Wednesday 30 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মে দিবস: শ্রমিকের ঘাম শুকায়, অধিকার নয়

সুমন বৈদ্য
৩০ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৩৫ | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৪৯

গ্রীষ্মের অসহনীয় সূর্যের তেজে হাহাকার চারপাশ। এই কাঠফাঁটা তীব্র গরমেও থেমে নেই শ্রমিকদের পথচলা। তারা সকাল দেখেন ভোরের আগে। আর এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে নগন্য রোজগার দিয়েই চলে তাদের পরিবার। কাক ডাকা ভোরে যখন ঘুমের ঘোরে মগ্ন থাকে নগরবাসী, তখনই বেরিয়ে পড়ে তারা কাজের তাগিদে। যে কাজ করে যেতে হয় বিরতিহীনভাবে কখনো সন্ধ্যা অথবা কখনো রাত পর্যন্ত অথবা নির্ঘুম অবস্থায় রাত পেরিয়ে।

শহরের উঁচু বিল্ডিং, চকচকে জামা-কাপড়,সব কিছুর পেছনে থাকে তাদের না বলা গল্প। অথচ মাস শেষে তাদের ঠিকঠাক মজুরি মেলে না, অসুস্থ হলে ছুটি মেলে না,অধিকার চাইলে চাকরি থাকে না। আমাদের বিত্তবান লোকেরা তাদের ‘লেবার’ বলেই ডাকে। কিন্তু ভুলে যাই, তারাও মানুষ।

বিজ্ঞাপন

পহেলা মে; শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন, যাকে পরিচিতি পেয়েছে মহান মে দিবস হিসেবে। কিন্তু মে দিবস প্রতিষ্ঠার ১৩৯ বছর পার হয়ে গেলেও সকাল সন্ধ্যা খেটে খাওয়া এই শ্রমিকেরা এখনো ‍মে দিবসের মাহাত্ম্য সম্পর্কে জ্ঞানশূন্য। জানবেই বা কি করে, মে দিবস প্রতিষ্ঠার শত বছর পার হয়ে গেলেও তাদের ন্যায্য মজুরি এখনো তলানিতে। তাদের বিরাট অংশ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।

সারা বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পালন করা হয় এ মে দিবস। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকেরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ ঝরে অনেক শ্রমিকের। এরপর থেকে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

কিন্তু যে অধিকার আদায়ের জন্য প্রাণ উৎসর্গ এতো শ্রমিকের, সেই অধিকার কি আদৌ প্রতিষ্ঠা হয়েছে কি? প্রত্যেক বছরেই ‘মে দিবস’ আসলে সরকারী ছুটি পেয়ে থাকেন সমাজের উচ্চ স্তরের মানুষ।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু যাদের জন্য আজ এই মহান ‘মে দিবস’, তাদের দেখা যায় তপ্ত রোদ উপেক্ষা করে পেশীর দাপটে রক্ত পানি করে কাজের মধ্যেই ডুবে থাকতে। যাদের শ্রমের কারণে গড়ে উঠে আমাদের বেঁচে থাকার আশ্রয় স্থল, দিনশেষে তারাই হতে থাকে অবহেলিত উপেক্ষিত। এই যেনো এই সমাজের নিয়মিতভাবে মানতে থাকা একটি নিয়ম।

মে দিবস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১৩৮ বছরে এসেও এখনো তাদের মজুরির বেলায় লিঙ্গভেদ আর বৈষম্য বিদ্যমান। তাদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন করে যেতে হয়। বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে তাদের অবস্থান থাকে অনুন্নত‌। তাই বছর পেরোতে থাকে, প্রতিবছরের ন্যায় মে দিবসও পালিত হতে থাকে শ্রমিকদের ঘামও শুকাতে থাকে কিন্তু অধিকার কোনোকালেই আদায় হয়না।

মে দিবস উপলক্ষ্যে প্রতিবছর বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে। কিন্তু এই অনুষ্ঠান নামকাওয়াস্তে থেকে যায়। তার কারণ নেতৃত্বের দুর্বলতা ও স্বার্থান্বেষণ। অনেক সংগঠনের নেতৃত্ব ব্যক্তিগত স্বার্থে পরিচালিত হয়। যদিও বাংলাদেশের শ্রম আইন আছে (যেমন: বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬), কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল। অনেক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের ছুটি, নিরাপত্তা, ন্যূনতম মজুরি ইত্যাদি আইন মানে না।

শ্রমিকদের প্রকৃত সমস্যা বা দাবির চেয়ে নেতৃত্বের নিজস্ব এজেন্ডা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত প্রভাব ও সম্পদের অভাব। সংগঠনগুলোর হাতে পর্যাপ্ত অর্থ, জনশক্তি বা আইনি সহায়তা থাকে না। ফলে তারা বড় অনৈতিক শিল্পপতি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না।সেইসাথে রয়েছে বিচ্ছিন্নতা ও ঐক্যের অভাব শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিভাজন বা দলাদলি দেখা যায়। সবাই একসাথে না থাকলে আন্দোলন দুর্বল হয়।

সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাধা

অনেক সময় শ্রমিকরাই নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয় বা ভয় পায় নিজেদের দাবি নিয়ে কথা বলতে। এতে সংগঠনগুলোর কাজও সীমিত থেকে যায়।

এক কথায়, সংগঠন গড়ার মানে শুধু নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য ধারাবাহিক, সুসংগঠিত, স্বচ্ছ ও নেতৃত্বের দিক থেকে আপোষহীন সংগ্রাম দরকার।

শ্রমিকের এমন শোষণের পিছনে বেশকিছু যুক্তি উপস্থাপন করা যায়। তা হলো বেশিরভাগ শ্রমিক কম মজুরির অধীনে ন্যস্ত। বেশিরভাগ শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পান না। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হলেও তা বাস্তবে জীবনযাত্রার খরচের সাথে মেলে না। বিশেষ করে গার্মেন্টস ও নির্মাণ খাতে এটা বেশি চোখে পড়ে।শ্রম অধিকার লঙ্ঘন শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠন, ধর্মঘট বা নিজেদের অধিকার আদায়ের সুযোগ অনেক ক্ষেত্রেই বাধাগ্রস্ত হয়।

তাছাড়া অনেক শ্রমিক কারখানাতে নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা নেই। সেইসাথে অনেক শ্রমিকই কোনো স্থায়ী নিয়োগপত্র ছাড়া কাজ করেন। ফলে চাকরির নিশ্চয়তা থাকে না, আর বীমা বা ছুটি পাওয়ার সুযোগও মেলে না। শ্রম অধিকার নিশ্চয়তা না হওয়ায় পিছনে আরো একটি যৌক্তিক কারণ হলো আইন বাস্তবায়নের দুর্বলতা। শ্রম আইন থাকলেও তা যথাযথভাবে প্রয়োগ হয় না। তদারকি দুর্বল এবং অনেক সময়েই শ্রমিকদের ন্যায্য অভিযোগ গুরুত্ব পায় না।

অনেক শ্রমিকেরই মৌলিক শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতার অভাব আছে, যার ফলে তারা সহজেই বিকল্প চাকরি বা উন্নত সুযোগের জন্য প্রতিযোগিতা করতে পারেন না।

অর্থনৈতিকভাবেও বাংলাদেশের শ্রমিকরা অনেকাংশে পিছিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রমনির্ভর হলেও শ্রমিকদের প্রকৃত অবদান যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয় না। অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান (বিশেষ করে গার্মেন্টস, কৃষি, নির্মাণ) কম মজুরির উপর নির্ভরশীল। ফলে শ্রমিকরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করেও ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না। এতে একদিকে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণি বঞ্চিতই থাকছে।

গার্মেন্টস, নির্মাণ ও পরিবহন খাতে শ্রমিকদেরকে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়, অনেক সময় স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তার বিষয় উপেক্ষা করেই। ফলে দুর্ঘটনা, পঙ্গুত্ব বা মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে, অথচ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ বা চিকিৎসাসুবিধা দেওয়া হয় না।

গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন ও চাহিদার চাপ

বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা এবং ক্রেতাদের কম দামে পণ্য চাওয়ার কারণে মালিকরা উৎপাদন খরচ কমাতে চায়। ফলে শ্রমিকদের মজুরি কম রাখা হয় এবং কর্মপরিবেশ উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হয় না।

শ্রমিকদের বৈষম্য নিয়ে কথা হচ্ছে যখন নতুন করে আরো একটি শ্রমিকদলের কথা বলা যাক তা হলো শিশুশ্রমিকদের কথা। যে বয়সে হাতে কলম বই থাকার কথা সে বয়সে তাদের উঠাতে হচ্ছে ইট ভাঙ্গার হাতুড়ি কিংবা ইট, বালির বস্তা। শিশুদের শিক্ষা, খেলা, ও স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার অধিকার আছে।আর শিশুশ্রম তাদের এই মৌলিক অধিকার হরণ করে।আর এতেই অল্প বয়সেই বিভিন্ন ধরণের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শেখা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানুষের অপমানের গ্লানিও মেখে নিতে হয় তাদের। যার ফলে তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে কলুষিত করছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৪.৮ মিলিয়ন শিশু কোনো না কোনো শ্রমের সঙ্গে যুক্ত, যার মধ্যে ১.২ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। তারা ইটভাটা, গার্মেন্টস, ওয়ার্কশপ, বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকা, চা দোকানে কর্মচারী কিংবা কৃষি খাতে কায়িক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। এক গবেষণা বলছে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ৩.৫৪ মিলিয়ন শিশু শ্রমে নিয়োজিত, যা মোট শিশু জনসংখ্যার ৮.৯%।

শিশুশ্রমের উত্থানের প্রধান কারণ হলো দারিদ্র্য। যাদের কাছে একবেলা খাবার যোগাড় করতেই নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তাদের কাছে পড়াশোনা করে শিক্ষিত হওয়াটা যেনো ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে নতুন কাঁথার স্বপ্ন দেখার মতো। পরিবারগুলো যখন দেখছে, বাবা-মায়ের আয় সংসার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়, তখনই সন্তানদের হাতে অকালেই তুলে দেয় সংসারের বোঝা। আর এতেই বলি হয়ে যায় শিশুদের আগামীদিনের সুন্দর ভবিষ্যৎ। যদিও বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে, আশ্চর্যজনকভাবে এখনও ৪৭% শ্রমজীবী শিশু স্কুলে যায় না।

শিশুশ্রমের ফলে শিশুরা যেমন শিক্ষার সুযোগ থেকে যেমন বঞ্চিত হয় ঠিক তেমনি ভবিষ্যতে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হওয়ার সুযোগ পায় না। এতে তারা নিম্নআয়ের মধ্যে আটকে থাকে এবং দারিদ্র্য চক্রও চালু থাকে। একটি জাতির উন্নতির জন্য সুদক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী অপরিহার্য। শিশুশ্রম সেই উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দেয়।

এইবার আসা যাক নারী শ্রমিকদের দুর্দশা। বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি, কিন্তু তারা অধিক বৈষম্যের শিকার। অনেক ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, মাতৃত্বকালীন সুবিধার অভাব, এবং নিরাপত্তার অভাব চোখে পড়ে।

কর্মপরিবেশ আইনে নির্ধারিত থাকলেও বাস্তবে তা অনেকখানিই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। নিয়োগদাতারা অনেক সময় নারী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে গড়িমসি করেন অথবা অবৈধভাবে তাদের চাকরি থেকে বাদ দেন। অনেক সময় যোগ্যতার পরও শুধুমাত্র লিঙ্গের কারণে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইনের কার্যকর প্রয়োগের অভাব কর্মক্ষেত্রকে নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে।

বাংলাদেশের সমাজ এখনো অনেকাংশে পুরুষতান্ত্রিক।নারীদের কাজকে এখনো কম মূল্যায়ন করা হয়। বিশেষ করে শ্রমজীবী নারীদের পেশাগত কাজকে ‘কম মর্যাদার’ কাজ মনে করা হয়। যার ফলে নারীদের অবদানকে সম্মান দেওয়া হয় না।তাদের দাবি ও অধিকার সহজেই উপেক্ষিত হয়। শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নগুলোও পুরুষপ্রধান। ফলে নারীদের সমস্যা বা দাবিদাওয়া অনেক সময় গুরুত্ব পায় না।

এছাড়াও বেশিরভাগ নারী শ্রমিকদের রয়েছে শিক্ষা ও সচেতনতার ঘাটতি।ফলে অনেক নারী শ্রমিকই তাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে অবগত নন। কোথায় কোন সুযোগ-সুবিধা তারা পাওয়ার কথা, কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে এসব না জানার কারণে তারা সহজেই ঠকেন।

পাশাপাশি নারী শ্রমিকরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ায় বা পরিবারের আর্থিক চাপে চাকরি ধরে রাখার জন্য প্রায়শই অপমান, বৈষম্য বা হয়রানিও সহ্য করতে বাধ্য হন।

এছাড়াও একই ধরণের কাজ করলেও নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরি পান। অনেকক্ষেত্রে কোনো বেতন কাঠামো স্পষ্ট থাকে না। গার্মেন্টস, কৃষি, সেবা খাতে নারীরা দীর্ঘ সময় (১২–১৪ ঘন্টা) কাজ করেন। তবুও ওভারটাইম ভাতা বা সঠিক বিশ্রাম সুবিধা পান না।

পরিসংখ্যানের দিকে একবার নজর বুলালে নারীদের প্রতি বৈষম্যের ভয়াবহ চিত্রটা আরো স্পষ্ট হবে। ৩০ বছর হওয়ার আগেই ৬০ শতাংশের বেশি নারী তাঁর কর্মক্ষেত্র ছাড়তে বাধ্য হন; যারা নির্যাতন এবং মজুরি বৈষম্যের কারণে কর্মক্ষেত্রে টিকতে পারেন না। আরও একটি জরিপে দেখা গেছে, ৮৪.৭ শতাংশ নারী শ্রমিক পোশাক কারখানায় মৌখিক নির্যাতন বা গালাগালের শিকার হন। ৭১.৩ শতাংশ নারী মানসিক নির্যাতন, ২০ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন এবং ১২.৭ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হন। সেই সঙ্গে মজুরি বৈষম্য তো আছেই। নারী শ্রমিকরাও মেনে নিয়েছেন এই মজুরি বৈষম্য।

বাংলাদেশের শ্রমআইন অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করবে। নারী শ্রমিকদের রাত ১০ থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই কাজ করাতে হলে নারী শ্রমিকের লিখিত অনুমতি নিতে হবে। ধারা ৬৩ অনুসারে প্রাপ্তবয়স্ক নারী শ্রমিক ৩০ কিলোগ্রামের বেশি ওজনের কোনো দ্রব্য কারও সাহায্য ছাড়া হাতে বা মাথায় উত্তোলন, বহন, অপসারণ করার উদ্দেশ্যে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে নারী-পুরুষ শ্রমিকের বৈষম্য, নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা তুলে ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা নিয়ে যতো আলোচনা হয়, তা সমাধানের জন্য কারো ছিটেফোঁটা কাজ পরিলক্ষিত করা যায় না।

বর্তমান যুগ যেমন প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে ঠিক তেমনি মানুষও তার সর্বোচ্চ শ্রম উজাড় করে দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে মানুষ ছাঁটাই করাটা যে বড্ড বেমানান তা হয়তো ভুলেই যায় এই দেশের শ্রমিকদের স্বার্থান্বেষী মালিকমহলরা। প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে এই উপখাতে ২০১৪ সালে নারী শমিকের অংশগ্রহণ ছিল ৬৩.১৩ শতাংশ; ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯.২২ শতাংশ।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা মতে, কৃষিতে নারীর অবদান গড়ে ৬০–৬৫ শতাংশ; তারপরও জিডিপিতে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি।

অথচ নারী শ্রমিকরাও যে উন্নয়নের সমান অংশীদার তা হয়তো ভুলেই যায় বাংলাদেশের শ্রমিক মালিকগণ। তথ্য অনুসারে প্রায় ৫ কোটি কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি নারী। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক গবেষণা মতে, ১৯৯৫–৯৬, ২০০২–০৩, ২০০৫–০৬ এবং ২০১১–১২ সালে মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল যথাক্রমে ১৫.৮ শতাংশ, ২৬.১ শতাংশ, ২৯.২ শতাংশ এবং ৩৯.১ শতাংশ।

২০১৩ সালে শ্রমশক্তির বাইরে ছিল ৩ কোটি ৬১ লাখ নারী। পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২–এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৪২ দশমিক ৬৮, যা ২০১৬ সালের ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। যদিও এই তথ্যমতে, কর্মক্ষম নারীদের ৫০ শতাংশেরও বেশি। যা ২০১৭ সালে কমে ৩ কোটি ৪৫ লাখে দাঁড়িয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারীর সংখ্যা বেশি। নারীরা পূর্ণকালীন কাজ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।

কিন্তু উন্নয়নের এতো সমাহার থাকা সত্ত্বেও নারীশ্রমিকরা আজও অবহেলার পাত্র হিসেবে পরিচিত পেয়ে আসছে এই দেশে।

বাংলাদেশের পুরুষ থেকে শুরু করে নারী শ্রমিক এবং শিশুশ্রম দূর করতে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ের প্রশাসন ও সংগঠনকে এর যথাযথভাবে কঠোর দায়িত্ব নিতে হবে।

ধাপে ধাপে বিশ্লেষিত করলে দেখা যায় প্রথমেই মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।সব শ্রমিকের জন্য অন্তত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। যেমন: আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ (যেমন: অটোমেশন, মেশিন অপারেশন) দেওয়া। কারখানা, কৃষি, নির্মাণ খাতের জন্য বিশেষ স্কিল কোর্স চালু করা। ডিজিটাল শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা। কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহারের মৌলিক জ্ঞান বাধ্যতামূলক করতে হবে।

সেইসাথে শ্রমিকের অধিকার রক্ষার জন্য বর্তমান শ্রম আইন আধুনিকায়ন করতে হবে ন্যূনতম মজুরি, ওভারটাইম ভাতা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, নিরাপদ কর্মপরিবে বাস্তবায়ন সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। শ্রম আদালতগুলো আরও শ্রমিক-বান্ধব করতে হবে।

ট্রেড ইউনিয়ন ও সংগঠনের আধুনিকীকরণ করতে হবে। ট্রেড ইউনিয়নকে ব্যক্তিস্বার্থের প্রভাবমুক্ত করে সত্যিকারের শ্রমিকস্বার্থে কাজ করতে হবে। শ্রমিক সংগঠনে নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নারীদের সংগঠনে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তামূলক সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা। স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা (মেডিকেল চেকআপ, স্বাস্থ্যবিমা) চালু করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সাপোর্টের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

বাংলাদেশের শ্রমিকদের কাজের মান ও পরিবেশ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী গড়ে তুলতে হবে। (ISO, Fairtrade, SA8000) ইত্যাদি সার্টিফিকেশনে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।

শ্রমিকদের নিজ নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। শ্রমিকদের মধ্যে লিগ্যাল এইড প্রোগ্রামবিস্তৃত করতে হবে। গণমাধ্যমে (টিভি, রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া) শ্রমিক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালাতে হবে।

শ্রমিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা বাধ্যতামূলক করতে হবে। ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায় (বিকাশ, নগদ ইত্যাদি) শ্রমিকদের অভ্যস্ত করতে হবে। সঞ্চয় ও ক্ষুদ্র ঋণ সুবিধা বাড়াতে হবে যাতে তারা অর্থনৈতিকভাবে আরও স্বাধীন হয়।

এখন আসা যাক নারীশ্রমিক সুরক্ষার দিকে। নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শ্রম আইন (যেমন, নারী ও শিশু শ্রম আইনের ধারা) কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে স্পষ্ট নীতিমালা বাস্তবায়ন ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

একই ধরনের কাজের জন্য নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের সমান বেতন নিশ্চিত করতে হবে।বেতন কাঠামো স্বচ্ছ করতে হবে যাতে বৈষম্যের সম্মুখীন না হয়। কর্মস্থলে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, বিশ্রামাগার ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিশ্চিত করা।কর্মক্ষেত্রে শিশু দিবাযত্ন (daycare center) চালু করা।

নারী শ্রমিকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া। প্রযুক্তি ও আধুনিক কাজের প্রশিক্ষণে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা। শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়নে নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

কর্মস্থলে নিরাপত্তা এবং অধিকার আদায়ে নারীদের সোচ্চার হতে হবে। যেসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে, শ্রম আইন, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, বৈষম্য বিরোধী নীতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা। কর্মক্ষেত্রের নীতিমালা ও অভিযোগ করার প্রক্রিয়া জানা জরুরি।

নারী শ্রমিকদের নিজস্ব সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি করা, দলগতভাবে তাদের দাবী উপস্থাপন করা। সহকর্মীদের সাথে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করা যাতে যৌথভাবে চাপ প্রয়োগ করা যায়।

বৈষম্য, হয়রানি বা অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে ভয় না পেয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করা। অভিযোগের প্রমাণ (লিখিত নথি, ছবি, অডিও ইত্যাদি) সংগ্রহ করা গুরুত্বপূর্ণ।

শ্রমিক অধিকারের জন্য কাজ করা এনজিও, মানবাধিকার সংস্থা, এবং মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ করে অধিকারের জন্য আন্দোলন করা। আইনগত সহায়তার জন্য লিগ্যাল এইড সংস্থার সাহায্য নেওয়া।

কর্মস্থলের বাইরেও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আলোচনা সভা, র‌্যালি, ক্যাম্পেইন ইত্যাদি আয়োজন করা‌ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেইসবুক, ইউটিউব) নারী শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা।

অন্যদিকে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। বিদ্যমান শিশুশ্রম নিষিদ্ধকারী আইন (যেমন, বাংলাদেশে ১৪ বছরের কম বয়সীদের জন্য শ্রম নিষিদ্ধ) কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। নিয়মিত শ্রম পরিদর্শন ও অভিযান পরিচালনা করে আইন ভাঙার বিরুদ্ধে জরিমানা ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

শিশুশ্রম মূলত দারিদ্র্যের ফল। তাই পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি (ভাতা, খাদ্য সহায়তা) বাড়াতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনামূল্যে এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা চালু ও বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষায় প্রণোদনা (উদাহরণ: মিড-ডে মিল, স্কুল ড্রেস, শিক্ষা উপকরণ) চালু করা যেতে পারে যাতে শিশু ও অভিভাবকরা উৎসাহিত হয়।

প্রত্যেক শিশুকে স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষা বিভাগের যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। ঝরে পড়া (dropout) রোধে স্কুলের পরিবেশকে শিশু বান্ধব করতে হবে। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য উপবৃত্তি, বই কেনার জন্য অর্থ সহায়তা, ইউনিফর্ম সরবরাহ ইত্যাদি নিশ্চিত করা।

যারা একেবারে পড়াশোনা থেকে দূরে ছিল, তাদের জন্য জীবনমুখী কারিগরি শিক্ষা বা বিকল্প শিক্ষাপদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। শিশুরা যেন স্কুলে এসে আনন্দ পায়, ভয় না পায়, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে।

শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে এবং মে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরতে বর্তমান তরুণ প্রজন্মদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। তরুণ প্রজন্মরা মে দিবসকে আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে না দেখে এই দিবসকে বাস্তবতায় রুপ দিতে হবে। শুধু ছুটি উদযাপন নয়, তরুণরা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে জনমত গড়ে তুলতে পারে। লেখালেখি, ব্লগ, ভিডিও বানিয়ে শ্রমিকদের জীবনসংগ্রাম তুলে ধরতে পারে। ‘ভয়েস ফর দ্য ভয়সলেস’- এই নীতিতে শ্রমিকদের দুর্দশা ও দাবির কথা সোচ্চারভাবে প্রচার করতে পারে।

আইন ও নীতিমালায় চাপ সৃষ্টি করা। শ্রমিকবান্ধব নীতির দাবিতে তরুণরা গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, ক্যাম্পেইন, মানববন্ধন আয়োজন করতে পারে। সংসদ সদস্য, নীতিনির্ধারকদের কাছে স্মারকলিপি পেশ করতে পারে। শ্রমিকদের নিয়ে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ওপেন মাইক ইভেন্ট আয়োজন করে শ্রমিক–তরুণ মেলবন্ধন ঘটানো এবং সরাসরি শ্রমিকদের সাথে বসে তাদের সমস্যা শোনা এবং সমাধানের উন্মুক্তভাবে খোলাখুলিভাবে কথা বলা।

তরুণরা শ্রমিকদের মৌলিক শিক্ষা ও আইনি সচেতনতা প্রশিক্ষণ দিতে পারে। স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ করে কারখানা–শ্রমিক এলাকায় শিক্ষা সহায়তা করতে পারে। তাছাড়া স্টার্টআপ বা সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ গড়ে শ্রমিকদের জন্য নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারে। উদ্যোক্তা হয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও ভালো পরিবেশে চাকরি দিতে পারে।

সাংবাদিকতা হলো শ্রমিকদের বৈষম্য বিরোধী লড়াইয়ের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। তাই বৈষম্য দূর করতে সাংবাদিকদের ভূমিকা আগামী দিনের উন্নয়নের অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

শ্রমিকদের সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় বা বৈষম্যের ঘটনা অনুসন্ধান করে তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। এতে সামাজিক সচেতনতা বাড়ে এবং কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করা সম্ভব।

শ্রমিকরা নিজেরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন, তা সরাসরি তাদের ভাষায় তুলে ধরার সুযোগ করে দিতে পারে মিডিয়া — যাতে তাদের কথা কেউ ‘ফিল্টার’ না করে। পাশাপাশি যেখানে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বা আইনি পথে ন্যায্য অধিকার আদায় করেছেন, এমন উদাহরণ বেশি বেশি প্রচার করলে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হবে।

বাংলাদেশের শ্রম আইন, আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার, ন্যূনতম মজুরি নীতি ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত সচেতনতামূলক প্রতিবেদন ও ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে। স্বার্থান্বেষী মালিকপক্ষের দায়িত্বহীনতার খবর অনুসন্ধানী রিপোর্টের মাধ্যমে প্রকাশ করে গণচাপ সৃষ্টি করা যায়, যা নীতিগত পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

অন্যদিকে গোপন শিশুশ্রমের তথ্য উন্মোচন। অনেক সময় শিশুরা কারখানা, কৃষি, দোকানপাট বা বাসাবাড়িতে গোপনে শ্রমে নিযুক্ত থাকে। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে এই গোপন বাস্তবতা সামনে আনা যায়।

সংবাদ ও ডকুমেন্টারি তৈরি করে শিশু শ্রমিকের কষ্টের চিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরলে জনগণের মধ্যে প্রতিবাদ ও সহমর্মিতা তৈরি হয়। এতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার ওপর চাপ পড়ে।

আইনের দুর্বল প্রয়োগ চিহ্নিত করা। বাংলাদেশের ‘শ্রম আইন’ অনুযায়ী শিশুশ্রম নিষিদ্ধ, কিন্তু বাস্তবে তা মানা হয় না। সাংবাদিকরা এ নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন করলে আইন প্রয়োগকারীরা আরও সক্রিয় হতে বাধ্য হয়।

পরিবার, সমাজ এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে প্রচার চালাতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং কমিউনিটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। সেইসাথে শিশু শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া। শিক্ষার গুরুত্ব ও সুবিধাগুলো প্রচার করে শিশু ও অভিভাবকদের সচেতন করা যায় যে, শিক্ষা শিশুর অধিকার, শ্রম নয়। পাশাপাশি পিতামাতার জন্য বিকল্প এবং উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে যাতে তারা সন্তানদের কাজে পাঠাতে বাধ্য না হয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা শিক্ষা, আইনি সুরক্ষা, সামাজিক সম্মান এবং অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য — এই চারটি বড় স্তম্ভে দুর্বল অবস্থায় আছেন। এই দুর্বলতা দূর না হলে নারী শ্রমিকদের প্রকৃত ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। আর তাই নারী শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মপরিবেশ আছে কিনা -তা খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন প্রকাশ করা।

বেতন বৈষম্য তুলে ধরা। পুরুষ ও নারী শ্রমিকের মধ্যে সমান কাজের জন্য অসম বেতনের ইস্যু মিডিয়ায় এনে আলোচনায় আনা। হয়রানি ও সহিংসতার ঘটনা প্রকাশ। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত করে সাহসিকতার সাথে প্রকাশ করা, যাতে অপরাধীরা দায়ী হয়।

নারী শ্রমিকের সাফল্যের গল্প প্রচার করা। যারা প্রতিকূলতা জয় করে সফল হয়েছেন, তাদের গল্প তুলে ধরলে সমাজে নারীর শ্রমের মর্যাদা বাড়ে। মিডিয়ার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব নীতিমালা (যেমন মাতৃত্বকালীন ছুটি, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ) নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও সংস্কারের দাবি জোরালো করা যায়।

এই ধরণের অগ্রগামী পদক্ষেপ যত দ্রুত সম্ভব কার্যকরীভাবে এখনই গড়ে তোলা দরকার। আর না হলে বরাবরই শ্রমিকরা অবহেলিত হয়েই আসছে, তা হতেই থাকবে। প্রত্যেক বছরের মতো মে দিবস আসবে যাবে, তাদের কষ্টের ঘামও ঝরবে কিন্তু তাদের অধিকার আদায় করাটা যেনো বঞ্চনার শিকার হয়ে তলানিতে গিয়ে ঠেকেই থাকবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি

সারাবাংলা/এএসজি

মুক্তমত মে দিবস সুমন বৈদ্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর