মিয়ানমার: সামরিক আধিপত্যের ছায়ায় গণতন্ত্র ও মানবতা
১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:৫২
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি ভূরাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র মিয়ানমার, যার ইতিহাস গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ঔপনিবেশিক শোষণ, জাতিগত বিভাজন, সামরিক আধিপত্য এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে। একদিকে এটি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, অন্যদিকে দীর্ঘকালব্যাপী সংঘাত আর দমন-পীড়নে জর্জরিত। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটি আরও একবার ছিটকে পড়ে অস্থিরতার অতলে। বর্তমানে দেশটি যে সংকটে রয়েছে, তা শুধু অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, বরং এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও মানবিক ভারসাম্যের জন্য বড় হুমকি।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: সামরিক আধিপত্যের শিকড়
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরই মিয়ানমার একটি গণতান্ত্রিক পথ ধরেছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান দেশটিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য সামরিক শাসনের অধীনে নিয়ে যায়। এরপর প্রায় ৫০ বছর ধরে সামরিক জান্তা দেশটি শাসন করে, যেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার বারবার দমন করা হয়েছে।
২০১১ সালে সামরিক বাহিনী নির্বাচনের মাধ্যমে আংশিক গণতন্ত্রের সূচনা ঘটায়। ২০১৫ সালে অং সান সু চি’র নেতৃত্বে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (NLD) সরকার গঠন করে, যা আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। কিন্তু সামরিক বাহিনী সংবিধানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখে—উদাহরণস্বরূপ, সংবিধানে ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত এবং প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাদের নিয়ন্ত্রণে।
২০২১-এর অভ্যুত্থান: গণতন্ত্রের পথচলায় প্রতিবন্ধকতা
২০২০ সালের নির্বাচনে NLD বিপুল বিজয় অর্জন করলে সামরিক বাহিনী ভুয়া ভোটের অভিযোগ তোলে। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি, পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে তারা অং সান সু চিসহ শীর্ষ নেতাদের আটক করে এবং দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। মিয়ানমার আবার সামরিক শাসনে ফিরে যায়।
এই ঘটনার পরপরই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গণআন্দোলন, যা “Civil Disobedience Movement (CDM)” নামে পরিচিত। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, চিকিৎসক, শিক্ষক, আমলা পর্যন্ত কাজে অংশ না নিয়ে সরকারকে অচল করে তোলে। কিন্তু সেনাবাহিনী গুলি, গ্রেনেড ও বিমান হামলার মাধ্যমে এই আন্দোলন দমন করতে শুরু করে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শুরু পর্যন্ত কমপক্ষে ৪,৫০০ জন বেসামরিক মানুষ সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে এবং ২৫,০০০-এর বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে। ২০ লাখের বেশি মানুষ গৃহচ্যুত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড অনেকক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
জাতিগত সংঘাত: রোহিঙ্গা ও বিস্ফোরণপ্রবণ ভৌগোলিক বাস্তবতা
মিয়ানমার একটি জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ—১৩৫টিরও বেশি জাতিগোষ্ঠী এখানে রয়েছে। সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে এই বৈচিত্র্যকে নিয়ন্ত্রণের জন্য দমননীতির আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইন, কাচিন, কারেন, শান, চিনসহ নানা রাজ্যে স্বাধীনতাকামী বা স্বায়ত্তশাসন চাওয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয়। সামরিক অভ্যুত্থানের পর এসব গোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই NUG (National Unity Government) এবং PDF (People’s Defense Force)-এর সঙ্গে একত্রিত হয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেছে।
বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে নির্মম উদাহরণ। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নিপীড়নের মাধ্যমে সেনাবাহিনী প্রায় ৭ লাখ মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। জাতিসংঘ এটিকে “জাতিগত নিধনের পাঠ্যবইয়ে পড়ানো উদাহরণ” বলে আখ্যা দিয়েছে। আজও সেই রোহিঙ্গারা কক্সবাজার ও ভাসানচরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের নাগরিকত্ব মিয়ানমার অস্বীকার করে, ফেরত নিতে অস্বীকৃতি জানায়, এবং তাদের স্বদেশে ফেরত যাওয়ার কোনো বাস্তবসম্ভব উদ্যোগ নেই।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নিষেধাজ্ঞা বনাম নীরব স্বার্থনীতি
সামরিক অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া সহ বহু দেশ মিয়ানমারের জেনারেলদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অনেক উন্নয়ন সহায়তা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপ সেনাবাহিনীর আচরণে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।
তার একটি বড় কারণ চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা। চীন মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সেনাবাহিনীর বড় রক্ষাকর্তা। চীন “অস্থিতিশীলতা নয়, স্থিতিশীলতা”—এই নীতিতে বিশ্বাসী এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় নির্মাণাধীন কিয়াউকফিউ বন্দর ও গ্যাস পাইপলাইন তাদের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে, রাশিয়া সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে—বিশেষ করে অস্ত্র বিক্রি এবং প্রশিক্ষণে। এই দুই দেশ জাতিসংঘে যেকোনো কঠোর পদক্ষেপ রোধ করে আসছে।
ভারত, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোও দ্বিধান্বিত অবস্থানে। নিরাপত্তা, অভিবাসন, সীমান্ত সমস্যা এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য—এই চারটি কারণে এরা সরাসরি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চায় না।
বাংলাদেশের অবস্থান ও চ্যালেঞ্জ: রোহিঙ্গা সংকটের পুনর্বিন্যাস
বাংলাদেশ মিয়ানমারের সংকটের সবচেয়ে বড় মানবিক শিকার। কক্সবাজারে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। এত বিশাল জনসংখ্যা বাংলাদেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং পরিবেশগত চাপে ফেলেছে। আর্থিক সাহায্য ক্রমেই কমছে। ইউএনএইচসিআরের মতে, ২০২৪ সালে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যে অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন, তার অর্ধেকও এখনো পাওয়া যায়নি।
তদুপরি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মাদক, অস্ত্র, চাঁদাবাজি ও উগ্রপন্থার বিস্তার বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু রোহিঙ্গা গোষ্ঠী মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, যা বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলেছে। টেকনাফ-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনায় এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চাইলেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব এবং আন্তর্জাতিক চাপের অভাবে এই প্রক্রিয়া স্থবির। তাছাড়া, বর্তমান মিয়ানমারে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়াটা মানবিকভাবেও অসম্ভব।
সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ: রূপান্তর নাকি দীর্ঘমেয়াদি সংকট?
বর্তমানে NUG এবং PDF মিয়ানমারের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে বিভিন্ন রাজ্যে সেনাবাহিনীর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিছু বিশ্লেষক বলছেন, সেনাবাহিনী হয়তো ধীরে ধীরে এক বিকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় যেতে বাধ্য হবে, যেখানে কিছু অঞ্চল স্বায়ত্তশাসিতভাবে পরিচালিত হবে। কিন্তু এ ধারণার বাস্তবায়ন খুব কঠিন।
একইসঙ্গে, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়—বিশেষ করে আসিয়ান (ASEAN) ও জাতিসংঘ—একটি সমন্বিত শান্তিপূর্ণ সমাধানে নেতৃত্ব না দেয়, তাহলে মিয়ানমার একটি “ফেল স্টেট” হওয়ার দিকে এগোবে। যার প্রভাব পড়বে পুরো অঞ্চলে—শরণার্থী প্রবাহ, মাদক ও অস্ত্র পাচার, এবং উগ্রপন্থার বিস্তারের মাধ্যমে।
মিয়ানমার সংকট—গণতন্ত্রের জন্য পরীক্ষা, অঞ্চলের জন্য অশনিসংকেত
মিয়ানমার আজ এক অনিশ্চয়তার দ্বারপ্রান্তে। জনগণের রক্তের বিনিময়ে যে গণতন্ত্রের আন্দোলন চলছে, তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ ঐক্য, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আন্তর্জাতিক সদিচ্ছার ওপর। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জন্য এ সংকট শুধু মানবিক নয়, কৌশলগতও। তাই প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি, কৌশলগত এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গড়ে ওঠা নীতিমালা—যা শুধু সমাধান নয়, প্রতিরোধও নিশ্চিত করবে।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি
অ্যাডভোকেট গাজী তারেক আজিজ মানবতা মিয়ানমার মুক্তমত সামরিক আধিপত্য