রানা প্লাজা থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, সবাই মিলেই বাংলাদেশ
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৬:০৩
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বৃহস্পতিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে যখন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন লাগে তখন সেখানে ভর্তি হওয়া রোগী ছিল ১ হাজার ১৭৪ জন। এর মধ্যে শিশু ৭২ জন, নারী ৫৭৬ জন আর পুরুষ রোগীর সংখ্যা ছিল ৫২৬ জন। এত মানুষ কী করে বের হবে এই হাসপাতাল থেকে? রোগীরা কোথায় যাবে, আহারে-কত মানুষ না জানি মারা যায়!!!! এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল সবার মনে।
কিন্তু সুখের খবর হচ্ছে আগুনের ভয়াবহতা অনুযায়ী তেমন কিছুই হয়নি। কোনো রোগী মারা যায়নি, কয়েক ঘন্টার মধ্যে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অগ্নিকুণ্ড থেকে রোগীদের বের করে স্থানান্তর করা হয় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে। নানা প্রচেষ্টায় কয়েক ঘন্টার মধ্যে হাসপাতালের বিদ্যুৎ ফিরে আসে, সকাল না হতেই অন্য হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে আনা হয় অনেক রোগীকে। পুরোপুরি না হলেও শুক্রবার সকাল থেকেই চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করে হাসপাতালটি।
কিন্তু এতো বড় আগুন থেকে কী করে এতগুলো রোগী রেহাই পেল সে প্রশ্ন ছিল হাসপাতালে আসা প্রতিটি মানুষের মুখে।
অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, যে কোনো বড় দুর্যোগে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ হাতে হাত রাখে, কাঁধে কাঁধ রেখে সেখানে ঝাপিয়ে পরে-যেমনটা দেখেছিলাম ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধ্বসের সময়, তেমনি গতকাল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেও দেখেছি প্রতিটি মানুষ একসঙ্গে এগিয়ে এসেছেন। কেউ কাউকে চেনেন না, নেই কোনো দল পার্থক্য, নেই কোনও জাতিভেদ। যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবেই এগিয়ে এসেছেন। স্ট্যাটাসে লিখেছেন যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার শওকত মঞ্জুর শান্ত।
শান্ত আগুন লাগার পর পুরোটা সময় সেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজের চোখে হাসপাতালের অবস্থা দেখে তিনি তার ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে লিখেছেন, কেমন করে প্রতিটি মানুষ এক হয়ে গেল-কেমন করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের রোগীরা রক্ষা পেল।
তিনি লিখেছেন, কোনো ইনফো নেই, কোনো রকমে হাসপাতালের গেটে ঢুকেই লাইভে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তখন একে একে অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগিদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গেটেই দেখলাম পুলিশের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও গেট ফাঁকা রাখতে যে যার মত সহযোগিতা করছে।
শতশত রোগী তখন হাসপাতালের মাঠে। আমাদের ডাক্তার বন্ধুরা, নার্স আপুরা সে মাঠেই রোগীদের কাছে গিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছেন, খোঁজ নিচ্ছেন। শুধু রোগী স্বজনরাই নয় বাইরের অচেনা মানুষও রোগীদের ধরে ধরে অ্যাম্বুলেন্সে তুলতে সহযোগিতা করছেন।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের আগুনের ঘটনায় কোনো ধরনের ক্যাজুয়ালটি ছাড়া যে এত অসুস্থ রোগীকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হলো, তার পেছনে কিন্তু বড় ভূমিকা রেখেছেন হাসপাতালেরই চিকিৎসকরা। তারা রোগীদের উদ্ধার করতে গিয়ে, স্থানান্তর করতে গিয়ে নিজেরা পুড়েছেন, আহত হয়েছেন, কিন্তু রোগীদের কিছু হতে দেননি।
চিকিৎসক গুলজার হোসেন উজ্জ্বল ফেসবুকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সার্জারি কনসালট্যান্ট ডা. ফরহাদ উদ্দিন আহমেদের স্ট্যাটাসের কথা জানিয়ে লিখেছেন, জানলাম অভাবনীয়-অতুলনীয় মানবিকতায়, সাহসে আর বুদ্ধিমত্তায়, চিকিৎসক, সেবিকা, হাসপাতালের শিক্ষার্থী, কর্মচারী ও ছাত্রলীগের ত্যাগী কর্মীদের বদৌলতে বেঁচে গেল অনেক অসহায়, মুমূর্ষু প্রাণ। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের হাত থেকে অসহায় রোগীদের রক্ষা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া সব চিকিৎসক, মেডিকেল শিক্ষার্থীদের প্রতি নতমস্তকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
হাসপাতালের ভবনে প্রবেশের মূল গেটে গিয়ে দেখি শতশত মানুষ পাশাপাশি হাত ধরে দাঁড়িয়ে একটা ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে যাতে বাইরের উৎসুক মানুষ ভেতরে ঢুকে অযথা জটলা না করতে পারে। এরা কেউ রোগীর স্বজন, কেউ হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়, কেউ হাসপাতালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া শিক্ষার্থী, কেউ পাশের পান দোকানদার। একটা বিপদ দেখে যে যার মত দায়িত্ব খুঁজে নিয়েছে অবলীলায়।
এর পর আরও অবাক হবার ছিল শান্তর জন্য। তিনি লিখেছেন, হাসাপাতালের পেছনে যে ভবনে আগুন লেগেছে সেদিকে গিয়ে আরো অবাক হতে হলো। শতশত ছেলে, যুবক একাধারে কাজ করে চলেছে আগুন নেভাতে। পাশের বস্তির কিশোর, বিহারী ক্যাম্পের যুবক, ফুটপাতের দোকানী, কাসাই, ডাব বিক্রেতা, ছাত্র, শিক্ষক কে নেই এই দলে!!! ফায়ার সার্ভিসের পানির মোটা পাইপগুলো ঘন্টার পর ঘন্টা কাঁধের উপর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, হাসপাতালের দেওয়াল ভেঙ্গে পানি দেওয়ার পথ তৈরি করা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দ্বিতীয়/তৃতীয় তলায় গিয়ে আগুনের উৎস খোঁজা ও নেভানোতে ফায়ার সার্ভিসের বন্ধুদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে টানা কাজ করে গেল সবাই।
শান্ত শেষ করেছেন এভাবে-বার বার মনে হচ্ছিল এটাই তো বাংলাদেশ!!! এটাই তো আমরা!!! যেকোনো বিপর্যয়ে এভাবেই তো আমরা এক হয়ে উঠি। আমরা কি হারতে পারি? কোনোদিন না।
এভাবেই সবাই এক হয়ে কাজ করেছেন বৃহস্পতিবার। হাসপাতালের পাশে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কে রাখা হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, সেখান থেকেই দেওয়া হয়েছে পানি। আর সেখানে ফায়ার সার্ভিসকে সাহায্য করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক’শ শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগ সভাপতি মাসুদুর রহমানসহ শিক্ষার্থীরা রাস্তা পরিষ্কার করেছেন ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির রাস্তা খালি রাখার জন্য।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে দশটায় ধানমন্ডি থেকে ঢাকা মেডিকেল যাবার পথে প্রতিটি হাসপাতালের সামনে ছিল অ্যাম্বুলেন্সের সারি, ছিল নিরাপত্তারক্ষীদের হুইসেলের শব্দ। সেখানে ভীড় না করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছিল সাধারণ মানুষদের। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সেখানে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়, ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী রোগীদের স্থানান্তর করা হয় সেসব হাসাপাতালে।
ঢাকা মেডিকেলে পৌছানোর পর মূল সড়কে সিএনজি দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি, কোনো রিকশা ছিল না, ছিল না কোনো গাড়ি। পুরো রাস্তা ফাঁকা রাখা হয়েছে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সের পথ পরিষ্কার রাখার জন্য। জরুরি বিভাগের সামনে ছিল না চিরচেনা সেই ভীড়, কেবল নিরাপত্তারক্ষী ও গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া কাউকে সেখানে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তারক্ষীরা মাইকে ঘোষণা দিচ্ছিলো অযাচিত ভীড় না করার জন্য। একের পর এক রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স আসছে আর চোখের পলকে তাদেরকে ট্রলিতে করে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসকরা রয়েছেন রোগীর ধরণ দেখেই সেই বিভাগে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য।
কেবল তারাই নন, গতকাল রাতে হাসপাতালে ট্রলি ঠেলার কাজটা করেছেন সেখানে কর্মরত সাংবাদিকরাও। সারাবাংলার স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সৈয়দ সোহেল রানা, এনটিভি অনলাইনের মেডিকেল প্রতিবেদক আল আমিন জানালেন, প্রথমদিকে যখন রোগী আসা শুরু করে তখন তারা জরুরি বিভাগ থেকে তাদের নাম-ঠিকানা-বয়স নিচ্ছিলেন পেশাগত কাজের জন্য। কিন্তু ৫ থেকে ১০ মিনিট পর যখন একসঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স আসা শুরু হয়, যখন হাসপাতালের ট্রলিম্যানরা ট্রলিতে করে রোগীদের নিয়ে কুল পাচ্ছিলেন না তখন তারাও হাতের কাগজ –কলম রেখে অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগীদের ট্রলিতে করে ভেতরে নিয়ে যান। সৈয়দ সোহেল রানার ভাষায়-চোখের সামনে রোগীরা অ্যাম্বুলেন্সে করে এসে অপেক্ষা করবে ট্রলি ম্যানের জন্য, এটা চোখে দেখা যায় নাকি? তখন কীসের রিপোর্ট আসল কাজ রোগীদের ভেতরে নেওয়া, তাই আর পরে সব রোগীদের নামও লিখতে পারি নি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান ফেসবুকে লিখেছেন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় হাসপাতালের ডাক্তার, মেডিকেল ছাত্র, নার্স ও কর্মচারীরা, ফায়ার ব্রিগেডের ও পুলিশের সহায়তায় রোগীদের সরানোসহ জীবন বাচাতে সারা রাত কাজ করেছেন। ঢাকা মেডিকেলে অনেক রোগীকে স্থানান্তর করতে হয়েছে, সেখানকার ডাক্তাররাও ব্যস্ত সময় পার করেছেন। খালি চোখে সেবা প্রত্যাশী জনগনের কাছে মনে হয় এ আর এমন কি, এটাই তো ওনাদের কাজ। আমরা আমাদের দেশে ধন্যবাদ শব্দটা ব্যবহারে খুবই কৃপণ, আবার কিছু বিকৃত মস্তিস্ক কি বোর্ড যোদ্ধা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন ডাক্তার কেনো মরলো না। পুলিশের মৃত্যু, ডাক্তারের মৃত্যু হাসির খোরাক জোগায় এই সকল জানোয়ারদের কাছে।
হাসপাতালের রোগীরাও বাঁচিয়েছেন একজন আরেকজনকে। তেমনি একজন ছিলেন হুসনে আরা। তিনি জানালেন, আট বছরের মেয়েকে নিয়ে তিনি হাসপাতালে ছিলেন। তার স্বামী মেয়েকে স্ত্রীর কোলে দিয়ে হাসপাতাল থেকে তাদের বের করে দেন, স্ত্রীকে তিনি বলে যান-ওয়ার্ডের ভেতরে আরও মানুষ আছে, তাদেরকে বের করতে হবে। পরে হুসনে আরা জেনেছেন, তার স্বামী ৪ থেকে ৫ জন রোগীকে ওয়ার্ড থেকে বের করেছেন।
শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে এই প্রতিবেদক সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যাওয়ার জন্য সিএনজিতে উঠলে সিএনজি চালক খুব স্বাভাবিকভাবেই বলে ওঠেন, আপা-আপনার কী হাসপাতালে রোগী আছে? না বলতেই তার পাল্টা মন্তব্য-কাল রাতে ভয়াবহ আগুন লাগছিল হাসপাতালে। সোহরাওয়ার্দীতে আগুন লাগার পর হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছেন রোগী, একবার নয়-তিনি তারপর আবার গিয়েছেন, আবার রোগী নিয়ে এসেছেন ঢামেকে। তৃতীয়বার গিয়ে রোগী পান নি, ততোক্ষনে সব রোগীরা স্থানান্তর হয়ে গিয়েছেন।
হাসপাতাল পৌছে সিএনজি থেকে নেমে তাকে প্রশ্ন করলাম, হাসপাতাল থেকে ঢামেক পর্যন্ত কত ভাড়া নিয়েছেন জানতে চাইতেই সিএনজি চালকের বিস্ময়মাখা উত্তর। মানুষগুলা হাসপাতালে বাঁচতে আইছিলো, বাঁচার বদলে তারা মরণের পথে। সেই মানুষগুলা থিকা ভাড়া নিমু আপা-আমরা কী মানুষ না…???
সারাবাংলা/জেএ/জেএএম