বিত্তবান সমাজ ও পথশিশুদের ঈদ
২৯ মার্চ ২০২৫ ১৭:০৩ | আপডেট: ৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:০৫
ঈদ মানেই খুশি। সবার মাঝেই এই আনন্দ বিরাজ করবে। দেশজুড়ে সবাই ব্যস্ত কেনাকাটায়। বাবা-মা তার সন্তানের জন্য পছন্দের এক বা একাধিক পোশাক কিনতে ব্যস্ত। যাদের নুন্যতম সামর্থ্য আছে তারাই দোকানে যায় পোশাক কিনতে। কিন্তু যাদের একেবারেই কেনার সামর্থ্য নেই বা অভিভাবকহীন তাদের অবস্থা ভাবা দরকার। আবার পছন্দের পোশাকের দাম বেশি হলে অভিভাবকের আয়ত্ত্বে থাকে না। বাবা-মা তার সন্তানের জন্য পছন্দের এক বা একাধিক পোশাক কিনতে ব্যস্ত। যাদের নুন্যতম সামর্থ্য আছে তারাই দোকানে যায় পোশাক কিনতে। কিন্তু যাদের একেবারেই কেনার সামর্থ্য নেই বা অভিভাবকহীন তাদের অবস্থা ভাবা দরকার। আবার পছন্দের পোশাকের দাম বেশি হলে অভিভাবকের আয়ত্ত্বে থাকে না। নিন্মবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ওপর খরচের চাপ বেড়েছে। একদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অন্যদিকে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণেও মানুষের আর্থিক সক্ষমতায় আঘাত এসেছে। তবুও সবাই সামর্থ্যমতো আনন্দ উদযাপনের চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। দেশে অনেক মানবিক সংগঠন রয়েছে যারা ঈদের অসহায় শিশুদের পাশে দাড়িয়েছে। ঈদ সবার সাথে আনন্দ ভাগ করে আনন্দ করা। ঈদ মানে মানবতা। কেউ কেউ হয়তো নতুন পোশাক কিনতেও পারবে না। বিশেষ করে রাস্তায় বেড়ে ওঠা শিশুগুলো। যাদের তিনবেলা খাওয়ারই নিশ্চয়তা নেই। যারা দিনের বেশিরভাগ সময়ই খালি গায়ে থাকে। যারা তীব্র শীতে ফুটপাতে চটের বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমায়। ওরা কিভাবে নতুন পোশাক কিনবে? বাংলাদেশ সহ সারা বিশে^ই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দেখা মেলে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল,স্বল্পন্নোত বা অনুন্নত দেশগুলোতে এদের দেখা বেশি মেলে।
আমাদের দেশেও চারদিকে তাকালেই এধরনের শিশুর দেখা মেলে। রাস্তা, ফুটপাত যাদের ঠিকানা। বড়লোকের আহ্লাদে বড় হয়ে ওঠা শিশুদের পাশাপাশি এরাও বড় হয়। অভাব যাদের জীবনে নিত্যসঙ্গী। খোলা আকাশ যাদের মাথার ওপর ছাদ হয়ে থাকে। জন্মের পরপরই তারা পৃথিবীর এক অন্যরকম চিত্র দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে। ধনী গরীবের ব্যাবধান তারা জন্মের পরেই দেখতে পায়। এসব ভাগ্যহীন, পরিচয়হীন শিশুদের আমরা কখনো টোকাই, কখনো পথকলি, ছিন্নমূল বা পথশিশু বলে ডাকি। পথই যাদের আপন, পথই যাদের চুড়ান্ত ঠিকানা। যাদের জন্য সমাজের, রাষ্ট্রের, সুশীল সমাজের আমাদের সবার দায় রয়েছে। এসব পথশিশুরা বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকার থেকে। এরা অনেকেই শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পায় না, পুষ্টিকর খাদ্য পায় না,পোশাক বা মাথার নিচে ছাউনি পায় না। যদিও রাষ্ট্র থেকে এদের জন্য বিভিন্ন সময় নানারকম পদক্ষেপ নেয়া হয় তবে তা পর্যাপ্ত নয়। কারন প্রতিনিয়তই এই ধরনের পথশিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে যেসব ভাসমান শিশুদের অবস্থান তাদের জন্য সমন্বিতভাবে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। রাজধানী ঢাকায় পথশিশুর সংখ্যা বেশি। এবং এসব পথশিশুর জীবন ও জীবিকা নির্বাহ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এদের অসহায়ত্তের সুযোগ নিয়ে নানা অপরাধমূলক কাজে ব্যাবহার করছে সুযোগসন্ধানী মানুষ। একটু ভালো থাকার আশায় না বুঝেই সেসব কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে এসব পথশিশুর অনেকেই। তাদের সামনে তো ভালো থাকার বিকল্পও নেই। এভাবে ছোট ছোট অপরাধ থেকে বড় কোন অপরাধে জড়িয়ে পরাটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে এসব পথশিশুকে বেছে নিচ্ছে মাদক কেনা বেচায়। আমাদের বুঝতে হবে প্রতিটি শিশুই তার মেধাশক্তি নিয়ে জন্ম নেয়। তাদের কাজে লাগাতে হলে তাদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কেবল দারিদ্রতার কারণেই পথশিশু বাড়ছে না বরং এর পেছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে। পরিচয়হীন, ঠিকানাবিহীন শিশুদেরও আশ্রয় হচ্ছে পথে। বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে এসব শিশু পেটের ক্ষুধা মেটাতে নানারকম কাজ বেছে নেয়। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে হকার, শ্রমিক, রিক্সাচালক, ফুল বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, কুলি, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি বিভিন্ন রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যা আমরা আমাদের চারদিকে তাকালেই এর বাস্তবতা টের পাই। কেবল পেটের ক্ষুধা মেটানোই এদের কাছে মূখ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়। এদের মধ্যে অনেকেই তাই একটু ভালোভাবে বাঁচার আশায় না বুঝেই অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িয়ে পরে। আমরা যদি তাদের জন্য ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ রাখি তারা নিশ্চয় অপরাধীদের কথায় প্রভাবিত হবে না। সমাজ থেকে অপরাধের মাত্রা অনেকটা কমে আসবে।
পথশিশুদের জীবন অত্যন্ত কষ্টের ও নির্মম। সমাজের নিষ্ঠুর সত্যের সাথে এরা বাস করে। আরাম আয়েশের ঠিক উল্টো দিকে এদের বসবাস। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য খাওয়া ও এরকম স্থানে ঘুমানোর কারণে তারা প্রায়ই নানা রোগে আক্রান্ত থাকে। অথচ চিকিৎসার সুযোগ নেই বললেই চলে। মেয়ে শিশুরা দালালচক্রের খপ্পরে পরে যৌনকাজে বাধ্য হচ্ছে। ফলে তারা নানা রকম যৌন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। একসময় এরা ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে রোজগারের পথ করে নিচ্ছে। অথচ সমাজে এদেরও একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন ছিল। বিভিন্ন কারণে ঢাকা শহর ছাড়াও অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে ভাসমান শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। তবে রাজধানীতে এই সংখ্যা বেশি কারণ বেঁচে থাকার সুযোগ এখানেই বেশি। এসব পথশিশুদের সমাজের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমদেরও দায়িত্ব রয়েছে। সবাইকে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। ঈদ,পূজায় সারাদেশে যখন কেনাকাটার ধুম লাগে, কে কয়টি নতুন পোশাক নিতে পারে সেই নিয়ে এক ধরনের প্রতিযোগীতা তৈরি হয়, পরোকীয়ার মতো কুৎসিত নামে দামী পোশাক বাজারে আসে এবং তা কিনতে হুড়োহুড়ি লেগে যায়, মাসুদের মতো অসহায় শিশুকে তার দরিদ্র বাবা নতুন পোশাক কিনে দিতে পারে না বা সাধের পোশাক না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তখন আনন্দটা ম্লান হয়ে যায়। এদের হাসিতেই তো সত্যিকারের আনন্দ। সমাজের সামর্থ্যবান প্রত্যেকে তার আশেপাশের অসহায় শিশু বা পরিবারের জন্য বছরের পথে পথে যারা বড় হয় তাদেরও মুখেও আমরা এভাবে হাসি ফোটাতে পারি।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ইউনিসেফ বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ ফেইজ-২’ প্রকল্পের অধীনে গবেষণা বলছে দেশে ৩৪ লাখেরও বেশি পথশিশু বাবা-মায়ের যত্ন ছাড়াই জীবনযাপন করছে। ‘বাংলাদেশে পথশিশুদের পরিস্থিতি-২০২৪’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চরম দারিদ্র্য, পারিবারিক অস্থিরতা এবং শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের পটভূমি থেকে বেড়ে ওঠা শুরু হয় পথশিশুদের। অর্থনৈতিক চাপ প্রায়ই এসব শিশুকে শ্রমে বাধ্য করে, তাদের শিক্ষার সুযোগ কমিয়ে দেয় এবং দারিদ্রের একটি চক্রকে স্থায়ী করে। পিতামাতার অবহেলা, অপব্যবহার এবং পরিত্যাগসহ পারিবারিক কর্মহীনতা সরাসরি তাদের রাস্তায় বেরিয়ে আসতে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ এই বিপুল সংখ্যক শিশুর ঈদে নতুন পোশাক কিনে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়ার কেউ নেই। যেখানে আপনি-আমি নিজের নিজের সন্তানের জন্য সর্বোচ্চটা দিয়ে তাদের শখ পূরণ করতে চেষ্টা করছি। এই যে যারা পথে পথে বড় হচ্ছে ওদের দোষ কোথায়? ওরাও তো আমাদের সন্তাদের মত একটি নিশ্চিত জীবন চেয়েছিল। কিন্তু পায়নি। সকলেই পায় না। তবে আমরা যারা আছি তারা কিন্তু চাইলেই ওদের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। ওরা মাত্র কয়েক লাখ। অথচ দেশে কোটিপতির সংখ্যাই বাড়ছে হু হু করে। এসব ছাড়াও সমাজে বহু সামর্থবান রয়েছে যারা ইচ্ছে করলেই দু’একজনের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। ঈদের দিনে একটু ভালো খাবার মুখে তুলে দিতে পারে। চাইলেই তো সমাজটা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। দরকার শুধু মাসনিকতা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এএসজি