পহেলা বৈশাখ: বাংলা সংস্কৃতির আভিজাত্যের প্রতীক
১২ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:২৯
পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালীর উৎসবের আরেক নাম। পুরোনো বছরের বিবাদ, সংঘাত পিছনে ফেলে নতুন বছরের আনন্দে মেতে উঠে বাঙালীরা। বলা চলে, পৃথিবীতে খুব কম জাতিরই নিজস্ব নববর্ষ আছে। তাদের মধ্যে ভাগ্যতম তালিকার মধ্যে বাঙ্গালীও অন্যতম। বাঙালিরা সেই ঐতিহ্যবাহী গর্বিত জাতি যাদের নিজস্ব নববর্ষ, নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব শক্তিশালী বর্ণমালা, নিজস্ব ষড়ঋতু, নিজস্ব উঁচুমানের সংস্কৃতি রয়েছে- এবং সারা বিশ্বে একমাত্র বাঙালিরাই তাদের নিজস্ব ষড়ঋতুকে আলাদা আলাদা করে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেয়।
বাংলাদেশ তথা বাংলা ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও ছয় ঋতু নেই- এটাই বাঙালির গর্ব করার মত বিচিত্র বৈশিষ্ট্য। অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক উৎসবে এবং অপার আনন্দের সাথে বাঙালি এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছে তার প্রকৃত পরিচয়। পহেলা বৈশাখ শুধু একটি উৎসব নয়, বরং এটি বাঙালি জাতির ঐক্য, সংস্কৃতির আভিজাত্যের প্রতীক।
বাংলাদেশের মানুষ উৎসব প্রিয়। নানান রকমের উৎসব আমাদের জাতীয় জীবনে জড়িয়ে আছে। ঠিক তেমনি বাংলা নববর্ষ আমাদের আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের দাবীদার। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালিরা নববর্ষ উদযাপন করে আসছে। বৈদিক যুগে ‘চৈত্র সংক্রান্তি’ নামে এই উৎসব পালিত হত। মধ্যযুগে ‘পয়লা বৈশাখ’ বা ‘নববর্ষ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তখন ‘হালখাতা’ নামে ব্যবসায়ীরা নতুন খাতা খুলে নতুন হিসাব শুরু করতেন। মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৫৬ সালে ‘বঙ্গাব্দ’ নামে নতুন বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। তখন থেকেই ‘পহেলা বৈশাখ’ রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হতে থাকে।
বাঙালির এই উৎসবে অসাম্প্রদায়িক বিষয়টি সবচেয়ে আলোকিত হয়ে ফুটে ওঠে। বাঙালির মধ্যে নতুন করে প্রাণ-সঞ্চারিত হয়। বেশ কিছু নতুন বিষয় সংযুক্ত হয় পহেলা বৈশাখকে ঘিরে। সাহিত্যেও প্রভাব রয়েছে বৈশাখের রুদ্ররূপ ও বিভিন্ন উৎসব নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে শুরু করে হালের কবি-সাহিত্যিকগণ বৈশাখ নিয়ে কবিতা-সাহিত্য রচনা করছেন। বাঙালি ‘হালখাতা’ নামে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন করে হিসাব শুরু করে। বাংলা নববর্ষে বেচাকেনায় ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতি আছে। বাঙালির এ উৎসব অসাধারণ বৈশিষ্ট্যময়। বাংলা নববর্ষের এই ঐতিহ্য মাটি ও মানুষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এখানে কোনো জাতিভেদ ও ধর্মভেদ নেই। শহর-গ্রামে তরুণ-তরুণীসহ সবাই উৎসবে মেতে ওঠেন। পাশাপাশি প্রবাসেও এই উৎসব উদযাপনে বাঙালিদের মাঝে প্রানের সঞ্চার করে। সূর্য উঠার সাথে সাথে রবীন্দ্রনাথের গানটি ‘এসো হে বৈশাখ ‘গেয়ে ওঠে নূতন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় নজরুল বলেছেন, ধ্বংস আর যুদ্ধ থেকেই নতুনের সৃষ্টি হয়! তেমনই বাংলা নববর্ষের কালবৈশাখী ঝড় বা রুদ্র রূপ থেকেই অনুপ্রেরণা পায় বাঙালি।
বাংলাদেশে আমাদের অস্তিত্ব ‘স্বাধীনতা অর্জন’। নয় মাস যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এতে রক্ত ও সম্পদ বিসর্জন দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার প্রথম মাসেই এসেছিল পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। তাই তো কবি সমুদ্র গুপ্তের ‘বৈশাখ: একাত্তরে’ কবিতায় স্মৃতিচারণ পাই; মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও ব্যঞ্জনা, যুদ্ধাবস্থার কথা জানতে পারি।পহেলা বৈশাখ উৎসব শুরুর দিক ছিল মূলত গ্রামাঞ্চল। গ্রামীণ-মেলা, লোকজ খেলাধুলা ও নৃত্য-সংগীত ছিল প্রধান আকর্ষণ। দিনে-দিনে তা শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক পরিচয় বহনকারী এ অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আমাদের বিশেষ প্রেরণা জুগিয়েছে। এ ভূখণ্ডের বাঙালির ঐক্যবদ্ধ করেছে এ সাংস্কৃতিক-উৎসব ও চেতনা। বাংলা নববর্ষ এ দেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্য। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্যদিয়ে এ দেশের মানুষ এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বৈশাখী মেলায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানুষের আনাগোনা। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক উদার মিলনক্ষেত্র। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই আসে মে লায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিকিকিনির আশা আর বিনোদনের টান। কৃষিক্ষেত্রেও বৈশাখ মাসের গুরুত্ব অনেক। বৃক্ষের ক্ষেত্রেও নব উদ্যমে নতুন জীবন শুরু হয়- নতুন পাতা গজিয়ে।
কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের।আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো রমনা বটমূলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তখন থেকে প্রতি বছর নববর্ষের প্রথম দিন ভোর ৫ টায় এই অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছায়ানট বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানায় এবং বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। তখন থেকেই ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাংলা নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে গান, বাজনা, নাচ, কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ইত্যাদি। বিখ্যাত শিল্পীরা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এছাড়াও, বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করে।
ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ হলো এর পরিবেশ। এইদিন রমনা বটমূল নববর্ষের আনন্দে মুখরিত থাকে। মানুষ নতুন পোশাক পরে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ছায়ানটের কর্মীরা বিভিন্ন রঙের পতাকা ও ব্যানার টাঙিয়ে রমনা বটমূল সাজিয়ে তোলে। এছাড়াও, নববর্ষের বিভিন্ন খাবার পরিবেশন করা হয়।
পহেলা বৈশাখের আমেজকে আরো উজ্জীবিত করতে চারুকলা ১৯৮৯ সাল থেকে পয়লা বৈশাখে শোভাযাত্রা করে আসছে। শুরুতে নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। মূলত নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গলের আহ্বান জানিয়ে শোভাযাত্রার নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। যা পরবর্তীতে ২০২৫ সালে এর নামকরণ করা হয় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
বাংলা সংস্কৃতির মানকে বিশ্বের দরবারে উঁচিয়ে ধরতে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে।
বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রার (তৎকালীন নাম: মঙ্গল শোভাযাত্রা)অন্যতম আকর্ষণ হলো এ রঙিন ও বৈচিত্র্যময় শিল্পকর্ম। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন রঙের পোশাক পরে, মুখোশ লাগিয়ে, হাতে বিভিন্ন ধরনের পতাকা ও ব্যানার নিয়ে নৃত্য করে।
এছাড়াও, শোভাযাত্রায় বিভিন্ন রথ, পালকি, ঐতিহ্যবাহী বাঁশি, ঢোল, কাঁসর বাজানো হয়। শোভাযাত্রা কেবল একটি শোভাযাত্রা নয়, বরং এটি একটি সংস্কৃতিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার উৎসব। এই উৎসবে বাঙালিরা তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলে। এতে করে বাঙালিদের মধ্যে ঐক্য ও বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে।
বাংলা নববর্ষ যেনো বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উৎসব আনন্দে মেতে ওঠার দিন। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় গণমুখী উৎসব। নববর্ষ সেজন্যই আমাদের আর্থসামাজিক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাঙালির আভিজাত্যের অহংকার। যদিও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেকেও খ্রিস্টীয় সালের দিনক্ষণ মেনে চলতে হয়। তবুও বাঙালির ঐতিহ্যের শিকড়ে প্রোথিত বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। মহিমায় উজ্জ্বল। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষই দেশের সর্বজনীন বড় উৎসব।
পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বর্তমানে পান্তা ইলিশ বাঙালিদের কাছে একটি জনপ্রিয় খাবার হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়া প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পহেলা বৈশাখে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দোকান গুলোতে পান্তা ইলিশ খাওয়ার জন্য ভিড় জমে। অনেকে বাড়িতেও পান্তা ইলিশ রান্না করেও খায়।
বাংলা নববর্ষ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও বিভিন্নভাবে পালিত হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেখা যায়,বিউ ফুল, নিমপাতা আর পাঁচন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার অন্যতম মাধ্যম। বছরকে বছর চলে আসছে এই সংস্কৃতি। কালের বিবর্তনে অনেক কিছু ফিকে হয়ে গেলেও এই সংস্কৃতির এখনো পরিবর্তন হয়নি। তাই তো নববর্ষ এলেই প্রত্যেক ঘরে ঘরে চলে বিউ ফুল আর নিমপাতা দিয়ে ঘর সজ্জিত করার উৎসব। এখানেই শেষ নয়; সেই সাথে চলে ১০৮টি বা আরও বেশি সবজি দিয়ে পাঁচন রান্নার বাঙালি পরিবারের দীর্ঘদিনের আচার।
পহেলা বৈশাখের আগেরদিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষদিনে কিংবা অনেকে আবার বৈশাখের দিনেও পাচন রান্না করে ঘরে ঘরে। বাংলা বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তি হিসেব করে হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়। কিন্তু বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ সরকারিভাবে নির্ধারিত আছে ১৪ এপ্রিল। বাংলাদেশে বসবাসরত সকল বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এদিনেই পহেলা বৈশাখ পালন করেন। হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন একদিন পরে আবার নববর্ষের ধর্মীয় আচারও পালন করেন।
বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে আরও একটি খাবার এইসময় করা হয়। মুড়ি, বুট, বাদাম, মিষ্টি জিরা, মিষ্টি কুমড়োর বিচি, শিম বিচি, মুগ বা খেসারি ডাল ও ভুট্টা ইত্যাদি এইসব সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এই খাবারটি বানানো হয়, যাকে বলে আটকড়ই। আর সাথে থাকে বিভিন্ন রকমের নাড়ু। এর মধ্যে আছে- খইয়ের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, জিরার নাড়ু, বরই নাড়ু, মুড়ি ও চিড়ার মোয়া, গুড় মেশানো খই, মুড়ি, চিড়া, তিলের নাড়ু, ঘস্যার টপি, বাদামের টফি ইত্যাদি।
শাস্ত্রীয় অনুসারে, ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে বরাহমিহির রচিত ‘পঞ্চসিদ্ধিকা’ নামের জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থে উল্লেখিত সূর্যসিদ্ধান্ত অনুসারে আকাশলোকের বিশাখা নক্ষত্র অনুসারে বৈশাখই বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। সে হিসেবে পহেলা বৈশাখকে নববর্ষের দিন ধরা হয়। আর সেই সাথে এইবার নবযুগ পঞ্জিকা মতে, বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) ফুলবিউ, শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) মুলবিউ এবং শনিবার (১৫ এপ্রিল) বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেবেন সনাতনীরা।
রীতি অনুযায়ী, ফুল বিউতে ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করে দরজায় ঝোলানো হয় ফুলের মালা আর নিমপাতা। নিমপাতা রোগবালাই তাড়াবে, আর ফুল জানাবে-স্বাগতম।
চৈত্র সংক্রান্তি বা মূল বিউতে ভাতের সাথে ১০৮টি বা আরও বেশি সবজি দিয়ে রান্না করা পাঁচন খাওয়া হয় ঘরে ঘরে। অনেক সময় দেখা যায় অনেক পাড়া প্রতিবেশীও ঘরে ঘরে এসে পাঁচন রান্না করে দিয়ে যায়।
এইদিকে পহেলা বৈশাখে ভোর হতেই স্নান সেরে নতুন কাপড় পড়ে করে ব্যবসায়ী ও দোকানিরা ব্যস্ত থাকেন হালখাতা খোলার কাজে। লক্ষ্মী ও গণেশের পূজার্চনা শেষে হলুদ আর সিঁদুরমাখা মুদ্রার ছাপ দেওয়া হয় লাল শালুতে মুড়িয়ে রাখা নতুন হালখাতার প্রথম পৃষ্ঠায়।
‘ওঁ শ্রী গণেশায় নমঃ’ কিংবা স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা এই হিসেবের খাতাটাই নতুন বছরের আয় ও সমৃদ্ধির প্রতিভূ। ফুল, কলাগাছ, আম্রপল্লব দেওয়া মঙ্গল ঘট দিয়ে সাজানো দোকানগুলোয় পরিচিত ও বাঁধা গ্রাহকদের জন্য মিষ্টিমুখের আয়োজনও চলে এদিন।
কিন্তু সবকিছু ঠিক থাকলেও বিমুখ হতে বসেছে হালখাতার উৎসব। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান এখন কম্পিউটারে সংরক্ষণ করে রাখছে তাদের যাবতীয় হিসাব। পাশাপাশি বাইন্ডিং হাউসগুলোতে ক্রেতাদের তেমন দেখা নেই। তাই সব দোকানে সেই উৎসবের আমেজ আর পরিলক্ষিত করা যায় না।
অন্যদিকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে পহেলা বৈশাখ সরাসরি কোনো ধর্মীয় উৎসব নয় বা ইসলামী ক্যালেন্ডারের অংশ নয়। এটিকে ইসলামিক চিন্তাবিদ বা আলেমরা বাংলা নববর্ষ উদযাপন এবং সাংস্কৃতিক আচার হিসেবে দেখে এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করে, নতুন বছর যাতে সুখ সমৃদ্ধির সাথে কাটাতে পারে সেজন্য মোনাজাত করে। সেইসাথে অশ্লীলতা কিংবা ধর্মবিরোধী কার্যকলাপ সম্পন্ন গান-বাজনা, বিষয়াদিকে বিরোধিতা করে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে নতুন পোশাক পরা, শুভেচ্ছা বিনিময় করা এবং ‘শুভ নববর্ষ’ বলা খ্রিষ্টানদের মধ্যেও দেখা যায়। এইদিন কেউ কেউ নতুন বছরের জন্য গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করে থাকেন, যেন নতুন বছরটি আশীর্বাদপূর্ণ হয়। সেইসাথে মেলা, বৈশাখী শোভাযাত্রা, সংগীতানুষ্ঠান, গ্রামীণ খেলা ইত্যাদিতে অনেক খ্রিষ্টান ধর্মালম্বীরাও অংশ নেন।
প্রজন্মভেদেও পহেলা বৈশাখেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। আগেরকার প্রজন্মে পহেলা বৈশাখ ছিল মূলত পারিবারিক এবং গ্রামীণ উৎসব। হালখাতা, মেলা, পান্তা-ইলিশ, লোকজ সংস্কৃতি এবং পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে মিলেমিশে দিন কাটানো ছিল সাধারণ চিত্র।লোকসংগীত, পালা গান, যাত্রাপালা ছিল বৈশাখের বড় অংশ। তারা পহেলা বৈশাখকে বাংলা সংস্কৃতি রক্ষার একটি মাধ্যম হিসেবে দেখতেন।বিনোদন ছিল সরাসরি—মেলা, নাটক, গান ইত্যাদি দেখে। সামাজিক যোগাযোগ ছিল মুখোমুখি।পান্তা-ইলিশ, খিচুড়ি, দেশি খাবার ছিল মূল আকর্ষণ। পোশাক ছিল ঐতিহ্যবাহী, যেমন সাদা-লাল শাড়ি, পাঞ্জাবি।
এখন উৎসবটা অনেকটা শহরকেন্দ্রিক এবং ট্রেন্ড-বেইজড হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রমনা, টিএসসি—এই জায়গাগুলোতে ঘুরতে যাওয়া, মঙ্গল শোভাযাত্রা, সেলফি তোলা, ফ্যাশনেবল পোশাক পরা—এসবের দিকে বেশি ঝোঁক।অনেকেই এখন বৈশাখকে একটি ‘ইভেন্ট’ হিসেবে দেখে। যদিও এখনো কিছু মানুষ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, তবে একাংশের মধ্যে এর মূল সংস্কৃতিগত গুরুত্ব কিছুটা হালকা হয়েছে।ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ইত্যাদিতে বৈশাখ উদযাপন প্রচার করা, লাইভ ভিডিও, পোস্ট, ফিল্টার ইত্যাদির মাধ্যমে উদযাপন এখন বেশি প্রচলিত।ঐতিহ্যের সাথে ফিউশন যুক্ত হয়েছে—কিছুটা পশ্চিমা প্রভাব দেখা যায়। খাবারেও নতুনত্ব এসেছে—রেস্টুরেন্ট কালচারে উৎসবের অংশ হয়ে উঠেছে।
শুধু তাই নয়, পহেলা বৈশাখের ছোঁয়া লেগে আছে চাকমা সম্প্রদায়ের মাঝেও। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে চাকমা সম্প্রদায়ের উদযাপন ভিন্নধর্মী এবং সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তারা এই উৎসবকে মূলত ‘বিজু উৎসব’ হিসেবে পালন করে থাকেন, যা তিন দিনব্যাপী একটি বড় উৎসব। বিজু হচ্ছে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক উৎসব।
চাকমাদের বিজু উৎসবের তিনটি ধাপ আছে। প্রথমত হলো ফুল বিজু, যা উৎসবের প্রথম দিন হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনে লোকেরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, নদীতে বা ঝরনায় গিয়ে ফুল তোলে, সেই ফুল দিয়ে ঘরে ও বুদ্ধের মূর্তিতে অর্ঘ্য দেয়। এটি একটি শুদ্ধি এবং পবিত্রতার প্রতীক। পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
এরপরই রয়েছে মূল বিজু, এটি উৎসবের মূল দিন। এই দিনে ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না হয়—বিশেষ করে ‘পচন (পাচন)’ নামক একটি মিশ্র তরকারি, যেখানে নানা রকম শাক-সবজি একসাথে রান্না করা হয়। পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে উপহার ও খাবার আদান-প্রদান হয়। গান-বাজনা, নাচ, পানি ছিটানোর উৎসব, এবং গ্রাম্য খেলাধুলা হয়।
এরপর গোজ্যা পূজা করে থাকে উৎসবের তৃতীয় দিন। এই দিনে চাকমারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে কাটায়। বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে প্রার্থনা করে, পুণ্য দান করে এবং পুরানো বছরের পাপ মোচনের জন্য বুদ্ধমূর্তিতে জল ঢালে।
তবে চাকমা সম্প্রদায়ের বিজু উৎসবের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় থাকে পানি উৎসব বা জল উৎসব। মূলত বিজু উৎসবের অংশ হিসেবে পালিত হয়, এবং এটি সাধারণত মাঝের দিন, অর্থাৎ মূল বিজুতে অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনে তরুণ-তরুণীরা একে অপরকে পানি ছিটিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে, যা শুভ কামনা ও শুদ্ধতার প্রতীক। এটি মূলত পুরনো দুঃখ, গ্লানি ধুয়ে ফেলে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর একটি প্রতীকী রীতি।
এই পানি উৎসবটি চাকমাদের পাশাপাশি মারমা ও রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরও বেশি উৎসবমুখরভাবে পালিত হয়। বিশেষ করে মারমারা এটিকে সাংগ্রাই উৎসব হিসেবে উদযাপন করে। পহেলা বৈশাখ চাকমাদের কাছে শুধু বাংলা নতুন বছর নয়, বরং সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় মিলনের একটি বিশেষ উপলক্ষ।
প্রজন্ম বদলেছে, উদযাপনের ধরন বদলেছে, কিন্তু পহেলা বৈশাখের আসল তাৎপর্য এখনো হারিয়ে যায়নি। বরং তা নতুন রূপে, নতুন মাত্রায় প্রকাশ পাচ্ছে। পহেলা বৈশাখের উদযাপনে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, যার ফলে অনেকেই ভাবতেই পারে পহেলা বৈশাখের প্রাথমিক তাৎপর্য হারিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু বাস্তবতা হলো, সময়ের সঙ্গে সংস্কৃতির উপস্থাপনায় পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। প্রজন্মের পছন্দ ও প্রযুক্তির বিকাশ এর উপর প্রভাব ফেললেও, পহেলা বৈশাখ এখনও বাঙালির জাতীয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিরাজমান।
শুধু শহরে নয়, গ্রামেও এখন পহেলা বৈশাখ নতুনভাবে উদযাপিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বৈশাখী শুভেচ্ছা বিনিময়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার, এবং তরুণদের মধ্যে এই উৎসব নিয়ে উন্মাদনা—এসবই প্রমাণ করে যে, বৈশাখের গুরুত্ব হারিয়ে যায়নি, বরং নতুন প্রেক্ষাপটে আরও বিস্তৃত হয়েছে।
বাঙালিয়ানার প্রতি আন্তরিক আনুগত্যের কারণেই বাংলা নববর্ষ এখনো প্রত্যেকের মনে সংস্কৃতির আভিজাত্য হিসেবে রঙিন আলো ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, বলা যায় যে প্রজন্মভেদে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের ধরণে পরিবর্তন এলেও, এর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব এখনও অটুট রয়েছে। এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে যুগে যুগে টিকে আছে এবং থাকবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
সারাবাংলা/এএসজি