এএসজি