সস্তা সবজি: ক্রেতার মুখে হাসি, কৃষকের চোখে জল
২৯ মার্চ ২০২৫ ২০:১৭
রংপুরের হাটবাজারে শীতকালীন সবজির দাম এতটাই কমে গিয়েছিল যে উৎপাদন খরচই তুলতে পারেননি কৃষক। পাইকারি বাজারে ভরা মৌসুমে শিম, বাধাকপি ও ফুলকপির দাম মাত্র ৮-১০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে। ৫ কেজি (এক পাল্লা) এসব সবজি বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকায়। দেশি রসুন নতুন ৬০-৭০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে এখন। পিয়াজ ৩০-৩৫ টাকা কেজি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে খবরের কাগজ (২০ মার্চ) একটি দৈনিক বলছে আলু পাইকারী ১২ টাকা কেজিও বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা। উৎপদন খরচ হয়েছে প্রতিকেজি ১৮-২০ টাকা। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায় এবছর প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে। আলুচাষ বাড়লে বৃদ্ধি পায়নি হিমাগরের সংখ্যা। এ অঞ্চলে ২২১টি হিমাগরে আলু ধারণ ক্ষমতা প্রায় ২২ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে এবার আলুর উৎপাদন ১ কোটি ৩ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে (নিউ এজ, ২১ মার্চ ২০২৫)। সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে কম দামে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় অনেকে খেত থেকে আলু তুলছেন না। আবার হিমাগারে ব্যবসায়ীদের দৌরত্য থাকায় জায়গা পাচ্ছেন না কৃষক। সস্তা সবজি ক্রেতাদের জন্য আশার খবর হলেও কৃষকদের জন্য চরম হতাশার। শুনেছি কোন কোন এলাকায় সবজি বিক্রি করতে না পারায় গোখাদ্য হয়, ফেলে দেওয়া হয়।
উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায় কৃষক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কৃষকের কথা কেউ ভাবছেন না। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। আয়তনের দিক দিয়ে ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশে সবজি উৎপাদনে বিপুল সাফল্য অর্জিত হয়েছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়; চীন ও ভারতের পরেই এর অবস্থান। গত কয়েক বছরেই সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। কৃষি হচ্ছে আমাদের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত, এ খাত থেকে জিডিপির আনুমানিক ১৪ শতাংশ আসে। উৎপাদন বাড়লেও কৃষকরা লাভের মুখ দেখছেন না, বরং প্রতিবারই লোকসান গুণতে হচ্ছে।
সবজির দাম কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ। শীত মৌসুমে সবজির উৎপাদন বেশি হয়, কিন্তু সংরক্ষণের সুযোগ কম থাকায় কৃষকরা দ্রুত সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত সবজির প্রায় ৩০-৪০% নষ্ট হয় সংরক্ষণ ও বিপণনের অভাবে। দেশে কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা এখনও অপ্রতুল; মাত্র ১০-১৫% সবজি সংরক্ষণ করা যায়। ফলে বাকি সবজি কম দামে বিক্রি করতে হয় অথবা নষ্ট হয়ে যায়। মধ্যস্বত্বভোগীরাও কৃষকদের দুরবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন। তারা পাইকারি বাজার থেকে নামমাত্র দামে সবজি কিনে খুচরা বাজারে বেশি দামে বিক্রি করছেন।
এই সংকট মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। ভারতে কোল্ড স্টোরেজ সুবিধার মাধ্যমে প্রায় ৪০% সবজি সংরক্ষণ করা হয়, যা কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে। থাইল্যান্ডে প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের মাধ্যমে সবজির মূল্য সংযোজন করে তা রপ্তানি করা হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে। চীন ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলোতে কৃষকদের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও বিপণন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে, যা কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। সরকার ও বেসরকারি খাত যদি কোল্ড স্টোরেজ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বাড়ায়, তাহলে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সবজির ন্যায্যমূল্য পাবেন। পাশাপাশি, সরকার যদি গম ও ধানের মতো সবজিরও ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে এবং সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে কিনে, তাহলে কৃষকদের লোকসান কমবে। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ এবং বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন হলে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
স্থানীয় কৃষি অফিস, বিএডিসি ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কাজ কী? কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারভিশনে উপজেলা পর্যায়ে টিম গঠন করে একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে কৃষকের নিকট সবজি ক্রয় করে, বড় বড় শহরগুলোতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা উচিত। বড় বড় সুপারশপগুলোকে সবজি উৎপাদনকৃত জেলায় গিয়ে সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে সবজি কেনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলতে পারে। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ প্রায় ৫০টি দেশে সবজি রপ্তানি হচ্ছে। প্রয়োজনে কৃষক যাতে সরাসরি নিজে রপ্তানি করতে পারে, সরকারকে এ উদ্যোগও নিতে হবে।
কৃষি অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী করতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ ও শ্রমের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি, ভোক্তাদের সারা বছর সাশ্রয়ী দামে সবজি সরবরাহের জন্য সংরক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা না গেলে ভবিষ্যতে কৃষি খাত আরও বড় সংকটের মুখে পড়তে পারে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এ সমস্যা দীর্ঘমেয়াদে কৃষকদের কৃষিচ্যুত করতে পারে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ হবে।
লেখক: সাংবাদিকতার শিক্ষক, প্রশিক্ষক ও গবেষক
সারাবাংলা/এএসজি