গাজা: ক্রমবর্ধমান মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট
১২ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:১৫
গাজা উপত্যকা ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড, যা দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি দখলদারত্ব, অবরোধ এবং সংঘাতের শিকার। ইসরায়েল ও মিশরের অবরোধের ফলে গাজার অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সাধারণ জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত এক দশকে গাজা উপত্যকা হয়ে উঠেছে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম আলোচনার কেন্দ্রে। যা ইসরায়েলী বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়ে মানবিক বিপর্যয়ের দারপ্রান্তে রয়েছে। ইসরায়েল-হামাস সংঘাত নতুন করে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং শক্তির রাজনীতিকে। গাজার বর্তমান অবস্থা কেবল একটি ভূখণ্ডের সংকট নয়, বরং এটি আজকের বিশ্বের রাজনৈতিক মূল্যবোধের একটি প্রতিচ্ছবি।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, নাকি নতুন অধ্যায়?
গাজার সংকট নতুন নয়। ২০০৭ সালে হামাসের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর থেকে এই ভূখণ্ড কার্যত এক বৃহৎ খোলা কারাগারে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েল ও মিশরের অবরোধ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ও দারিদ্র্যের মধ্যে বন্দি প্রায় ২৩ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। যা বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত করে দেয়। বলা বা ব্যাখ্যা করার ভাষা পর্যন্ত হারিয়ে যায় সুস্থ স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষের।
তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সহিংসতা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ। হামাসের হামলায় ইসরায়েলের বহু বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর ইসরায়েল পাল্টা আক্রমণ শুরু করে গাজায়। কয়েক মাসের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষ নিহত, লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত এবং অবকাঠামোর বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে এমন জনমানবহীন ধ্বংসযজ্ঞ কল্পনাও করা কঠিন। যা চলছে বিরামহীন!
সাম্প্রতিক সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে আকস্মিক হামলার পর ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। এই সংঘাতে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৫,০০০ এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে মর্মে জানা যায়। যার মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। এছাড়া, ১০৬,৯৬২ জন আহত হয়েছে, এবং হাজার হাজার মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা যায়, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজায় ১৫ জন প্যালেস্টিনীয় স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন হামলার ভিডিও ধারণ করেছিলেন। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। যদিও ইসরায়েল এই বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও দ্বৈত মানদণ্ড
গাজার বিপর্যয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় যে দ্বৈত মানদণ্ড রয়েছে, তা আজ আর অজানা নয়। পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ শুরুতে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে দাঁড়ালেও, গাজার বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনার তীব্রতা বাড়ে। জাতিসংঘ একাধিকবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও, তা কার্যকর হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যদের ভূমিকায় দেখা গেছে কৌশলগত দ্বিধা—একদিকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরোধিতা। যা কেবলই মোড়লী রাষ্ট্রের অবিমৃষ্যকারী বৈ আর কিছু কি? এই দ্বৈত মানদণ্ড বিশ্ব দক্ষিণের দেশগুলো, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে—ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরোধিতায় যেভাবে পশ্চিমা বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ, গাজার ক্ষেত্রে সেই নৈতিক জোর কোথায় হারিয়ে যায়? কেনই বা বিশ্ব বিবেক এতটা নীরব থেকে মুখে কুলুপ এঁটেছে? তা-ও কি ভাববার বিষয় নয়? নাকি এভাবেই ধ্বংস করে দেয়া হবে মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র ও নাগরিকদের? তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় আরব বিশ্বও কেন মৌনব্রত পালন করছে?
আরব বিশ্বের মৌনতা ও বাস্তবতা
আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ। যদিও জনমনে প্রবল ক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেখা গেছে, অনেক সরকার কৌশলগতভাবে নীরব থেকেছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের পথে হাঁটছিল, এবং গাজার যুদ্ধ সেই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুললেও পুরোপুরি থামায়নি। আদতে থামানোর কোন উদ্যোগও লক্ষণীয় ছিল বলেও মনে হচ্ছে না! উপরন্তু, তারা যেন ‘মামা শ্বশুরের সামনে ভাগিনা বউয়ের ভূমিকায়’ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরে জানাবে ধরণের আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে!
মিশরের ভূমিকাও সমালোচিত। রাফা সীমান্ত অল্প সময়ের জন্য খুললেও, অধিকাংশ সময়ই তা বন্ধ ছিল। মানবিক সাহায্য প্রবেশে বাধা, আহতদের চিকিৎসার জন্য স্থান না দেওয়া—সবই প্রমাণ করে, গাজা শুধু ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংকট নয়, এটি আরব বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতাকেও নগ্নভাবে তুলে ধরেছে। এতে বোঝা যায় মানবিক সংকটের ঊর্ধ্বে একেক দেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থই যারযার কাছে বড়। যা তাদের আচরণে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
হামাস: প্রতিরোধ না সন্ত্রাস?
