Thursday 01 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শোনার গান দেখার টান অনুভূতি ভোঁতা

অ্যাডভোকেট গাজী তারেক আজিজ
১ মে ২০২৫ ১৬:০৭

একসময় গান ছিল কানে শোনার বিষয়। চোখ বন্ধ করে রেডিও শুনত মানুষ, মনের ভেতর ছবি আঁকত, গানের কথায় ভেসে যেত দূর অতীতে। তখন ক্যাসেট প্লেয়ার, রেডিও, ডেকসেট কিংবা কম্প্যাক্ট ডিস্কের যুগ। তারপরই এম্লিফায়ার, এমপিথ্রি প্লেয়ার, এফএম রেডিও, তারপর মেমোরি কার্ডে ডাউনলোড করে শোনা গান ছিল শব্দ, সুর আর আবেগের সহাবস্থান। কিন্তু আজকের বাস্তবতা সম্পূর্ণ আলাদা। এখন গান ‘শোনা’ নয়, ‘দেখা’ হয়। গান এখন ইউটিউব, ফেসবুক, রিলস বা টিকটকের স্ক্রিনে- চোখের আনন্দে রূপান্তরিত হয়েছে শ্রবণ অভিজ্ঞতা।

বিজ্ঞাপন

এই পরিবর্তন কেবল প্রযুক্তিগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক। গান এখন আর নিছক সুর বা কথা নয়-এটা একটি ভিজ্যুয়াল প্যাকেজ, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দৃশ্য, পোশাক, লোকেশন ও শরীরী ভাষা। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রূপান্তর আমাদের ব্যক্তিজীবন, সংস্কৃতি ও সমাজে কী প্রভাব ফেলছে? এর পর আমাদের জন্য আর কি কি অপেক্ষা করছে?

শ্রোতা থেকে দর্শক: মননের পরিবর্তন_

গান শোনার মাধ্যম বদলেছে। রেডিওর জায়গা নিয়েছে স্মার্টফোন, ক্যাসেটের জায়গায় এসেছে স্ট্রিমিং অ্যাপস। কিন্তু শুধু মাধ্যম নয়, বদলেছে গানের স্বরূপও। মানুষ এখন পুরো গান শোনে না, ৩০ সেকেন্ডের ‘ক্লিপ’ দেখে। গানের আবেদন এখন সুর-শব্দে নয়, ভিডিওর গ্ল্যামারে। যার পোশাক ঝলমলে, যার ভিডিওতে বিদেশি লোকেশন আছে, নাচ আছে, সে-ই এখন ‘ভিউস’ রাজা।

এই ভিউস নির্ভরতা শ্রোতাকে রূপান্তরিত করছে দর্শকে। শ্রবণেন্দ্রিয়ের জায়গা নিচ্ছে চোখ। আর তাতে হারিয়ে যাচ্ছে সেই মনোযোগ, যেটা গান শোনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এতে করে অবিশ্রান্ত চোখ, মস্তিষ্ক, কান সবকিছুই ব্যস্ত থাকছে।

প্লাটফর্ম বদলে গেছে। একসময় গান শোনার জন্য অপেক্ষা করতাম বিবিধ ভারতী বা বিটিভির ‘ছায়াছন্দ’ এর। আজ ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম রিলস, টিকটক- এইসব প্ল্যাটফর্মে ভিউস পাওয়ার প্রতিযোগিতা। গান এখন আর শ্রবণভিত্তিক নয়, ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট ভিত্তিক হয়ে গেছে।

গান এখন ‘হিট’ হয় যদি ভিডিওটা ভাইরাল হয়। গানের মান, কথা, সুর, শিল্পীর কণ্ঠ-এসব অনেক সময় গৌণ হয়ে পড়ে। মিউজিক ভিডিওতে নাচ, গ্ল্যামার, শরীরী উপস্থাপনা, দৃষ্টিনন্দন লোকেশন বা ক্যামেরার কারসাজি যদি ভালো হয়-তবেই গান জনপ্রিয় হয়। এই জনপ্রিয়তা অবশ্য ‘দীর্ঘস্থায়ী শ্রবণ’ নয়, ক্ষণস্থায়ী ‘দেখা’র জন্য।

বিজ্ঞাপন

প্রযুক্তির উৎকর্ষ না বাজারের অপব্যবহার?

আমরা স্বীকার করি, প্রযুক্তির উৎকর্ষ আমাদের অনেক সুবিধা এনে দিয়েছে। ইউটিউব, স্পটিফাই, অ্যামাজন মিউজিক- সবখানে গান এখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু এই সুবিধা যখন শুধুই মনোযোগ কাড়ার প্রতিযোগিতায় পড়ে যায়, তখন সেটা সংস্কৃতির ক্ষতি ডেকে আনে। সে ক্ষতি সমাজে ক্ষত সৃষ্টি করছে। এর প্রভাব বুঝতে হলে আরও কিছু সময় অপেক্ষায় থাকতে হবে।

একটা সময় গান ছিল অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা। এখন সেটা বাহ্যিক প্রদর্শন। এখন গানের চেয়ে ভিডিও বানাতে বেশি বাজেট খরচ হয়। শিল্পীর কণ্ঠের চেয়ে মডেলের শরীর গুরুত্ব পায় বেশি। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গান আগে নয়, ভিডিওর স্ক্রিপ্ট আগে লেখা হয়।

গানের প্রযোজকরা এখন গানের চেয়ে ভিডিওতে বেশি বাজেট বরাদ্দ করছেন। একটি গানের ভিডিওতে ব্যয় হচ্ছে লক্ষাধিক টাকা, অথচ গানের কথা বা সুরে মৌলিকত্ব অনুপস্থিত। অনেক সময় গান পরে তৈরি হয়, আগে ভিডিওর প্লট তৈরি হয়। শিল্পী নির্বাচনেও কণ্ঠ নয়, ভিডিওতে কে ‘দেখতে ভালো লাগবে’ সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই কারণে অনেক ভালো কণ্ঠশিল্পী গান প্রকাশ করতে পারছেন না শুধুমাত্র ভিজ্যুয়াল না থাকার কারণে।

একটা সময় ছিল, গান ছিল একান্ত অনুভূতির জগত। কেউ ভালোবাসায় আঘাত পেলে গান শুনত, কেউ আনন্দে নাচতে গিয়ে গান ধরত। এখন গান শুনে কেউ কাঁদে না, বরং ‘কোন সেলিব্রিটি কীভাবে নেচেছে’ সেটাই বেশি আলোচনায় আসে। আগে নৌকা বাইচ, মাটি কাটার লোক, নৌভ্রমণে গানই ছিল আনন্দের অনুষঙ্গ। যা এখন বিলীন হতে চলেছে।

মানুষ গান শুনে চিন্তামগ্ন হতো, এখন গান দেখে মন্তব্য করে-‘ওর জামাটা কী সুন্দর ছিল’।

সামাজিক প্রভাব: পরিবারের ভিত নড়ে_

পরিবারে একসঙ্গে বসে গান শোনার যে সংস্কৃতি ছিল, তা আজ হারিয়ে গেছে। এখন গান মানেই কানেকানে নয়, স্ক্রিনের সামনে একা। শিশুরা গান শুনে শেখে না, দেখে শেখে- আর সেখানে থাকে ফ্যাশন, গ্ল্যামার আর কখনো কখনো অশালীন অঙ্গভঙ্গির বিরূপতা। এই ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতি তাদের ভাষা, রুচি ও মননে প্রভাব ফেলছে।

মার্কিন এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত স্ক্রিন নির্ভর গান গ্রহণ করলে শিশু-কিশোরদের একাগ্রতা কমে যায় এবং তাদের ভাষার ওপর খারাপ প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশেও এর ছাপ লক্ষণীয়। আমাদের আশেপাশেই এরূপ দেখতে পাওয়া যায়। দূরে যেয়ে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন পড়ছে না। এর ভুক্তভোগী পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র।

ব্যক্তিগত পরিণতি: মস্তিষ্কের ক্লান্তি, আবেগের সঙ্কোচন_

গান শোনার অভিজ্ঞতা ছিল এক ধরণের ধ্যান। কিন্তু এখন একটার পর একটা ভিডিও, ক্লিপ, শর্টস দেখতে গিয়ে শ্রোতা হয়ে যায় শ্রান্ত দর্শক। এতে-
মনোযোগ কমে।
স্নায়বিক চাপ বাড়ে।
আবেগের গভীরতা হারায়।
শরীর ক্লান্ত না হলেও মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয় এই অবিরাম স্ক্রিন নির্ভর বিনোদনে। শিল্পীর গায়কী বা কথার গভীরতা হারিয়ে যায় ক্যামেরার কারসাজির ভেতর।

সৃজনশীলতার সংকট: গান নয়, কনটেন্ট_

যে গান একসময় শিল্প ছিল, এখন তা ‘কনটেন্ট’। এখন গান তৈরি হয় প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম মাথায় রেখে। ‘ব্রেকআপ’, ‘রোমান্স’, ‘ট্রেন্ডিং থিম’-এসব নিয়েই গানের নাম ও বিষয়বস্তু নির্ধারিত হয়। সুর বা কথা নয়, ভিডিও ভাইরাল হবে কি না-তাই মূল বিবেচনা।

ফলে সত্যিকারের শিল্পীরা হারিয়ে যাচ্ছেন। যারা ভালো গাইতে পারেন, কিন্তু ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন দিতে পারেন না-তারা কোণঠাসা। তাদের গান প্রকাশিত হলেও পৌঁছায় না শ্রোতার কাছে। অথচ এই ভিজ্যুয়াল অঙ্গনে হিরো আলমদের উত্থান!

শ্রবণচর্চার অবসান: স্মৃতিহীন প্রজন্ম?

একটা সময় ‘অন্তরে গান বাজে’-এই কথা বললে মানুষ বুঝত গান কিভাবে অন্তর্লীন হতে পারে। আজ সেটা বলা যায় না। কারণ গান এখন চটুল, ক্ষণস্থায়ী, স্মৃতির নয়- মুহূর্তের জন্য তৈরি।

এই প্রজন্ম হয়তো দশ বছর পর কোনো গান মনে করে বলবে না, ‘ওই গানটা শুনে প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম’। বরং বলবে, ‘ওই রিলটা ভাইরাল হয়েছিল’।

উদ্বেগ: শ্রোতা সংস্কৃতির বিলুপ্তি_

শ্রোতা হারিয়ে গেলে গায়কও হারিয়ে যায়। শ্রোতা তৈরি হয় পরিবারে, স্কুলে, ক্লাবে-যেখানে গান শোনার একটা সংস্কৃতি থাকে। সেটা এখন নেই। সবাই ‘দেখে’- শুনে না। একে একে হারিয়ে যাচ্ছে-
কবিতার গানের ঐতিহ্য।
লোকগানের প্রাণ।
আধ্যাত্মিক গানের গভীরতা।
এমনকি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি কিংবা আধুনিক বাংলা গান, বাউল সঙ্গীত, পালাগান, মরমী গান- সবকিছুই আজ ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতির চাপে কোণঠাসা।

পথ আছে, যদি চাওয়া থাকে_

আমরা কি পারি না আবার শ্রোতা হয়ে উঠতে? অবশ্যই পারি। তার জন্য দরকার-
অডিও সংস্কৃতি চর্চা: রেডিও শোনা, স্পিকার দিয়ে গান চালানো।
মনোযোগী শ্রবণ অভ্যাস: গান শুনে কথা বোঝা, সুর অনুধাবন।
ভালো শিল্পীদের উৎসাহ: যারা ভিডিও নয়, গানকে ভালোবাসেন।
শিশুদের শেখানো: শুধু গান নয়, গান শোনা কীভাবে হয়- তাও শেখানো।

বৈজ্ঞানিকভাবে কেন গান শোনা বেশি উপকারী?

ডোপামিন নিঃসরণ:
প্রিয় গান শোনার সময় মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোন নিঃসরণ হয়, যা আনন্দ ও তৃপ্তির অনুভূতি সৃষ্টি করে। এটা চোখ নয়, মূলত কানের মাধ্যমে সংগীতের রিদম ও সুর মস্তিষ্কে পৌঁছলে ঘটে।

স্ট্রেস হরমোন কমায়:
ধীর গতির সুরেলা গান শোনা করটিসল হরমোন (স্ট্রেস হরমোন) কমায়। তাই সংগীত থেরাপিতে শুধুই অডিও গান ব্যবহার করা হয়।

মনোযোগ বাড়ায় ও স্মৃতিশক্তি উন্নত করে:
নিয়মিত গান শোনা মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করে। আলঝেইমার বা স্মৃতিভ্রংশ রোগীদের ক্ষেত্রে সংগীত থেরাপি কার্যকর।

গান দেখা কি ক্ষতিকর?

গান দেখা একেবারে খারাপ নয়—ভালো ভিডিও হলে তা ভিজ্যুয়াল আনন্দ দেয়। তবে—
বারবার স্ক্রিন দেখায় চোখ ও মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়।
মনোযোগ ছুটে যায় সুর নয়, দৃশ্যের দিকে।
প্রশান্তি নয়, উত্তেজনা বা বিভ্রান্তি বাড়ে।
বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটা বেশি নেতিবাচক। তারা গানের কথা নয়, ভিডিওর রঙ-ঢং দেখে শেখে।

চিকিৎসাবিজ্ঞান মতে, শ্রবণ সংগীত মানে কানে শোনা গান—এটাই প্রকৃত ‘সঙ্গীতচিকিৎসা’। গান যদি হৃদয় ছোঁয়, সে তখন প্রশান্তির ওষুধ হয়ে ওঠে। স্ক্রিন-নির্ভর গান শুধু বিনোদন—প্রশান্তি নয়।

গান ফিরে পাক তার প্রাণ, প্রযুক্তি দরকার, ভিজ্যুয়াল দরকার- কিন্তু গানকে যদি শুধু চোখের আনন্দে সীমাবদ্ধ করে ফেলি, তাহলে সেটা হবে একধরনের সাংস্কৃতিক আত্মঘাত। গান যদি আর মনকে না ছোঁয়, কানে না বাজে, আবেগে না নড়ে- তাহলে সে গান নয়, কেবল আরেকটা ডিজিটাল ক্লিপ। এই রোবটিক যুগে দরকার কিছু আবেগের আশ্রয়। গান হতে পারে সেই আশ্রয়- যদি আমরা তাকে শোনার অধিকার দেই। তাই আসুন, আবার শুনি। দেখি নয়- শুনি।

লেখক: অ্যাডভোকেট, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এএসজি

অ্যাডভোকেট গাজী তারেক আজিজ মুক্তমত শোনার গান দেখার টান অনুভূতি ভোঁতা