‘সর্বনাশা’ সাংবাদিকতা
১০ মে ২০১৯ ২২:১৬
শিরোনামটা একটু চটকদার রাখতেই ‘সর্বনাশা’ যোগ করা হয়েছে। ঠিকঠাক বললে বলা যেত ‘ঘটনাসর্বস্ব’ সাংবাদিকতা। কিন্তু এখন আবার পাঠকও একটু ‘সর্বনাশ’ পছন্দ করেন। তাই ঘটনাকে যতটা সম্ভব বিস্তারিত বর্ণনার কালে পটু সাংবাদিকতার একটু আচার যোগ করতেই এই সর্বনাশের আমদানি। যাই হোক, যা থেকে আলাপ তাতেই ফিরে যাওয়া যাক। এইখানে যেহেতু সাংবাদিকতা করতে বসিনি, তাই ঘটনার কাছে কাছেই থাকা যাক। দূরে দূরে সাংবাদিক থাক!
মূল ঘটনা বর্ণনার আগে একটা প্রশ্ন করা যাক। বলেন তো, ‘বরুণ বিশ্বাস কেন রাতের অন্ধকারে নারকেল পাড়তে গিয়েছিলেন?’ না, না। যা ভাবছেন একদমই তা নন তিনি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গতকাল রাতেরই সংবাদ ‘গাছ থেকে পড়ে ঢাবি ছাত্রের মৃত্যু’। সংবাদে বলা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলের নারিকেল গাছ থেকে পড়ে বরুণ বিশ্বাস (২০) নামে একজন ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৯ মে) রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে রাত ১১টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন। বরুণ বিশ্বাসের মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।’
এইটুকু বরুণ বিশ্বাসকে মনে রাখার দায়ইবা কার। যদি মর্গে বরুণ বিশ্বাস জীবিত হয়ে উঠতেন, বা ওই নারকেল গাছটা যদি বরুণের শোকে কাঁদতে থাকত তাহলে না হয় আরও খবর পাওয়া যেত। কারণ ঘটনা না ঘটলে এই বাজারে আর সাংবাদিকতা হয় না। কিন্তু সংবাদ কি কেবলই ঘটনা? ঘটনার আগে-পরে কি সাংবাদিকতার কিছু নেই? নাকি, পাঠক কেবল ঘটনা জানতেই পছন্দ করেন? পাঠক ঘটনা জানতে চাইবেন এটা স্বাভাবিক, কিন্তু সাংবাদিক কী করবেন? যত দ্রুত বরুণ বিশ্বাসকে মর্গে পাঠানো যায়, এই চেষ্টা ছাড়া অনলাইন সাংবাদিকদের আর কি কোনো চেষ্টা থাকে? মর্গে পাঠানো বলতে কত দ্রুত ঘটনাকে সংবাদ হিসেবে ছাপা যায় আরকি!
বলে রাখা ভালো, পাঠক কিন্তু কেবল ঘটনা জানতে চায় না। তাই নারকেল পাড়তে গিয়ে বরুণ বিশ্বাসের মৃত্যু যত দ্রুতই ছাপা হোক, ওটা পাঠকের মনে রাখার দায় নেই। কিন্তু পরে যদি এই রকম কোনো খবর জানা যেত, বরুণ বিশ্বাস কেন অন্ধকারে নারকেল পাড়তে উঠেছিল? তার কি নারকেল খাওয়ার টাকা ছিল না? বাজারে অবশ্য এখন নারকেলের যে দাম! এই যে বাজার অর্থনীতি চলে আসে। অভাবের কথা বলতে গেলেই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে কী!
কিংবা হলের নারকেল গাছে আসলে কার অধিকার? প্রভোস্ট না ছাত্রের? এই রে, ক্ষমতার কথা তো বলাই যাবে না! বরুণ বিশ্বাসের মৃত্যুর ওই খবরেই আরও বলা আছে, দুপুরে না কি সে একবার গাছে ওঠার চেষ্টা করেছিল। তখন সিনিয়ররা তাকে বাধা দেয়। দুপুরে কেন তাকে গাছে উঠতে দেওয়া হলো না? কেন সে রাতের অন্ধকারে ফের গাছে ওঠার চেষ্টা চালাতে গেল? চোরের মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কেন দিনের আলোয় একজন শিক্ষার্থী গাছে উঠতে পারবে না ফল পাড়তে? কিন্তু সাংবাদিকতা তো এখন আর প্রশ্ন করে না। কেবল ঘটনা ঘটলেই সংবাদ হয়। এবং প্রতিযোগিতা কেবল কত দ্রুত ছাপা যায়।
এরপর…?
এরপর আর কি? ঘটনার তো অভাব নেই। বরুণ বিশ্বাস তাই কোনো প্রশ্নের জন্ম দেয় না। মর্গ থেকে সে চলে যাবে গ্রামের বাড়িতে। তারপর পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। বড়জোর দু’য়েকজন বন্ধু কখনো কখনো মনে করবে। আর সাংবাদিকের ভাগ্য ভালো হলে হয়তো শিগগিরই অন্য কেউ সেই একই নারকেল গাছ থেকে পড়ে মরবে! তাহলে সেই অভিশপ্ত নারকেল গাছ নিয়ে নানা সংবাদ ছাপা যেতে পারে। হয়তো খোদ প্রক্টরই সেই গাছ কাটার আয়োজন করতে পারেন বিস্তারিত আয়োজনে। চাইলে হয়তো টেলিভিশনও লাইভ শুরু করবে, অনলাইনে কে কত দ্রুত আপ করতে পারে, ‘সেই নারকেল গাছে পড়লো প্রথম কোপ’! এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় আরও আরও যত কোপ লাগে, তার প্রত্যেকটারই আপডেট দেওয়া হবে।
সর্বনাশ আর কারে বলে?
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/একে/এমএম