হামাসের ভূমিকাও এ বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ। তারা নিজেদের ‘প্রতিরোধ আন্দোলন’ হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে হামলা চালানোর ফলে আন্তর্জাতিক মহলে তাদের সন্ত্রাসী তকমা অটুট রয়েছে। এর ফলে ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নটিও বিবর্ণ হয়ে পড়ে। হামাসের অস্তিত্ব ইসরায়েলকে একটি ‘নিরাপত্তা হুমকি’ উপস্থাপন করতে সহায়তা করে, যার ওপর ভিত্তি করে ইসরায়েল তার আগ্রাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে প্রত্যক্ষ সমর্থন রয়েছে আমেরিকা ও মিত্র শক্তির।
তবে হামাসের উত্থানের মূল কারণগুলো—ইসরায়েলি দখলদারত্ব, রাজনৈতিক দমন, এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া—সেগুলো বিশ্লেষণে না এনে শুধু প্রতিক্রিয়াকে দোষারোপ করাই কি যথাযথ? কার্যত যা-ই হোক একেবারে সেসবও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তারপরও ভুক্তভোগী গাজা তথা ফিলিস্তিনের বেসামরিক জনগণ।
মিডিয়া ও তথ্য যুদ্ধ
গাজার যুদ্ধ আরেকটি বড় মাত্রা পেয়েছে তথ্যমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। পশ্চিমা মূলধারার সংবাদমাধ্যমে অনেক সময়ই পক্ষপাতদুষ্টতা চোখে পড়ে, যেখানে ইসরায়েলের প্রাণহানিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, আর গাজার গণহত্যা তুলনামূলকভাবে গৌণ করে উপস্থাপন করা হয়। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলনের জোয়ার দেখা গেছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। যে কোন ঘটনা-ই মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে। এতে করে মেইন স্ট্রীম মিডিয়া যেভাবেই প্রচার করুক না কেন, সুরের যেমন ভৌগোলিক সীমারেখা থাকে না, তেমনই কান্নার বা চোখের জলেরও আর কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। যা দেখেই মানুষ বুঝে নিতে পারে। কোন অনুবাদের প্রয়োজন হয় না।
এটি প্রমাণ করে—তথ্য এখন আর একমুখী নয়। মানুষ নিজেরাই ছবি, ভিডিও এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরছে। যদিও ইসরায়েল বারবার গাজায় ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তথ্যপ্রবাহ থামানোর চেষ্টা করেছে, তা পুরোপুরি সফল হয়নি। যা ইসরায়েলের বর্বরোচিত ও পৈশাচিক উন্মত্ততা প্রকাশে বিঘ্ন না ঘটিয়ে আরও সহায়ক হয়। এতে বিশ্ববাসীর নজর এড়িয়ে যায়নি।
সামনে কী?
গাজার ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বিশ্ব। যদি যুদ্ধ থেমেও যায়, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন এবং রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এটি কেবল অস্থায়ী বিরতি হবে। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান—যা এক সময় আন্তর্জাতিক সমর্থন পেত—আজ তা প্রায় অবাস্তব মনে হচ্ছে। পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ, জেরুজালেমের অবস্থান, এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এই পথ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। বলেও মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ।
অবকাঠামোর ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতি
ইসরায়েলের অবিরাম বোমা হামলায় গাজার অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এবং বাসস্থান ধ্বংসের ফলে প্রায় ৯০% জনগণ বাস্তুচ্যুত হয়েছে । তারা অস্থায়ী শিবিরে অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাস করছে, যেখানে মৌলিক সেবা ও নিরাপত্তার অভাব প্রকট।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও জাতিসংঘের ভূমিকা?
গাজার মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। জাতিসংঘ একাধিকবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও, তা কার্যকর হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যা অনেকের মতে একপেশে মনোভাবের প্রতিফলন। অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন দেশ গাজায় স্বাস্থ্যকর্মীদের হত্যার ঘটনায় স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে ।
পরিশেষে, একটি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান তখনই সম্ভব, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বৈত নীতি পরিহার করে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার স্বীকৃতি দেবে, এবং ইসরায়েলকেও আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য করবে। তার আগে, গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে শুধু মানুষই নয়, সমাহিত হয়ে যাচ্ছে মানবতা, ন্যায়বিচার এবং বিশ্ববিবেক! উত্তরণের উপায় খুঁজতে দেরি হলে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে সহিংসতা। এতে করে মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
লেখক: অ্যাডভোকেট; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী
সারাবাংলা/এএসজি