Wednesday 30 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শ্রমিকদের চিৎকার দুনিয়া জুড়ে: কে শুনে কার কথা

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
৩০ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:৪১

শ্রম আর পুঁজি। এ দুটি শব্দে যেন গোটা দুনিয়ায় বিভেদ তৈরি করেছে। কারণ যারা কায়িকশ্রমে নিয়োজিত থাকে তাদেরকে সাধারণ শ্রমিক বলা হয়। পুঁজি হলো সেই ব্যবস্থা যা শ্রমিকদের শ্রম ব্যবহার করে রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজ চলে। কিন্তু শ্রমিকদের রাষ্ট্র কাঠামো কত আছে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে গিয়ে দেখা যাবে শ্রমিক রাষ্ট্র কাঠামো কিঞ্চিৎ। তবে আলোচনা – পর্যালোচনা বিশেষ প্রয়োজন বাংলাদেশের কাঠামোতে শ্রমিকদের অধিকার এবং শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে। পাহাড় থেকে সমতলে নারী পুরুষ শ্রমিকদের চিৎকার গোটা দেশে বিদ্যমান রয়েছে। তবে উদ্বিগ্নতার জায়গা বেশি কারণ রাষ্ট্রীয় মালিকানার চেয়ে ব্যক্তি কেন্দ্রীক ভাবে গড়ে কলকারখানা যেখানে উৎপাদন করা হয়। আমরা প্রতিনিয়ত যা ব্যবহার করি তাকে পণ্য বলা হয়। পণ্য উৎপাদন করতে যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয় তাকে উৎপাদন যন্ত্র বলা হয়।উৎপাদন করেন দুই শ্রেণির মানুষ একজন হলো মালিক আর অন্যজন হলো শ্রমিক। তবে মালিকের মধ্যে দুই শ্রেণি লক্ষ্য করা যায়। কখনো রাষ্ট্র নিজেই হতে পারে অথবা রাষ্ট্রের কোনো এক ব্যক্তি হতে পারে। তবে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় গুটিকয়েক সমাজতান্ত্রিক দেশ ছাড়া বাকি দেশগুলো উৎপাদন যন্ত্রগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়ে থাকে। ফলে উৎপাদন যন্ত্র যখন নিজের আয়ত্তে থাকে তখন মালিক ব্যক্তিগত লাভের আশায় পণ্য তৈরি করে। আর সেই পণ্যগুলো যারা তৈরি করে তারা হলো যাদের নিজের কোনো জমি-জমা নেই, কোনো টাকা-কড়ি নেই আবার নেই কোনো উৎপাদন যন্ত্র। যা আছে তা হলো শুধু নিজের শরীর শক্তি। ফলে সেই শক্তি অথবা শ্রম দিয়ে যারা জীবন বাঁচায় তাকেই, মজুর বা শ্রমজীবী মানুষ বলে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যারা পুঁজি খাটিয়ে উৎপাদন যন্ত্র আর শ্রমিকদের মাধ্যমে পণ্য তৈরি করে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে লাভ বা মুনাফা করা।

বিজ্ঞাপন

অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত তার লাভ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত পণ্য উৎপাদন করে বাজারে বাজারে বিক্রি করবে। আবার যখনি লাভ বন্ধ হয়ে যাবে তখনি পণ্য উৎপাদন বন্ধ করে দিবে এতে সমাজের কোনো লোকের অসুবিধা হোক কিংবা না খেয়ে মারা যাক তাতে ওই মালিকের কিছু যায় আসে না। কারণ তার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে পুঁজি খাটিয়ে মুনাফা করা। এতে করে শ্রমিকরা কাঠামোগত সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। মালিক বা পুঁজিবাদীরা নিজের ইচ্ছেমতো শ্রমিকদের অধিক শ্রমে স্বল্প মজুরি দিয়ে থাকে। যার ফলাফল হিসাবে আমরা দেখতে পাই পুঁজিবাদের মাধ্যমে শুধু শ্রমিকদের আয় কমিয়ে দিয়ে তাদের গরিব করে তা নয়, অনেক সময় আয়ের পথ বন্ধ করে দিয়ে ভিক্ষুকে পরিণত করে। ১৪০ বছর পূর্বে আমেরিকার শিকাগো শহর তখন শিল্পায়নের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। যার ফলে মার্কিন, জার্মান এবং ইউরোপের শ্রমিকরা যন্ত্রমানবের মতো শিকাগোতে সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতেন। দিন-রাত কলুর বলদের মতো শ্রম দিয়ে হাতে পেত মাত্র দেড় ডলারের মতো। যা দিয়ে তাদের সংসার চলতো না। কিন্তু কষ্ট হলেও তারা মালিকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারতো না। কারণ শ্রমিকদের তখন একতা গড়ে উঠেনি।

বিজ্ঞাপন

এর পর ১৮৮৪ সালের অক্টোবরে আমেরিকার ‘ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস এন্ড লেবার ইউনিয়নস’ এর এক বৈঠকে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন। এর মধ্যে আবার আমেরিকার বিভিন্ন লেবার ইউনিয়নের সম্মতিক্রমে ১৮৮৬ সালের মে মাসের ১ তারিখে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। দাবি ছিল একটাই, দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ আর নয়। অপরদিকে মালিকপক্ষের চাপিয়ে দেয়া ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজের বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে শ্রমিকদের লাল-পতাকার মিছিল। ১৯৮৬ সালের মে মাসের ১-৩ তারিখ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলমান ছিল। শত নিরস্ত্র শ্রমিকদের উপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে, এতে কয়েকজন শ্রমিক নিহত হয়েছিল। এটাই পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণির রক্তাক্ষরের সংগ্রামের ইতিহাস। যা পরবর্তীতে ‘হেমার্কেট ম্যাসাকার’ নামে পরিচিত পায়। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর ওয়ার্কার্স এন্ড সোসালিস্টস ১৮৮৯ সালের মে মাসের ১ তারিখকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ বলে ঘোষণা দেয়’। কিন্তু প্রশ্ন হলো স্বাধীনতার ৫৪ বছরের বাংলাদেশের শ্রমিকরা কেমন আছেন? নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকের সম-মজুরি পায়? কলে-কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা আছে? শিশুশ্রম বন্ধ করতে রাষ্ট্র কি পেরেছেন? অনেকগুলো প্রশ্ন হয়ে গেল কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী উত্তর একটাই দিতে হচ্ছে যে শ্রমিকরা ভালো নেই। কারণ তারা দিনের পর দিন অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদিও জুলাই আগস্টে ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের সময় ছাত্ররা রাজপথে যে ভাবে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ঠিক তেমনি ভাবে ছাত্রদের সাথে রাজপথে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ এবং স্লোগানের আওয়াজ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে ৩৬ দিনের আন্দোলন সারাদেশে উত্তাল ঢেউয়ে পরিণত হয়। যার কারণে সাধারণ জনগণ এক সাথে রাজপথে নেমে। এতে করে নাম না জানা অসংখ্য শ্রমিক বন্ধুর জীবন ঝরে এবং হাসপাতালে এখনও কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করে জীবন ঝুঁকিতে নাজেহাল অবস্থায় জীবনযাপন করছে। শ্রমিক যেন যুগে যুগে কালে কালে অধিকার ছিনিয়ে নিতে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে রাজপথেই জীবন কাটে। কিন্তু বাস্তবে তাদের জীবনে ভাগ্যের পরিবর্তন কতটুকু ঘটে তার চিন্তার বিষয়!

এখনো চোখে ভেসে উঠে মৃত্যুঞ্জয়ী রানা প্লাজার ভবন ধসে যাওয়ার ঘটনা। কত আহাজারি কত! কত মায়া কান্না! হাজারো মানুষ আহত এবং নিহত হয়েছে। যেন সেই মৃত্যুঞ্জয়ী পথযাত্রীরা আজও ভবঘুরে। কারো এক পা নেই, কারো এক হাত নেই। স্মৃতিগুলো ভাসে আর চোখের জল পড়ে শ্রমিকদের । রাষ্ট্র এখনও পারলো না ওই রানা প্লাজার মালিকদের আইনের আওতায় আনতে। শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারলো না। এর চেয়ে জাতির জন্য বড় লজ্জাজনক কথা আর কী হতে পারে। হাসিনার আমলে আমরা দেখছি শ্রমিক দিবসে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শোভাযাত্রা করেন। তাদের ওই আনন্দের অন্তরালে চাপা পড়ে হাজারো শ্রমিকের কান্না। তার তো প্রমাণ হিসেবে দেখা গেছে,করোনাকালে রাষ্ট্র শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। দিনের পর দিন শ্রমিক ছাঁটাই করে বেকারত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। শ্রমিকবান্ধব রাষ্ট্র কবে যে হবে তার কোনো ধারণা নেই রাষ্ট্র কিংবা শ্রমিকনেতাদের হোক।

একটু স্মরণ করতে হয়, ১৯৮৯ সালের আগে মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল সুইজি বলেছিলেন, অধিক ভোগ ও উৎপাদন প্রবণতার কারণে গ্রীনহাউস ইফেক্ট বা কার্বন নিঃসরণ ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়ছে। পুঁজিবাদ যত বেশি বিকশিত হবে, এই ধারা তত বাড়তে থাকবে। ক্রমেই পৃথিবী ধ্বংসের দিকে যেতে থাকবে। সত্যি তো তাই জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর জন্য অশনিসংকেত। যার একমাত্র দায়ী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো। পুঁজিবাদ এক দিকে প্রকৃতি ধ্বংস করছে আর অন্য দিকে শ্রমিক শ্রেণির মানুষকে শোষণ করছে। এভাবে কী পৃথিবী চলতে পারে? পৃথিবীকে বাঁচাতে মুক্তির পথ খুঁজতেই হবে।

আমাদের দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত মিলে ৬ কোটি ৮০ লাখ শ্রমিক দিনরাত পরিশ্রম করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে না। দারিদ্র্য যেন নিত্যসঙ্গী হিসাবে লেগেই আছে। শ্রমিকদেরকে শোষণ করে পুঁজিবাদীরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। এতে করে ধনী গরিবের বৈষম্য বেড়েই চলছে। মে দিবস শিক্ষা দেয় অন্যায় আর শোষণের বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে। শ্রমিক দিবস শিক্ষা দেয় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির লাল-পতাকার ঝাণ্ডার রাজপথে উড়াতে।

মে দিবস দিচ্ছে ডাক-মজুরি দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙো। মে দিবস শিখে গেছে, লড়াই করে অধিকার আদায় করতে হয়। তাই মে দিবস থেকে শিক্ষা নেয়া আমাদের রাষ্ট্রের উচিত। পোশাক শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি আলোচনার মাধ্যমে চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিক ছাঁটাই এবং হয়রানি-নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। শ্রমজীবী কার্ড প্রবর্তন করে শ্রমিকদের আর্মি রেটে রেশন ও বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে হবে।

বাজার দর ও মাথাপিছু আয় বিবেচনা করে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি পর্যাপ্ত পরিমাণ দিতে হবে। শ্রম আইনের শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ধারাগুলো বাতিল করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নিহত শ্রমিকের আজীবন আয়ের সমান ক্ষতিপূরণের আইন প্রণয়ন করতে হবে। শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই-আগস্টে শ্রমিকদের আহত এবং নিহতদের সংখ্যা দ্রুতি প্রকাশ করে রাষ্ট্রীয় ভাবে আর্থিক সহযোগিতা করতে হবে। পাহাড় থেকে সমতল পর্যন্ত নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে ইজিবাইক অথাৎ অটো শ্রমিকদের অটোরিকশার লাইসেন্স নিতে হবে। দেশের প্রত্যক অটোস্টান্ডে অবৈধভাবে চাঁদা তুলা বন্ধ করতে হবে। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের আমলে সময় এসেছে শ্রমিকদের নিয়ে সংস্কারমূলক কাজ করার। তাই শ্রমিকবান্ধব শ্রম আইন তৈরী করে শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ দেশ গড়ার তা না হলে বিগত সরকার ব্যবস্থার মত শ্রমিকদের শোষণ চলবে আর বারবার রক্ত দিয়ে জীবন দিয়ে কার্যকর কোনো কাজ হবে না।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

মুক্তমত মে দিবস রাশেদুজ্জামান রাশেদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর