Wednesday 15 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অন স্পট রিপোর্টিং ও কিছু আগুনে পোড়া দোকান


৩১ জানুয়ারি ২০১৮ ১০:২০ | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৮ ১১:০৩

সকালে অফিসে যাচ্ছিলাম। রাজারবাগ সিগন্যাল থেকে পল্টনের দিকে মোড় নিতেই দেখি সামনে বেশ ভিড়। ভিড়ের ফাঁকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির সাইরেন। মানুষের জটলা দেখে বুঝতে বাকি নেই আগুন লেগেছে কোথাও।

আমি মূলত রিপোর্টার না। সাংবাদিকতার শুরু থেকেই ফিচার লিখি। রিপোর্টিং করি কালেভদ্রে ইভেন্টের দাওয়াত পেলে।

অন স্পট রিপোর্টিং কখনোই করি নি। কিন্তু কেনো যেনো মনে হল, এখনই নামা উচিৎ। কেন হল জানিনা, তবে মনে হয়, এটা অনলাইনে কাজ করারই আশীর্বাদ। সারাবাংলা.নেট সারাক্ষণ ব্রেকিং নিউজের পেছনে ছোটে। আমি লাইফস্টাইল ডিপার্টমেন্টে কাজ করলেও বোধ হয় সেই ব্রেকিংয়ের বোধটাই প্রকটভাবে কাজ করেছে। নইলে গাড়ি পুরোপুরি থামার আগেই যেভাবে নেমে দৌড়ালাম, তাতে নিজেই অবাক হলাম।

যাক দৌড়ে পৌঁছালাম ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির কাছে। প্রথমেই এক পুলিশ কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করলাম, আগুন লেগেছে কোথায় আর কীভাবে? উনি বললেন ‘সিটি হার্ট’ মার্কেটে। বিস্তারিত জানতে চাইলে উনি আমাকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির কাছে ফায়ার কর্মী ও অফিসারদের দিকে যেতে বললেন। এইটুকু হাঁটতে হাঁটতেই মার্কেটের নাম যে ‘সিটি হার্ট’ আর তার দোতলায় আগুন লেগেছে সেই খবর সারাবাংলা নিউজরুমে পাঠিয়ে দিয়েছি। কমন চ্যাটবক্সে ছোট্ট নোট। আর বললাম একজন ফটোগ্রাফার পাঠাতে।

নিউজরুম থেকে পাল্টা নোট এলো… ফটোগ্রাফার কাছাকাছি নেই, আমাকেই ছবি তুলতে হবে মোবাইল ফোনে। আমার ফোনের ছবি কেমন হবে… না হবে চিন্তা করতে করতে মার্কেটের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করলাম। আগুন ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণে হলেও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছাড়া কাউকে মার্কেটের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এর মাঝেই যতটুকু পারলাম একে তাকে প্রশ্ন করে ছোট ছোট নোটে অফিসে নিউজ পাঠাচ্ছি আর মার্কেটের গেটের দিকে এগুচ্ছি। একজন ফায়ার ফাইটার বললেন আগুন লেগেছে দোতলায়। ভাবলাম ছবি পেতে হলে ওখানেই যেতে হবে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু বিধি বাম। আমাকে গেটেই আটকে দেওয়া হল। যার দোকান পুড়েছে তিনিই হবেন হয়ত, ভদ্রলোক আমাকে কিছুতেই মার্কেটের ভেতরে যেতে দেবেন না। চিৎকার করে বলছেন, ‘আমার সব পুড়ে শেষ আর আপনি আসছেন ছবি তুলতে’। আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমি নিউজ করতে ছবি তুলব, অন্য কিছু না। তখন ব্যাগ হাতড়ে প্রেস কার্ডটা বের করেছি।

প্রয়োজনের সময় এই কার্ডটা কিছুতেই হাতে ওঠে না কেন জানি। যাই হোক পেলাম অবশেষে আর উনি প্রেস কার্ড দেখে কিছুটা নরম হলেন। কিন্তু আমাকে কিছুতেই ভেতরে যেতে দিলেন না। তাই বাধ্য হয়ে বাইরে থেকেই কয়টা দোকান পুড়েছে, হতাহতের সংখ্যা আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে চেষ্টা করছিলাম।

ফিরে আসব তখন ফায়ার সার্ভিসের সেই অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, আমি ছবি তুলতে পেরেছি কিনা। বললাম, না পারিনি। আমাকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। তখন উনি আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন। একজন পুলিশ অফিসার আমার প্রেস কার্ডটা পরীক্ষা করলেন। আমার সাথে সাথে আরও কিছু পুলিশ আর ফায়ার সার্ভিসের অফিসার ঢুকলেন। দেখলাম মার্কেটের ভেতরে নিচতলার সিঁড়ির কাছ থেকেই কালো ছাই মেশানো পানিতে সয়লাব।

সেই পানি পার হয়েই সবার আগে ছোটা শুরু করলাম। জানিনা কি ভূত মাথায় চেপেছিল। খবর টা কাভার করে দ্রুত নিউজরুমে পাঠাতে হবে এটাই মাথায় ঘুরছিল তখন। পরনের সাদা জামা, কাপড়ের জুতো যে নষ্ট হচ্ছে সে কথা মাথায় ছিল না একদমই। যাই হোক উপরে উঠে গেলাম ক্যামেরা অন করেই। উপরে উঠতেই ধোঁয়ায় চোখ জ্বলতে শুরু করল। একদিকে নিচে পায়ের পাতা ডোবা পানি, সিলিং এর ভাঙা টুকরো আর ফায়ার এক্সটিংগুইশার এর মোটা মোটা পাইপ ছড়ানো। অন্যদিকে সিলিংএ লাগা আগুন নেভাতে দেওয়া পানি টুপ টাপ বৃষ্টির মত ঝরছিল। বুঝতে পারলাম, রিপোর্টারদের কাজটা মোটেই সহজ না। যে কোনো পরিস্থিততেই খবর সংগ্রহ করতে সবচাইতে আগে দরকার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা।

বিজ্ঞাপন

যাই হোক, পুলিশ আর ফায়ার সার্ভিসের সবাই বেশ সাহায্য করছিলেন। পুড়ে যাওয়া দোকানগুলো ডেকে ডেকে দেখাচ্ছিলেন, ছবি তুলতে বলছিলেন। আমি অন্ধকারের মাঝেই কোনরকমে কয়েকটা ছবি নিতে পারলাম।

পুড়ে যাওয়া দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে, কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে নিচে আসলাম। নিচে নেমে দেখি সেই দোকান মালিক তখন শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে। ওনাকেও উপরে যেতে দেওয়া হয়নি। সিভিলিয়ান কাউকেই না। আমার একটু অদ্ভুত রকম খারাপ লাগল ওনার জন্য। এত বড় দোকান আর তাতে থাকা সব জিনিস পুড়ে ছাই। নিরাপত্তার জন্যই হয়ত এই ভদ্রলোককে সেখানে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। উনি যে হতাশা থেকেই আমার সাথে চিৎকার করছিলেন সেটা বুঝতে পারলাম। তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু তিনি সাড়া দিলেন না। আসলেই তো আমরা না হয় খবর কাভার করব, ছবি দেব। কিন্তু যার দোকান পুড়ল, তার আসলে কপালই পুড়ল। তার এই ক্ষতি কবে পূরণ হবে বা আদৌ হবে কিনা সে খবর কে রাখে? কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, যত বড় ক্ষতি সাংবাদিকের জন্য তত বড় খবর।

যাই হোক অফিসে ফিরে দেখলাম আমার পাঠানো খবরটি পেজের লিড নিউজ। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি আছে। সবসময় ফিচার লিখলেও আজ বুঝলাম, নিউজ রুমের প্রভাব আমার ওপরে ভালভাবেই পড়েছে। তাই ভুলে গেছি পোশাক ও চুল থেকে আসা ছাইয়ের পোড়া গন্ধ আর খবর সংগ্রহের হুড়োহুড়িতে কিছু বিড়ম্বনার মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা।

লেখক : সংবাদকর্মী

সারাবাংলা/একে

 

বিজ্ঞাপন

১০০ পর্বে ‘সিটি লাইফ’
১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৩৮

আরো

সম্পর্কিত খবর