Thursday 01 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যারা ঘাম ঝরায়, তাদের চোখের জল কে মুছে?

তানজিদ শুভ্র
১ মে ২০২৫ ১৫:৩৯

আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের ১ মে, শিকাগোর হাজারো শ্রমিক রাস্তায় নেমেছিলেন একটি সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দাবি নিয়ে—‘আমরা দিনে আট ঘণ্টা কাজ করব, আট ঘণ্টা বিশ্রাম নেব, আর আট ঘণ্টা থাকবে নিজেদের জন্য’। সেই আন্দোলনে অনেক শ্রমিক রক্ত দিয়েছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সাহসিকতা বিশ্বজুড়ে শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি গড়ে দেয়। সেই থেকে প্রতি বছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

বিজ্ঞাপন

আজ আমরা বাংলাদেশেও মে দিবস উদযাপন করি। সরকারি ছুটি থাকে, মিছিল হয়, ব্যানার-ফেস্টুন টাঙানো হয়, রেডিওতে-টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—যাদের জন্য এই দিন, সেই শ্রমিকদের জীবনে কী সত্যিকার কোনো পরিবর্তন এসেছে?

বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষদের চিত্র এখনও অনেক ক্ষেত্রেই করুণ। গার্মেন্টস, নির্মাণ, কৃষি, পরিবহন, সেবা খাত- সবখানেই শ্রমিকের ঘামে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। কিন্তু এই ঘামের মূল্য তারা ঠিকঠাক পাচ্ছেন কি? ঈদের আগে মহাসড়কে দেখা যায় আন্দোলন, বেতন-বোনাস না পেয়ে রাস্তায় বসে থাকেন শ্রমিকেরা। যাত্রী ভোগান্তি বাড়ে, যানজট হয়, আবার কখনো কেউ আশ্বাস দেন ‘চেক চলে আসছে, কাল পেয়ে যাবেন’। কিন্তু এমন পরিস্থিতি কেন হবার কথা? একজন শ্রমিক সারা বছর কাজ করেও কেন সময়মতো পাওনা পাবেন না?

অন্যদিকে, আমরা আবার দেখি, কোনো মালিক তার সন্তানের বিয়েতে সব শ্রমিককে দাওয়াত দিয়ে একসাথে আনন্দ ভাগ করে নিচ্ছেন। কোনো প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের জন্য পিকনিক, ঈদ উপহার, পুরস্কার দিচ্ছে। এসব নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। এগুলো প্রমাণ করে, মালিক ও শ্রমিক একসাথে কাজ করলে সম্পর্ক মানবিক হতে পারে। কিন্তু সেই মানবিকতা যদি শুধুই উৎসবে সীমাবদ্ধ থাকে, আর অধিকার যদি থেকে যায় অনিশ্চয়তায়, তবে সে সম্পর্কের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে।

এখন কথা হচ্ছে, শ্রমিক বলতে আমরা কাদের বুঝি? বেশিরভাগ আলোচনা গার্মেন্টস, রপ্তানি খাত, কল-কারখানা ও নির্মাণ শ্রমিকদের ঘিরেই সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ সমাজে আরও অনেক শ্রমজীবী মানুষ আছেন, যাদের কথা আমরা খুব কম বলি। পরিচ্ছন্নতাকর্মী, গৃহকর্মী, রিকশাচালক, হোটেল-বাসার সহকারী, ফেরিওয়ালা, দিনমজুর, নৌ-শ্রমিক, ক্ষেতখামারের মৌসুমি শ্রমিক তারা কেউই প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত কর্মচারী না, নেই নিয়মিত বেতন কাঠামো, নেই ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা বা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

বিজ্ঞাপন

বিশেষ করে গৃহকর্মীরা বছরের পর বছর একটি পরিবারে কাজ করলেও অনেক সময় সম্মান পান না, ন্যায্য বেতন পান না, এমনকি শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকারও হন। কেউ কেউ নিরুদ্দেশ হয়ে যান, বিচার মেলে না। এইসব মানুষদের জন্য নেই কোনো সংগঠন, নেই সরকারি সহায়তা কিংবা সামাজিক সম্মান।

শ্রমিকের মানে কেবল মেশিনে কাজ করা ব্যক্তি নয়, যিনি শারীরিক বা মানসিক শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, তিনি শ্রমিক… এই চেতনা আমাদের সমাজে আরও জোরালো করতে হবে।

আজ আমরা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। নতুন সড়ক, উঁচু ভবন, প্রযুক্তি, আধুনিক শহর এসবই উন্নয়নের চিহ্ন। কিন্তু এই উন্নয়নের ভিত রচে যাঁরা, সেই শ্রমিকদের জীবন যদি অনিশ্চয়তায় থাকে, তাহলে সে উন্নয়ন কতটা টেকসই?

একজন পোশাক শ্রমিক যদি সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে না পারেন, একজন নির্মাণ শ্রমিক যদি দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে পড়েন অথচ চিকিৎসা না পান, একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী যদি দিনশেষে একটি নিরাপদ ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা না পান তাহলে আমরা কী ধরনের সমাজে বসবাস করছি?

আমরা প্রায়ই বলি, ‘শ্রমিক আমাদের দেশের চালিকাশক্তি’। কিন্তু বাস্তবে কি আমরা তাদের চালক বানাতে পারছি? নাকি তারা কেবল পেছনের সারিতে থেকে যাচ্ছে?

এখন সময় হয়েছে শুধু আইন নয়, মনোভাব পরিবর্তনের। মালিকপক্ষকে ভাবতে হবে, শ্রমিক যেন শুধু উৎপাদনের হাতিয়ার না হন, তিনি যেন হন প্রতিষ্ঠানটির অংশীদার। সরকারকে শ্রম আইন বাস্তবায়নে কঠোর হতে হবে, শ্রম আদালতকে আরও সক্রিয় করতে হবে, ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে।

একই সঙ্গে নাগরিকদেরও ভূমিকা রয়েছে। আমরা যারা বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মী রাখি, তারা কীভাবে তাদের সঙ্গে আচরণ করছি? আমরা যারা রাস্তায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী দেখি, কখনো কি ভেবেছি তাদের কাজের ঝুঁকি কতটা?

মে দিবস মানে একটি প্রতিশ্রুতি, আমরা এমন একটি সমাজ গড়ব, যেখানে সবাই কাজের ন্যায্য মজুরি পাবেন, নিরাপদে বাঁচবেন এবং সম্মান নিয়ে চলতে পারবেন।

একটি উন্নত রাষ্ট্র তখনই গড়ে ওঠে, যখন তার শ্রমিক শ্রেণি ভালো থাকে। কারণ এই ঘাম, এই পরিশ্রমই গড়ে দেয় ভবিষ্যৎ।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাধারণ সম্পাদক; বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

সারাবাংলা/এএসজি

তানজিদ শুভ্র মুক্তমত মে দিবস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর