Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা-বন্যা আর দুর্নীতি কেড়ে নিয়েছে ঈদ আনন্দ


৩১ জুলাই ২০২০ ২১:০৬

ঢাকা: শনিবার (১ আগস্ট) পবিত্র ঈদুল আজহা। দেশের প্রেক্ষাপটে এই ঈদ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আনন্দের দিন। ধনী-গরিব নির্বিশেষ সকলেই এই উৎসব পরিবার-স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে উপভোগ করেন। কিন্তু এই বছরে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) নামের দুর্যোগ জনজীবনের এই উৎসব পানসে করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে চলমান বন্যা আর দুর্নীতি, মানুষের শেষ হাসিটুকুও কেড়ে নিচ্ছে।

কোভিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে শুক্রবার (৩১ জুলাই) জানানো হয়, এই ভাইরাসের আক্রমণে সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩ হাজার ১১১ জনে। একই সময় ২ হাজার ৭৭২ জনের শরীরে কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টার শনাক্ত নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৬ জন।

বিজ্ঞাপন

প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে। শুধু মারা যাচ্ছে না, মারা যাওয়ার এই সংখ্যা বা অনুপাত বিশ্লেষণে দেখা যায়— গত মার্চ-এপ্রিল-মে এই তিন মাসে যত মানুষ মারা গেছেন, তার দ্বিগুণ মারা গেছেন জুন-জুলাইয়ে। এদিকে, দেশে করোনা আক্রমণের পর প্রথম ৯৫ দিনে এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। পরের একহাজার মৃত্যুর জন্য সময় লাগে মাত্র ২৫ দিন। এর পরের ২৩ দিনে মৃত্যু সংখ্যা তিন হাজার অতিক্রম করেছে।

অর্থাৎ মারা যাওয়ার হার দিন দিন বাড়ছে। মৃত্যুর এই পরিসংখ্যান প্রশ্নের জন্ম দেয়— দেশে কোভিড-১৯-এর ট্রেসিং সঠিকভাবে হচ্ছে কি না। কারণ করোনাভাইরাসের জন্য নমুনা পরীক্ষা তো বাড়েইনি, বরং আগের চেয়ে কমেছে। এর বিপরীতে প্রতিদিনই আরও বেশি বেশি মানুষের মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে কী বার্তা দিচ্ছে— তা স্পষ্ট নয়। এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ বলছে, করোনা উপসর্গ নিয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটছে। কিন্তু সেগুলো সরকারি হিসাব বা স্বাস্থ্য বুলেটিনে যুক্ত হচ্ছে না। তাই প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদফতরও করোনা সংক্রান্ত যে পরিসংখ্যান ঘোষণা করে আসছে, করোনা প্রতিরোধে তা কতটুকু স্বচ্ছ— সেই প্রশ্নও থেকেই যায়।

বিজ্ঞাপন

করোনাতে সকলেই হাবুডুবু খাচ্ছি। অথচ আমাদের কারোরই হুঁশ হচ্ছে না। বেশিরভাগই শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছি না। অন্যদিকে, করোনা প্রতিরোধে কর্মরত মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি আর সমন্বয়হীনতা ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। এই সময়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার কথা বাদ দিলাম, খোদ সম্মুখসারির যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত নিয়ে শুরুতে যা হয়েছে, তা আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।

শুরুতে জেএমআই নামের একটি প্রতিষ্ঠান নকল এন৯৫ মাস্ক হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করে। এপ্রিলের ২ তারিখে গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশ হলে প্রধানমন্ত্রী তা তদন্তের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এপ্রিলের শেষভাগে মন্ত্রণালয় তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেন। এখন পর্যন্ত ওই দুনীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি এবং তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ পায়নি।

এরপর জনস্বাস্থ্যে সর্বনাশ ঘটানো সাবরিনা-সাহেদ-সাহাবুদ্দিন-জাদিদসহ একাধিক দুর্নীতির খবর প্রকাশ হচ্ছে। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের করোনা প্রতিরোধ প্রকল্পেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। মাঝে অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি হেলথ) রিজাইন করলেন। কেন  করলেন— স্বেচ্ছায় নাকি দুর্নীতির দায়ে— তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। এর আগেই স্বাস্থ্য সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হলো। কেন সরিয়ে দেওয়া হলো বা কেন তিনি সিনিয়রিটি পেলেন— সেটাও পরিষ্কার নয়।

এরপর নতুন স্বাস্থ্য মহাপরিচালক কাজে যোগ দিয়ে বলছেন, আগে করোনা প্রতিরোধ, তারপর দুর্নীতি মোকাবিলা। গত তিন মাসে করোনা প্রতিরোধ সংক্রান্ত যেসব দুর্নীতির চিত্র প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে— করোনা প্রতিরোধের উদ্যোগগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে কেবল দুর্নীতির কারণেই। পদত্যাগ করা মহাপরিচালক যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন এবং কারও কোথায় কান না দিয়ে ‘রুলস অব বিজনেস’ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতেন, তবে আজকে এত হৈ চৈ যেমন হতো না, ঠিক তেমনি করোনা পুরো দেশকে কাবুও করতে পারত না। অথবা তিনি যদি সৎভাবে ‘রুলস অব বিজনেস’ অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে বাধা পাওয়ার পর রিজাইন দিতেন, তবে কিন্তু তিনি বাহবা পেতেন। তাই নতুন মহাপরিচালককে তার বিদ্যা-বুদ্ধি কাজে লাগানোর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে— সত্যের জয় অবধারিত। আর শাক দিয়ে মাছ কখনোই ঢাকা যায় না।

এই বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্যে জনজীবনে বাড়তি দুর্যোগ যুক্ত করেছে চলমান বন্যা। রাজধানী এবারের বন্যায় তেমন আক্রান্ত না হলেও ৩১টি জেলা বা দেশের কমবেশি ৩০ শতাংশ অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। আর সরকারি হিসাবেই মৃতের সংখ্যা ৪১। বলা হচ্ছে, এবারের বন্যা গত ৯৮ সালের চেয়েও ভয়াবহ হবে। তাই যেখানে এমনিতেই করোনা আঘাতে মানুষ-জনের আয়-রোজগার বন্ধ, তার ওপর বন্যার এই প্রভাব দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীকে পথে বসাচ্ছে। মানুষের বসতবাড়ি, ফসলের জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। সরকার বিভিন্নভাবে আক্রান্ত অঞ্চলের মানুষদের সহায়তা করার চেষ্টা চালালেও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। আবার এইখানেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতি আছে। ইদানিং দুর্নীতির দায়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করা মন্ত্রণালয়ের রুটিন কাজে পরিণত হয়েছে। মজার তথ্য হচ্ছে— প্রতিবেশী ভারত ভূ-রাজনৈতিক কারণে এখনো সবগুলো বানের চাবি ঘোরায়নি। আর তাতেই বন্যার যে অবস্থা, বানের চাবিতে হাত পড়লে অবস্থা যে কী হবে, তা আর ভাবতে চাই না।

আসলে করোনা বা বন্যা— এইসব দুর্যোগে আমরা যতখানি ডুবেছি, তার থেকে বেশি তলিয়ে গেছি দুর্নীতি কাণ্ডে। স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার জন্য একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে পত্রিকার আর্কাইভে দেখেছি। এতকাল পরে এসে এখনো এই দুর্নীতির সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই সবার আগে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে না পারলে উন্নত বিশ্বে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন বোনা বৃথা।

এরই মধ্যেই উদযাপন করা হবে ঈদুল আজহা। কিন্তু এবারের ঈদে যে উৎসব বা আনন্দের রঙটা রঙিন হচ্ছে না, তা বোঝাই যাচ্ছে। এবার ঈদগাহে জামাত হবে না। শিশুরা বিনোদন কেন্দ্রে যেতে পারবে না। ধর্মীয় উৎসব পালন করতে গিয়ে পশু কোরবানি দিতে গিয়েও যতটুকু না করলেই নয়, সেই হিসেবে সবাই পালন করছে। এতে গরুর কারবারিসহ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেরই মাথায় হাত পড়েছে। চামড়ার দাম কমানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন— এই ঈদে স্বাস্থ্যবিধির ব্যত্যয় ঘটলে চড়া মূল্য দিতে হবে, যেমনটি ঘটেছিল রোজার ঈদে। ওই ঈদের আগে রাজধানী বা ঢাকা বিভাগের বাইরে তেমন সংক্রমন ছিল না। কিন্তু ওই ঈদের ১৫ দিন পর  করোনা চিত্র পাল্টে গিয়ে ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ।

তাই এই ঈদে একটাই প্রার্থনা হোক— ‘যত দ্রুত সম্ভব পৃথিবীতে যেন শান্তিদূতের ছায়া পড়ে।’

ঈদ ঈদুল আজহা করোনা করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ ডিজি হেলথ বন্যা স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর