Wednesday 15 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ’র জন্য কী উদ্বেগ, কী উৎকন্ঠা!


৪ মার্চ ২০১৮ ২০:২৪ | আপডেট: ৫ মার্চ ২০১৮ ১১:১৯

হাসপাতালে নেওয়ার পরপরই সিদ্ধান্ত হলো অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে। আমরা তখন হাসপাতালে ওয়ার্ডের বাইরে। চিকিৎসকরা জানালেন- রক্ত প্রয়োজন। দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। মাথায় অস্ত্রোপচার করতে হবে। ডাক্তারদের এমন ঘোষণায় মূহূর্তেই বদলে গেল হাসপাতালের পরিবেশ। ছুটোছুটি শুরু হলো। সাথে বাড়তে থাকলো উদ্বেগ-উৎকন্ঠাও। সবার প্রশ্ন- তাহলে কী স্যারের অবস্থা আশঙ্কাজনক? যতই হইনা কেনো সংবাদকর্মী- এমন উদ্বেগ ঠিক নেওয়া যায় না!

বিজ্ঞাপন

আমি বলছি শনিবার সন্ধ্যা রাতের কথা।

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমরা সংবাদকর্মীরা ভিড় করে আছি, অন্যরাও আছে। ভেতরে জাফর ইকবাল স্যারের অস্ত্রোপচার হচ্ছে। সকলের সাথে আমরাও উদ্বিগ্ন। পাশাপাশি আমাদের দিতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তের আপডেট।

সেই কাজের মধ্যেই দেখলাম হাসপাতালের ভিতরে বাইরে অসংখ্য মানুষ। সবাই উদ্বিগ্ন। একটি মানুষের জন্য এতো আবেগ, এতো ভালোবাসা আমি কমই দেখেছি।

আমাদের, সংবাদকর্মীদের এমন কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রায়ই যেতে হয়। তখন কত আবেগ আমাদেরও ছুঁয়ে যায়। বছর খানেক আগের আতিয়া মহলের সেই জঙ্গি কাহিনীর দগদগে ঘা স্মৃতি থেকে এখনো মুছে যায়নি। কিন্তু শনিবার রাতে হাসপাতালের অনুভূতিটা ছিলো আরও ভিন্নরকম।

জাফর ইকবাল স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু দেখেছি কেবল তার শিক্ষার্থীরাই নয়- গোটা সিলেটের মানুষই যেনো ছুটে গিয়েছিলো হাসপাতালে। সবার মুখে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। আর একটাই প্রশ্ন- কী হবে স্যারের?

সব আবেগ সামলে আমি তখনও আপডেট নিউজ দিতেই ব্যস্ত। অপারেশন থিয়েটারে পাঁচ সদস্যের মেডিকেল টিম স্যারের চিকিৎসায় ব্যস্ত। বাইরে উৎকন্ঠার অপেক্ষা। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক কেটে যাচ্ছে। ডাক্তাররা কোনো ব্রিফ করছেন না।

হঠাৎ একজন চিকিৎসক বেরিয়ে এসে বললেন- ভয়ের কিছু নেই। স্যার ভালো আছেন। কেঁদে ফেললেন অনেকেই। সেকি কান্না! সত্যি বলছি এতো আবেগ-এতো ভালোবাসা আমি আগে কখনো দেখিনি।

আর এটাও সত্য বলে মানি- একজন মানুষের জন্য এতো ভালোবাসা, এত আবেগ তা জাফর ইকবালের জন্যই মানায়!

একটু ঘটনার শুরুর দিকের কথাও বলি। আমি মেডিকেল কলেজ এলাকাতেই ছিলাম। মোবাইল ফোনে খবর পেলাম জাফর ইকবাল স্যারের উপর হামলা হয়েছে। মেডিকেল নিয়ে আসা হচ্ছে। আমি যখন মেডিকেল পৌঁছলাম ততক্ষণে স্যারকে নিয়ে আসা হয়েছে। দলে দলে শিক্ষার্থীরা ছুটে আসছে হাসপাতাল এলাকায়। শিক্ষকরাও আসছেন।

বিজ্ঞাপন

আমি আগে থেকেই ছিলাম বলে স্যার যখন নিয়ে আসা হলো কাছে যেতে পারলাম। দেখলাম স্যারের তখনো জ্ঞান আছে। আস্তে আস্তে কথা বলতে পারছেন। হাসপাতালে নিয়ে আসছিলো যে ছাত্ররা তাদের একজন স্যারকে কানে কানে জানালো- হামলাকারী ধরা পড়েছে। স্যার সঙ্গে সঙ্গে ওকে বলে উঠলেন- ‘ওকে মেরো না। ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পারে। ওকে সেইফ করো।’ স্যারের কথা রাখলেন ওই ছাত্র। ম্যাসেজটি তিনি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠিয়ে দিলেন। আমরা পরে শুনেছি, স্যারের ওই বার্তা পৌঁছানোর পর উত্তেজক অবস্থা কিছুটা প্রশমিত হয়।

স্যার যখন হাসপাতালে তখন সেখানে ছুটে যান সিলেট আওয়ামী লীগের নেতারাও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বার্তা ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে- স্যারকে দ্রুত ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পাঠাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীও স্যারের ঘটনা শুনে মর্মাহত হয়েছেন। তিনি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছেন। দ্রুত পাঠানো হচ্ছে সিলেটে। ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মুর্শেদ আহমদ আহমদ চৌধুরীর কাছেও ম্যাসেজ এসেছে। এসব তথ্য আমাদেরসহ উপস্থিত সকলকেই আলোড়িত করে। কেবল আমরাই নই, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাফর ইকবাল স্যারের জন্য উদ্বিগ্ন, আবেগ তাড়িত।

এরই মধ্যে স্যারের শরীরে দুই ব্যাগ রক্ত পুশ করা হয়েছে। মাথায় সার্জারী করা হয়েছে। স্যারের এনেসথেশিয়া দেওয়া হয়েছিল। অপারেশনের পর জ্ঞান ফিরেছে।

ততক্ষণে ছুটে এসেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি সিলেটের বিয়ানীবাজারে তার নির্বাচনী এলাকায় ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী এসে স্যারের শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নিলেন। বাইরে এসে বললেন- ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ‘শিক্ষা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ’ ড. জাফর ইকবালকে ঢাকার সিএমএইচে নেওয়া হচ্ছে।’

শিক্ষামন্ত্রী হাসপাতালে থাকতে থাকতেই খবর এলো এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ওসমানী আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছে। চিকিৎসকরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। কিন্তু নামাবেন কিভাবে। বাইরে হাজারো মানুষ। তাদের দুই দিকে ঠেলে স্যারকে নেওয়া হবে কষ্টকর। কিন্তু যখন স্যারকে বের করা হলো তখন বদলে গেলো পরিবেশ। স্যারকে দ্রুত ঢাকা নিতে হবে। সুতরাং সকলেই নিজেরা সরে গিয়ে পথ বের দিলেন। রাত ১০টার দিকে ড. জাফর ইকবালকে নিয়ে যাওয়া হলো ঢাকায়।

ব্যতিক্রমী এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কাটলো গোটা সময়টি। স্যারকে ঢাকায় বিদায় করার পর দেখা গেলো সিলেটের অন্য এক রূপ। উত্তাপ উত্তেজনা যেনো বাড়তেই থাকে। ক্যাম্পাসে ছাত্ররা অবস্থান নেয়। তারা বিচায় চায়। হাসপাতালে থাকা ছাত্র-শিক্ষকরা বিচার চান। তাদের ক্ষোভ বাড়ছেই। র‌্যাব-পুলিশ তখনও ক্যাম্পাস থেকে নিয়ে আসতে পারছিল না হামলাকারী আহত ফয়জুরকে। ছাত্ররা তাকে বের করতে দেবে না। র‌্যাব-৯ এর সিও লে. কর্নেল আজাদ শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে হামলাকারীকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। গণপিটুনিতে তার অবস্থাও আশংকাজনক। সবাই তার জীবন চায়। কিন্তু তাকেও তো বাঁচাতে হবে। কারণ- হামলাকারীর কাছ থেকেই পাওয়া যাবে তথ্য।

রাত সাড়ে ১২ টার দিকে খবর এলো জ্ঞান ফিরেছে হামলাকারীর। পরিচয় জানা গেছে। র‌্যাবের সিও বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের জানালেন- ‘সে নিজ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ হামলা চালিয়েছে। তার ধারণা মুহম্মদ জাফর ইকবাল ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেন।’

তার এই কথায় নানা প্রশ্ন চারদিকে। তাহলে কী হামলাকারী কোনো জঙ্গি গোষ্টির সঙ্গে জড়িত?

সে রাতে আর সে বিষয়ে তথ্য মিললো না। পরে রোববার র‌্যাব হামলাকারী ফয়জুর সম্পর্কে সব তথ্য পরিস্কার করেছে। র‌্যাব সিও প্রেস ব্রিফিং করে জানান, জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী হয়েই সে হামলা করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। বিকেলে র‌্যাব তাকে পুলিশে সোর্পদ করে। পরে পুলিশ তাকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। এখনো সুস্থ নয় হামলাকারী ফয়জুর। সে খবরতো নিতেই হচ্ছিলো। সঙ্গে প্রতিটি আপডেট পাঠাতে হচ্ছিলো ঢাকায়।

সকালে মনঃস্থির করলাম হামলাকারীর শেখপাড়াস্থ বাড়ি ঘুরে আসার। সেখানে এলাকার লোকজন তাকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারেননি। তারা মাঝে মধ্যে তাকে এলাাকায় দেখেছেন। কারো সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিলো না। ফলে ধোঁয়াশা কাটলো না ফয়জুরকে নিয়ে। তার পিতা হাফেজ আতিকুর রহমান। ঘটনার পরপরই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনিও পালিয়েছেন।

বিকেলে ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে এলেন শাবির ভিসি প্রফেসর ফরিদউদ্দিন আহমদ। তিনিও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন। তার কথার সবচেয়ে বড় ম্যাসেজ ছিল- জাফর ইকবাল স্যারের নির্দেশনা। স্যার ভিসির মাধ্যমে ম্যাসেজে জানিয়েছেন- এই ঘটনা নিয়ে কোনো উশৃঙ্খল যেনো না হয়। ক্যাম্পাস যেনো শান্ত থাকে।

ভিসি স্যার জানালেন- এই ঘটনা শাবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য বড় ম্যাসেজ। ক্যাম্পাস নিরাপদ নয়। এখন গোটা ক্যাম্পাসকে সিসিটিভির আওতায় আনতে হবে। বহিরাগতরা যাতে বিনা প্রয়োজনে না ঢুকতে পারে সে ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বস্ত করেছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরও নির্মাণ করবেন।

কিন্তু তাতেই কী কাটবে উদ্বেগ? সে প্রশ্নটি নিজের কাছে নিজেই করলাম। উত্তর হয়তো সেদিনই মিলবে, যেদিন দেশ হবে জঙ্গিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত।

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

১০০ পর্বে ‘সিটি লাইফ’
১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:৩৮

আরো

সম্পর্কিত খবর