‘করিডর’ বিষয়ে জনতার সম্মতি আছে কি?
৩০ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৪৭
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের জাতীয় গৌরব। তার সম্মান ক্ষুণ্ণ করা মানে দেশের সম্মান ক্ষুণ্ণ করা। তার সম্মান রক্ষার দায়িত্ব সবার। মনে রাখতে হবে, তার সফলতা মানে আমাদের দেশ-জাতির সফলতা, সম্মান ও গৌরব। গত ২০ এপ্রিল ২০২৫, এই কথাগুলো ‘ড. ইউনূসের সম্মান ক্ষুণ্ণ করবেন না’ প্রবন্ধের শেষের দিকে লিখেছি- যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে সময়ের বাস্তবতায় আজ আবার নতুন করে বলতে চাই, একজন মানুষের সম্মান ততক্ষণ থাকে, যতক্ষণ তিনি অসম্মানের কাজ না করেন। তবুও আশা করি তিনি তার সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখবেন।
২৮ এপ্রিল ২০২৫, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে একটি মানবিক করিডর স্থাপনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কারণ, এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সে ব্যাপারে বিস্তারিত আপাতত বলছি না। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ করিডর বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ হবে কিনা এ প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা মালপত্র যাওয়ার ব্যবস্থা; অস্ত্র তো আর নেওয়া হচ্ছে না।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সহায়তা পাঠাতে ‘মানবিক করিডোর’ খোলার নীতিগত সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সীমান্তে আরাকান আর্মির সক্রিয়তা ও জটিল পরিস্থিতির মধ্যে এমন সিদ্ধান্তে সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়তে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এত স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন- যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা অ্যাক্ট’ বাস্তবায়নের কোনো গোপন এজেন্ডার অংশ কি এই সিদ্ধান্ত? পাশাপাশি, প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানকে হঠাৎ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের পেছনেও করিডর ইস্যুর সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা নিয়েও আলোচনা চলছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। তিনি অভিযোগ করেন, সরকার এককভাবে এমন স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া উচিত ছিল। মানবিক সহায়তায় আপত্তি নেই, তবে এ সিদ্ধান্তে জাতীয় ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন। তিনি সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশ যেন ‘আরেকটা গাজা’তে পরিণত না হয় এবং আরেকটি সংকটে না জড়ায়। পাশাপাশি দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিও জানান।
নোবেলজয়ী এবং গণতন্ত্রের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ এই ব্যক্তি কীভাবে জনগণের মতামত বা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করেই এমন সিদ্ধান্ত সমর্থন করলেন- এ প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কাকে প্রতিনিধিত্ব করছেন? মনে রাখতে হবে, মানবিকতা বা কূটনীতির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশের সার্বিক স্বার্থ ও জাতীয় সম্মান।
জনগণের সম্মতি ছাড়াই সরকার করিডর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত দিয়েছে, যা সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি অনাস্থার ইঙ্গিত দিতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার- যা জনগণের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিত্ব করে না- ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি সাময়িক বৈধতা পেলেও, তার উচিত ছিল জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া। আন্তর্জাতিক করিডর প্রকল্পে যুক্ত শর্ত ও সম্ভাব্য প্রভাব দেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। তাই জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ছাড়া এই সিদ্ধান্ত শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং তা সংবিধান লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থি।
মানবিক করিডর কি?
বিশ্ব রাজনীতিতে ‘মানবিক করিডর’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু বিতর্কিত ধারণা। এটি মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে নিরীহ জনগণের জন্য খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয় নিশ্চিত করার বা নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার একটি নিরপেক্ষ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জাতিসংঘ, জেনেভা কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের আওতায় এই করিডর বাস্তবায়িত হয় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র ও পক্ষগুলোর সম্মতিতে।
তবে এর সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমনি সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক বিতর্কও কম নয়। বিশেষ করে মিয়ানমারের মতো একনায়কশাসিত ও আন্তর্জাতিকভাবে অবিশ্বস্ত রাষ্ট্রের সঙ্গে এমন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ শুধু মানবিকতার বিষয় নয়- এটি গভীর কূটনৈতিক সতর্কতা দাবি করে।
বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই ১২-১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় প্রদান করার কারণে সীমান্তে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং নিরাপত্তা হুমকি একটি জটিল বাস্তবতা পার করেছে। এমন পরিস্থিতিতে করিডর খুললে তা মিয়ানমারের সঙ্গে ‘ওপেন এক্সেস’ তৈরি করতে পারে, যা নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করিডরের ইতিহাস
বসনিয়া যুদ্ধ (১৯৯২-৯৫): সারায়েভো অবরোধ চলাকালে জাতিসংঘের নেতৃত্বে খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহের জন্য করিডর খোলা হয়। UNPROFOR (United Nations Protection Force) এর অধীনে সীমিত সাফল্য আসে। তবে চরমপন্থিরা এই করিডর আক্রমণ করায় অনেক সময় মানুষ নিরাপদে বের হতে পারেনি।
রুয়ান্ডা গণহত্যা (১৯৯৪): জাতিসংঘ এবং ফ্রান্সের (Operation Turquoise) এর অধীনে করিডর তৈরি করা হয়। তৎকালীন হুতু সরকার এই করিডর ব্যবহার করে পালিয়ে যায়, ফলে এটি পরবর্তীতে বিতর্কিত হয়ে পড়ে।
দক্ষিণ সুদান (২০০৫): জাতিসংঘের মানবিক করিডোর ব্যবহার করে লাখ লাখ মানুষকে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে বারবার সংঘর্ষের কারণে করিডোর বন্ধ হয়ে যায়।
সিরিয়া (২০১১): আলেপ্পো ও গৌতা শহরে জাতিসংঘ এবং রাশিয়ার সহায়তায় মানবিক করিডর খোলা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসাদ বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় এই করিডর ব্যর্থ হয়।
ইউক্রেন যুদ্ধ (২০২২): জাতিসংঘ ও রেডক্রস ইউক্রেনের মারিউপোল শহরে করিডর খোলে। যদিও কয়েকটি পরিবার নিরাপদে সরানো সম্ভব হয়, বেশিরভাগ সময় সংঘর্ষে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
মানবতা না কূটনৈতিক চাপ?
বাংলাদেশ রাখাইনে জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন করায় আন্তর্জাতিক মনোযোগ বেড়েছে। তবে প্রশ্ন উঠছে- বাংলাদেশ কীসের বিনিময়ে এই অনুমতি দিচ্ছে এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ও রোহিঙ্গা নেতৃত্ব এতে কতটা যুক্ত? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি মানবিক সহায়তার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
মানবিক করিডরের নামে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রভাব বৃদ্ধি পেলে সীমান্তে হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হবে, যা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অনিশ্চিত করে তুলবে। ফলে বাংলাদেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি মানবিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত চাপ বাড়বে। জনগণের মতামত ও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা গণতন্ত্রকে দুর্বল করবে।
জাতিসংঘ পরিচালিত করিডর ব্যবস্থাগুলো প্রায়ই রাজনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে, যা অনেক সময় শাসকগোষ্ঠীর চোখে সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। কেউ কেউ একে ‘কৌশলগত মানবিক আগ্রাসন’ বলেও অভিহিত করেন।
যদিও মানবিক করিডর মানবাধিকারের একটি প্রয়োগ, তবে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা না থাকলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্র তৈরি করে। করিডরে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, অস্ত্রধারী গোষ্ঠীর হাতে সহায়তার অপব্যবহার, এমনকি মানবপাচার- এসব ঝুঁকি উপেক্ষা করা যায় না।
ক্যাপ্টেন রেদওয়ান সিকদার করিডরকে ‘সার্বভৌমত্বের হস্তক্ষেপ’ ও ‘সাম্রাজ্যবাদের আধুনিক রূপ’ আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘকে বিকল্প রাষ্ট্র ব্যবহারের আহ্বান জানান। তার মতে, এটি জোট নিরপেক্ষ নীতির পরিপন্থি এবং মাদক ও অস্ত্র পাচারের পথ হয়ে উঠতে পারে।
রাখাইন অঞ্চল মাদক ও অস্ত্র পাচারের জন্য পরিচিত। করিডর ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে। অনুপ্রবেশ ও সীমান্তে চাপ বাড়ার ঝুঁকি রয়েছে। যেমন, ১৬ ও ১৭ এপ্রিল ইউনিফর্ম ও অস্ত্রধারী আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সার্বভৌম সীমা লঙ্ঘন করে বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার তিন্দু ইউনিয়নের রেমাক্রি মুখ এলাকায় প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে অনুপ্রবেশ করে। সেখানে তারা স্থানীয় উপজাতিদের নিয়ে জলকেলি উৎসব আয়োজন করে। উৎসবের সচিত্র ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা হয়। আরাকান আর্মির এই কার্যক্রম বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সবার আগে দেশের স্বার্থ
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নিশ্চয়তা না দিলে এই করিডর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। মানবিকতার নামে নতুন করে আর বোঝা নেওয়া সম্ভব নয়- সবার আগে দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ শুরু থেকেই রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ ও টেকসই সমাধানে প্রত্যাবাসনকে মূল কৌশল হিসেবে নিয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি হলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। চীন, ভারত, রাশিয়া ও কিছু আঞ্চলিক দেশের মিয়ানমারপন্থী অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক শক্তির দ্বৈতনীতি সংকটকে জটিল করে তুলেছে।
মানবিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশ বহুপাক্ষিক কূটনীতি, জাতিসংঘ, ওআইসি, আঞ্চলিক নেতৃত্ব ও মানবাধিকার সংগঠনের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে অনিচ্ছুক এবং তাদের রাষ্ট্রহীন রেখে দমন-পীড়নের নীতি অনুসরণ করছে।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও মানবিক সংকট শুধু রোহিঙ্গা ইস্যুতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক ভারসাম্য এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপরও প্রভাব ফেলছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশকে মানবিকতা, কৌশলগত কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক জনমতের সমন্বয় করতে হবে।
সংকট নিরসনের জন্য একটি ফেডারেল, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মিয়ানমার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। এটি কেবল মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং বাংলাদেশের শান্তি ও উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে কোনো আপস নেই। বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে। চলমান সংকটের একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমাধান হলো- রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই প্রত্যাবাসন।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে
সারাবাংলা/জিএস/এএসজি