Monday 14 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভিক্ষাবৃত্তি: নির্মম বাস্তবতা, নাকি পেশা?

সফিউল ইসলাম
১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:০১ | আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৫১

ভিক্ষাবৃত্তি একটি সমাজের অন্ধকার দিক, যা একদিকে মানবিকতার সংকটের প্রতীক, অন্যদিকে কখনও কখনও পেশার রূপ ধারণ করে। আমরা যখন ভিক্ষাবৃত্তি সম্পর্কে ভাবি, তখন দুইটি দৃষ্টিভঙ্গি সামনে আসে একটি, যেখানে এটি একটি অসহায় অবস্থার ফলস্বরূপ, এবং অন্যটি, যেখানে এটি একটি নিয়ন্ত্রিত পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রশ্ন হলো, এটি কেবল জীবনের নির্মম বাস্তবতা, নাকি এটি একটি পেশার রূপ নেবে? এই আলোচনা করতে গেলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে ভিক্ষাবৃত্তির পেছনে কী প্রাথমিক কারণ রয়েছে এবং কেন এটি সমাজের অনেক অংশে এক ধরনের পেশা হিসেবে পরিগণিত হয়। সবচেয়ে বড় কারণ, এবং অনেক সময় একমাত্র কারণ, ভিক্ষাবৃত্তির দিকে মানুষকে ঠেলে দেয় তা হলো দারিদ্র্য। বহু পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য নেই বা খুব কম আয় রয়েছে, ফলে জীবিকা চালানোর জন্য এমনকি শিশুও বাধ্য হয় রাস্তায় ভিক্ষা করতে। বিশেষত শহরাঞ্চলে যেখানে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, সেখানে ভিক্ষাবৃত্তি অনেকের কাছে একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময়, একটি সামাজিক বা অর্থনৈতিক স্তরের মধ্যে জন্মগ্রহণ করা, বিশেষত নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে, তাদের অন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করার সুযোগ কমিয়ে দেয়। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে এমন একটি অবস্থায় তারা চলে আসে, যেখানে নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য প্রাথমিকভাবে ভিক্ষা করার পথ বেছে নেয়।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে, অনেক ভিক্ষুকের জীবন শুরু হয় পারিবারিক অবস্থা বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে। এমন অনেক শিশু বা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি আছেন, যারা অসুস্থতা বা অক্ষমতার জন্য কোনো কাজ করতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে, ভিক্ষা তাদের একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে জীবিকা অর্জনের।

বিভিন্ন শহরে, বিশেষত বড় শহরগুলোতে, ভিক্ষাবৃত্তির পেছনে কখনও কখনও থাকে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের হাত। কিছু অপরাধী গোষ্ঠী শিশু বা প্রাপ্তবয়স্কদের জোরপূর্বক ভিক্ষা করানোর জন্য নিয়ে আসে। তারা শোষণ করে, কাজের ফলস্বরূপ ভিক্ষাবৃত্তির আয় তাদেরই হাতে চলে আসে। এমনকি এসব গোষ্ঠী শিশুর শারীরিক অঙ্গহানিও করতে পারে, যাতে মানুষ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তাদের অধিক সহায়তা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ভিক্ষাবৃত্তি সঠিকভাবে না বুঝে বা চ্যালেঞ্জ না নিয়ে কিছু লোকের কাছে সহজ উপার্জনের পথ হিসেবে গণ্য হয়। তারা এমন চিন্তা করে যে, রাস্তায় বসে, কিছু টাকা হাতে আসবে, আর এর জন্য তেমন পরিশ্রমও করতে হবে না। এ কারণে কিছু লোক ভিক্ষাবৃত্তি পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের কাছে এটি এক ধরনের ব্যবসার মতো হয়ে ওঠে, যেখানে কম পরিশ্রমে বেশি উপার্জন সম্ভব। ভিক্ষাবৃত্তির আরেকটি কারণ হচ্ছে সমাজের মানুষের সহানুভূতির প্রতি নির্ভরতা। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, অধিকাংশ মানুষ খুব সহজেই শিশু, বৃদ্ধ বা অসুস্থ মানুষদের সাহায্য দিতে আগ্রহী হয়। কিছু ব্যক্তি এই সহানুভূতির সদ্ব্যবহার করে, ভিক্ষাবৃত্তিকে একটি আয় করার পথ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা জানে যে, পথচারীরা তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। যেহেতু ভিক্ষাবৃত্তি অনেক ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, সেখানে ভিক্ষুকরা এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কাজ করে। এক্ষেত্রে, অনেক পেশাদার ভিক্ষুক বিভিন্ন ধরনের কৌশল ব্যবহার করে সহানুভূতি অর্জন করে এবং তাদের আয় নির্দিষ্ট একটি চক্রের মাধ্যমে ভাগ হয়ে যায়। অনেক দেশ এবং সমাজে ভিক্ষাবৃত্তির ওপর বিশেষ কোনো আইনি বিধি বা কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেই, যার কারণে এটি একটি বৈধ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আইনগত কঠোরতার অভাবের কারণে, ভিক্ষাবৃত্তি অনেক ক্ষেত্রেই পেশাদারিত্বের রূপ নেয় এবং এর পেছনে কোনো বাধা থাকে না। ভিক্ষাবৃত্তি শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সমাজের জন্যও এক ধরনের অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের উন্নতি, প্রগতি এবং মানবাধিকার সবই ভিক্ষাবৃত্তির কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। এটি আমাদের নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধের বিপরীত। বিশেষত, শিশুদের ক্ষেত্রে, তাদের জীবন থেকে শিক্ষা এবং উন্নতির সুযোগ নষ্ট হয়, এবং তারা ভবিষ্যতে একজন সঠিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

এছাড়া, যেসব শিশুরা ভিক্ষা করে, তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যও বিপর্যস্ত হয়। শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও শিক্ষামূলক পরিবেশ তৈরির পরিবর্তে, তাদের একটি অসম্মানজনক জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হয়। ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে হলে একাধিক স্তরে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি শুধুমাত্র রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, সমাজের প্রতিটি ব্যক্তিরও দায়িত্ব। শিশুদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা আরো উন্নত এবং সহজলভ্য করতে হবে। একটি শিশুর লেখাপড়া না করতে পারলে, তার জীবনের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়। দারিদ্র্য দূর করতে হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা, মানুষের জীবনের মান উন্নত করতে সাহায্য করবে। ভিক্ষাবৃত্তির বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মানুষের মধ্যে এই ধারণা গড়তে হবে যে, ভিক্ষুকদের সাহায্য করাই তাদের উন্নতির পথে একধাপ এগিয়ে নিতে পারে না, বরং তাদের পুনর্বাসনের জন্য সহায়তা করা উচিত। ভিক্ষাবৃত্তি কোন পেশা নয়, এটি একটি সামাজিক সংকট এবং মানবিক সমস্যার প্রতীক। এটি শুধু জীবনযাত্রার সংকট নয়, বরং এক ধরনের সামাজিক ব্যর্থতার ফলস্বরূপ দাঁড়ায়। আমাদের দায়িত্ব হলো সমাজে অশিক্ষা, দারিদ্র্য এবং বৈষম্য দূর করা, যাতে শিশুরা শুধু ভিক্ষাবৃত্তি নয়, বরং সুস্থ, শিক্ষিত এবং সম্মানজনক জীবন পেতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী

সারাবাংলা/এএসজি

পেশা বাস্তবতা ভিক্ষাবৃত্তি মুক্তমত সফিউল ইসলাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর