বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েনি এমন মানুষ খুবই কম। চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং বন্দরনগরী হিসেবে পরিচিত হলেও, এর প্রকৃতি, পাহাড়, সমুদ্র ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা সৌন্দর্য সত্যিই অনন্য। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করেছে। চট্টগ্রাম পাহাড়ের ছায়ায় গ্রামীণ পরিবেশ ভ্রমণপিপাসুদের মোহিত করে।চট্রগ্রামের এই অপার সৌন্দর্যের প্রেমেও মজেছিলেন দেশবরেণ্য কবি সাহিত্যিকরা।দেশবরেণ্য কবি, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ তার চট্রগ্রামের সৌন্দর্য নিয়ে বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা এক অভিজ্ঞতা, যা শব্দে প্রকাশ করা কঠিন।’ এর মাধ্যমে বুঝায় যায় চট্টগ্রাম তার সৌন্দর্য দিয়ে মানুষের সাথে প্রকৃতির মেলবন্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
শুধু হুমায়ূন আহমেদ নয়, চট্টগ্রামের সৌন্দর্য প্রকৃতি, পাহাড়, সমুদ্র, নদী এই সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে বহু কবি-সাহিত্যিক তাদের লেখনীতে চট্টগ্রামের প্রশংসা করেছেন।
এখন আসা যাক চট্টগ্রামের সংস্কৃতির সাথে। সংস্কৃতি শব্দটির মানে হলো ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক। সহজভাবে বলতে গেলে সংস্কৃতি হলো একটি জাতি, গোষ্ঠী বা সমাজের জীবনযাপন পদ্ধতি, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, কৃষ্টি, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, পোশাক, ভাষা, ধর্ম, মূল্যবোধ ইত্যাদির সমন্বয়। কিন্তু সংস্কৃতিকে যেনো নিজের সন্তানের মতো অনেকটাই লালন পালন করেছে চট্টগ্রাম।
বাউল গান,জারি ও সারি গান, মারফতি গান, ঈদ, পূজা, বর্ষবরণ, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা সম্প্রদায়ের বিজু উৎসব, মারমা এবং রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর সাংগ্রাই উৎসব বিভিন্ন ধরণের খাদ্যসামগ্রীর সংস্কৃতিও রয়েছে।
চট্রগ্রামে এই বিভিন্ন রকম সংস্কৃতির মধ্যে জব্বারের বলী খেলা যেনো দৃষ্টিনন্দন সংস্কৃতির নজির স্থাপন করেছে। তাই প্রত্যেক বছর নববর্ষ উদযাপনের পর সাধারণ মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলা এবং অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে চট্রগ্রামের সবচেয়ে বড় এই সংস্কৃতির জন্য। বলা চলে বলী খেলাকে চট্টগ্রাম সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও অহংকার।
১৯০৯ সালের ২৫ এপ্রিল, বাংলা ১২ বৈশাখ তারিখে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার চট্টগ্রামের লালদিঘির মাঠে এই বলী খেলার আয়োজন করেন। খেলাধুলার মাধ্যমে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি এই খেলার সূচনা করেছিলেন।
আর সংস্কৃতি যে শুধু বিনোদনের অংশ নয়, লড়াই-সংগ্রামেরও অংশ, একথা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন।মূলত সুলতানি আমল থেকে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে কুস্তির চর্চা হতো চট্টগ্রামে। তখন এ অঞ্চলের সেনারা ছিলেন মূলত পদাতিক। তাই কুস্তির মধ্য দিয়ে শারীরিক সামর্থ্য ধরে রাখার প্রয়োজন ছিল তাদের। এরপর মল্ল সম্প্রদায়ের মানুষজন গ্রামে গ্রামে বৈশাখ মাসে বলী খেলার আয়োজন করতেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অচিরেই ব্রিটিশ বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। সে কারণে তাদের কর্মকান্ডের উপরে ব্রিটিশদের সার্বক্ষণিক নজর ছিল। তাই বিকল্প পন্থা হিসাবে খেলাধুলাকে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিপ্লবীরা ও তাদের সমর্থকরা।
আবদুল জব্বারের বলী খেলাও খেলাধুলার আড়ালে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতার অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। ব্যবসায়ী জব্বার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ব্যতিক্রমধর্মী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করলেও, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
একসময় বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকে স্বনামধন্য বলীরা এ খেলায় অংশগ্রহণ করতেন। এ প্রসঙ্গে চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ বইয়ে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম বলীর দেশ। ‘মল্লযুদ্ধে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন কালের। চট্টগ্রামে মল্ল নামে খ্যাত বহু প্রাচীন পরিবার দেখা যায়।কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের উনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলী খেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলী খেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা।
চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবারের ইতিহাস রয়েছে। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল।
‘মল্ল’ শব্দটি দেশীয়, মল্লযুদ্ধে যারা অংশ নিতেন, তারা ‘মল্লবীর’ নামে খ্যাতি পেতেন। নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য সে সময় রাজা ও জমিদারেরা কুস্তিগির রাখতেন বেতনের বিনিময়ে। মল্লযুদ্ধই চট্টগ্রামে বলীখেলা নামে সমধিক পরিচিতি পায়।
বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের শতাব্দীপ্রাচীন সর্বজনীন এক লোক উৎসবের নাম। ‘বলী’র আভিধানিক অর্থ পরাক্রমশালী, বীরপুরুষ। বলীদের অতীতে অঞ্চলভেদে ‘মল্ল’ ও ‘মাল’ বলা হতো। এর আভিধানিক অর্থ কুস্তিগির,পালোয়ান। শক্তি, সাহস ও কৌশলই বলীদের কুস্তিতে জেতার প্রধান মন্ত্র।
ধারণা করা হয়, চট্টগ্রামে বলীখেলা আরবদের দ্বারাই প্রচলিত হয়েছে। আরব মুসলিমরা অষ্টম শতকেই চট্টগ্রামে আসা শুরু করে। তবে মুসলমানদের প্রথম চট্টগ্রাম বিজয় হয় চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। সুলতানি ও মোগল আমলে মল্ল বা বলীখেলা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায়।
এ ছাড়া মোগল আমলে বলীখেলা ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। তবে বলীখেলার স্বর্ণযুগ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। তৎকালীন সময় চট্টগ্রাম জেলার সর্বত্র চৈত্র থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত বলীখেলার আয়োজন করা হতো। তখন এ অঞ্চলের অনেকেই ছিলেন ইয়াঙ্গুন তথা মিয়ানমারপ্রবাসী। তাদের বলা হতো ‘রেঙ্গুইন্যা’। তারাই ছিলেন বলীখেলার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। পরবর্তীকালে রেঙ্গুইন্যাদের ছাড়াও প্রথিতযশা অনেক ব্যক্তি বলীখেলার সমঝদার ছিলেন। জানা যায়, ঢাকার নবাব আবদুল গনিও এই বলীখেলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
বলীখেলার উদ্ভবের ইতিকথা সম্পর্কিত বিবরণে কবি আলাদীন আলীনূর লিখেছিলেন, ‘প্রতিবছর চৈত্রের শেষার্ধে আর বৈশাখের প্রথমার্ধে আসে মাসব্যাপী বলীখেলার মৌসুম। সঙ্গে সঙ্গে বসে আনন্দ মেলা, নয়া নয়া পণ্যের হয় আমদানি, চলে হরদম বেচাকেনা। চারদিকে শুনি শুধু বাদ্যধ্বনি আর সানাইয়ের আওয়াজ। যখন শোনা যায় যে দক্ষিণ চট্টগ্রাম থেকে, অর্থাৎ ১৩৪৫-৪৬ সালে পরিব্রাজক ইবনে বতুতার পরিদর্শন ধন্য বরহনক থেকে আনক্যা বলীরা খেলায় যোগ দিতে আসছে, তখন দর্শকদের আগ্রহ ও উত্তেজনা বেড়ে যায়। কবি কালিদাসের জন্মভূমি পশ্চিম মালব, অর্থাৎ পটিয়ার মালিয়ারা থেকে এবং কবি আফজল আলীর জন্মভূমি পূর্ব মালব, অর্থাৎ সাতকানিয়ার মল্ল দেশ মিলুয়া থেকে প্রথম মল্লক্রীড়ার অনুষঙ্গ হিসেবে বলীখেলার উদ্ভব এবং পরে সমগ্র চট্টগ্রামে ব্যাপ্ত হয়।’
বলীখেলা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সবচেয়ে চালু ও অবিসংবাদী অভিমতটি হলো স্বদেশিয়ানায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি দৈহিক শক্তি প্রদর্শনের খেলাটি চালু করেছিলেন। তরুণ ও যুবকের মনে দেশপ্রেমের চেতনা সঞ্চার করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। তখন চট্টগ্রামে গুপ্ত বৈপ্লবিক সংগঠন ও সমিতিগুলো গড়ে উঠেছিল। ক্লাব, ব্যায়ামের আখড়া, শরীরচর্চাকেন্দ্র ইত্যাদির আড়ালে নবজাগ্রত যুবসমাজ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সংকল্পে সংগঠিত হচ্ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, যুবকেরা সাহসী হয়ে উঠুক, শক্তি সঞ্চয় করুক এবং যেদিন দেশের ডাক আসবে, সেদিন যাতে ভয়ে দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে তাদের পিছিয়ে আসতে না হয়।
আবদুল জব্বার সওদাগর যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই বলীখেলাটি চালু করেছেন, তা এখন চট্টগ্রাম বৃহত্তম বার্ষিক লোক উৎসব। চট্টগ্রাম কেন বাংলাদেশেও বোধ হয়, এত বড় খেলা ও মেলা দ্বিতীয়টি নেই।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে বলীরা খেলায় অংশ নিতে মাস দু’য়েক আগে চট্টগ্রামে এসে জড়ো হতেন। আব্দুল জব্বার সওদাগরের বাড়িতেই বড় একটা বৈঠকখানার ব্যবস্থা ছিলো। সেই ঘরেই থাকতেন। সেখানেই তারা খাওয়াদাওয়া করতেন এবং দিনভর নানা শারীরিক কসরত ও অনুশীলন করতেন, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতেন। সত্তরের দশক থেকে সারা দেশের বলীরা জব্বারের বলী খেলায় আসছেন। এমনকি একবার ফ্রান্স থেকে দুজন কুস্তিগীর এখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তবে বলী খেলায় আগত অংশগ্রহণকারী সাধারণত চট্টগ্রাম ও আশপাশের অঞ্চল থেকে আসেন কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বলীদের সেই প্রতাপ ও তাদের সামর্থ্য কিছুটা মলিন হয়েছে। তবে এখনো শখের বসে শ-খানেক বলী সারাদেশ থেকে জব্বারের বলী খেলায় আসেন। এবং অনেকেই গ্রামাঞ্চলের বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ হয়ে থাকেন। তাদের পারিবারিক ও আর্থিক অবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সীমিত বা সংগ্রামী ধরনের হয়ে থাকে।
অনেক বলীকে দেখা যায় কৃষক পরিবারের সন্তান হয়ে থাকে, কেউ কেউ ছোট ব্যবসা বা চাকরির সাথে জড়িত। পরিবারগুলোর মধ্যে ক্রীড়ার প্রতি ভালোবাসা থাকলেও, প্রাতিষ্ঠানিক ক্রীড়া প্রশিক্ষণের সুযোগ খুব সীমিত। আবার অনেকেই কুস্তির প্রতি পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। বাবা, চাচা বা বড় ভাই বলী ছিলেন, সেই ধারাবাহিকতায় তারাও বলী হন।
অন্যদিকে বেশিরভাগ বলীর কোনো নির্দিষ্ট আর্থিক সহায়তা থাকে না। তারা নিজের খরচে প্র্যাকটিস করেন এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। অনেক বলী দৈনন্দিন জীবনে শ্রমজীবী — যেমন জেলে, রাজমিস্ত্রী, রিকশাচালক বা হোটেল কর্মী। কিছু বলী স্থানীয়ভাবে ছোটখাটো পৃষ্ঠপোষকতা পান, কিন্তু বড় পৃষ্ঠপোষকতা বা রাষ্ট্রীয় সহায়তা খুবই সীমিত।
অনেক বলী কুস্তিকে নেশা বা আত্মসম্মানের অংশ হিসেবে ধরে রাখেন। কিছু বলী প্রশিক্ষক বা স্থানীয় কুস্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করেন। যদিও বলী খেলার মাধ্যমে তারা তেমন আর্থিক লাভ করেন না, তবে সমাজে একটা সম্মানজনক অবস্থান পান।
বলীখেলা দিয়ে শুরু হলেও পরে চট্টগ্রামের লোকশিল্প ও কৃষিজ পণ্যসামগ্রীর প্রদর্শন ও বেচাকেনাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এটি জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা হিসেবে পরিচিতি হয়ে ওঠে। যতই দিন যেতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে মেলার পরিসর। যা চট্রগ্রাম নগরীর মানুষের কাছে যেনো প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। নগরের আন্দরকিল্লা, বক্সিরহাট, লালদিঘি পাড়, কেসিদে রোড, সিনেমা প্যালেস, শহীদ মিনার সড়ক, কোতোয়ালি মোড়, জেল রোডসহ প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে এ মেলার বিস্তৃতি ঘটে।
বলীখেলা ও মেলায় সারা দেশ থেকে রকমারি পণ্যের পসরা নিয়ে হাজির হয় মৃৎশিল্পী, বাঁশ-বেতশিল্পী, কামার-কুমার, কাঠমিস্ত্রি, আসবাব নির্মাতারা। কী থাকে না লালদিঘির মেলায়! জীবনের, সংসারের এমন কোনো প্রয়োজনীয় বস্তু নেই, যা লালদিঘির মেলায় পাওয়া যায় না। আধুনিক, শিক্ষিত গৃহবধূ পর্যন্ত সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন লালদিঘির মেলার জন্য। এ মেলা থেকেই তারা সংগ্রহ করেন সংসারের অতিপ্রয়োজনীয় সব জিনিস—ডালা, কুলা, পিঁড়ি, মাথাল, দা, ছুরি, বঁটি, পাটা, ঝাড়ু, হাতপাখা, বাঁশ ও বেতের তৈরি নানা আসবাব। পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার জন্য খুব ভোরে ভিড় করেন নারীরা। এ ছাড়া মেলার একটা বিশাল অংশজুড়ে থাকে নার্সারি, বনসাই গাছের প্রদর্শনী।
জব্বারের বলী খেলার মেলায় আগত বিক্রেতা ও হস্তশিল্পীরা সাধারণত সেই সব মানুষ, যারা মূলত গ্রামীণ, প্রান্তিক বা ছোট ব্যবসায়ী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এই মেলাটি তাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ—তাদের জীবিকা, আশা, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
এই মেলায় বিক্রেতাদের অনেকেই মৌসুমভিত্তিক ব্যবসায়ী। তারা সারা বছর গ্রামে বা মফস্বলে বিভিন্ন মেলায় অংশ নেয়। জব্বারের বলী খেলার মেলা তাদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক ও গুরুত্বপূর্ণ মেলা। কারণ এতে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে।
মেলা বাদে এখানেই অনেকেই খুচরা দোকানদার হস্তশিল্পী খেলনা প্রস্তুতকারক অথবা গ্রামীণ কুটির শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ কৃষিকাজ, দর্জির কাজ, অথবা দিনমজুর হিসেবেও কাজ করেন। অনেকে বছরের অন্য সময় সঞ্চিত আয় দিয়ে সংসার চালান, আবার কেউ কেউ ঋণ নিয়ে পণ্য তৈরি করে মেলায় বিক্রির আশা রাখেন।
মেলায় আগত বিক্রেতাদের মূলত জীবনযাপন আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন নয়। বলা যায় তাদের জীবনযাপন সাধারণত কষ্টকর ও অনিশ্চিত। তারা মূলত নির্ভর করে মৌসুমী ব্যবসার ওপর। তাদের ওই আয়ের অর্ধেক ব্যয় হয়ে যায় মেলাতে জায়গা ভাড়া, পরিবহন ও থাকার খরচে। অন্যদিকে আবহাওয়াজনিত সমস্যা, প্রশাসনিক অনুমতি বা নিরাপত্তাজনিত কারণে মেলা ভালো না হলে বিপুল ক্ষতি হয়।
অন্যদিকে মেলাকে ঘিরে বিক্রেতাদের আগ্রহও অনেক। বলী খেলার মেলা তাদের কাছে শুধু আয়ের উৎস নয়, বরং উৎসব ও আত্মপরিচয়ের প্রকাশ। তারা এতে সারা বছরের সঞ্চয়, পরিশ্রম এবং আশা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।অনেক বিক্রেতার কাছে মেলায় বেচা-বিক্রি ভালো হলে ঘরও ভালো চলে এবং মনও ভালো থাকে। প্রজন্ম ধরে অনেক পরিবার এই মেলায় অংশ নিচ্ছে, যেন এটি তাদের ঐতিহ্যবাহী রুটিন।
বর্তমান সময়কে বলা হয় তরুণ প্রজন্মের যুগ। তরুণ প্রজন্মের প্রাধান্য তাই সবার থেকে অনেকাংশেই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তাই তাদের সাথে পুরোনো প্রজন্মের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকবে তা নিশ্চিতভাবেই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু জব্বারের বলী খেলার মেলা যেনো কোথাও গিয়ে তা হারিয়ে যেতে দেয়নি। শুধু উদযাপনের ধরণটা বদলে গিয়েছে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও পণ্যগুলোর প্রতি আগ্রহ থাকে বেশি। বিক্রিত পণ্যসমূহ যেমন: বাঁশি, কাঠের পাখি, লাটিম, হা-ডু-ডু খেলনার মতো ঐতিহ্যবাহী খেলনা, মাটির বাসন, গ্রামীণ গহনা, হাতে তৈরি ব্যাগ/চপ্পল, ঐতিহ্যবাহী খাবার (চানাচুর, খেজুর গুড়, খৈ, পিঠা) কাঠের, লোহার, কিংবা বাঁশের তৈরি গৃহস্থালী সামগ্রী ইত্যাদির উপর নস্টালজিয়া অনুভব করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কনটেন্ট তৈরির জন্য কিনে থাকে। আবার অনেকেই আছে যারা ইকো-ফ্রেন্ডলি ও সংস্কৃতিমনা তাদের কাছে এইসব লোকজ সংস্কৃতির গুরুত্ব আলাদাভাবে বহন করে।
অনেক তরুণ শুধুই গ্ৰামীণ খাবারের জন্য মেলায় আসে,বিশেষ করে শহুরে তরুণদের আকর্ষণ বেশি। তবে, তরুণদের মাঝে আগ্রহ নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে, মূলত ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, ব্লগিং-এর কারণে। তাই তাদের কাছে মেলা মানেই যেনো কন্টেন্ট তৈরি করা। তারা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ‘আধুনিক কনটেন্ট’ হিসেবে দেখতে শিখছে।
বিক্রেতাদের জীবন মান উন্নয়ন করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।হস্তশিল্পীদের ঋণ, প্রশিক্ষণ ও সাপোর্ট দেওয়া। সেইসাথে ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে প্রবেশাধিকার এবং তাদের পণ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরার উদ্যোগ।মেলায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা,যেমন: নিরাপত্তা, পর্যাপ্ত জায়গা ও পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা। সেইসাথে তরুণদের উদ্যোক্তা সংযুক্তি করা। তরুণরা চাইলে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পণ্যের ডিজাইন, ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিংয়ে সাহায্য করতে পারে।
দর্শকদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণও থাকে কেন্দ্রবিন্দুতে। বলী খেলা দেখতে আসে হাজারো মানুষ, শুধু চট্টগ্রাম নয় বরং আশপাশের জেলা থেকেও। বহু পরিবার প্রতি বছর এই খেলাকে উপলক্ষ করে পরিবারিক ভ্রমণ হিসেবে মেলাতে অংশ নেয়। এটি এখন একটি পারিবারিক-সামাজিক মিলনমেলা হিসেবেও বিবেচিত।
আগামী ২৫ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবারের বলীখেলার ১১৬তম আসর। সময়ের সাথে যুগের তাল পরিবর্তন হওয়া যেনো সময়ের স্বাভাবিক গতি। কিন্তু সময় পরিবর্তন হলেও জব্বারের বলী খেলার জনপ্রিয়তা একটুও ফিকে হয়ে যায়নি। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে কালের বিবর্তনের সাথে এই জব্বারের বলী খেলা এবং সাংস্কৃতিক মেলা যাতে হারিয়ে না যায় সেজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের নিয়মিত পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করতে হবে।
তাছাড়াও জব্বারের বলী খেলা কেবল একটি খেলাই নয়, এটি একটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, বাংলার শিকড়, আর বাঙালির প্রাণের উৎসব। জব্বারের বলী খেলার মেলা বিক্রেতাদের জন্য আশার প্রদীপ, জীবিকার ভরসা, এবং ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ। অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ঐতিহ্যকে ঘিরে এক নতুন কৌতূহল গড়ে উঠেছে।
আর তাই চট্টগ্রামের এই সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও অহংকারে ধরে রাখতে হলে বলী খেলা নিয়ে তরুণদের মধ্যে যে আগ্রহ নতুন আঙ্গিকে গড়ে উঠেছে যেটাকে সঠিকভাবে লালন করলে এই মেলা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেতে পারে। এই বলী খেলাকে টিকিয়ে রাখতে হলে বর্তমান তরুণ প্রজন্মদের বলী খেলার ইতিহাস, ট্রেনি নিয়ে শিক্ষামূলক ক্যাম্পেইন চালাতে হবে সেইসাথে ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম রিলসের মাধ্যমে অনুষ্ঠান ও মেলা হাইলাইট করতে হবে। তরুণ বলীদের জন্য ক্যাম্প ও পুরস্কারভিত্তিক প্রতিযোগিতা চালু করতে হবে।যাতে করে তারা মিডিয়া কভারেজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভালোই পরিচিতি পেতে পারে। যা ভবিষ্যতে তাদের অবস্থান উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে।মেলার অংশে লোকগান, লোকনৃত্য ও আঞ্চলিক খাবারের স্টলকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে যদি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে প্রযুক্তি ও প্রচারের মাধ্যমে বলী খেলার ঐতিহ্য আরও সমৃদ্ধ ও সময়োপযোগী করা সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি