Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইয়াসির আরাফাতের পথই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পথ


২০ মে ২০২১ ২৩:৪৮

৬ দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের (১৯৬৭ সালের ৫ থেকে ১০ জুন) পরই বিজয়ী ও পরাজিতের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল। তবে ইয়াসির আরাফাত এর চেয়েও বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

ফিলিস্তিন হলো বিশ্বে মুসলিম নেতাদের জন্য একটি লোভনীয় ইস্যু। সৌদি আরব ও তার মিত্ররা ফিলিস্তিন ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিলে পশ্চিমাদের সঙ্গে দেনদরবার করে। ইরান ও তার কিছু মিত্র ফিলিস্তিন ইস্যু কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গি সংগঠন দিয়ে প্রক্সি যুদ্ধ করায়, যাতে তার শক্ররা ব্যস্ত থাকে। তুরস্ক, পাকিস্তানের মতো মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী দেশগুলো ফিলিস্তিনের পক্ষে ইসরাইলের বিপক্ষে ফাঁপা হুংকার দিয়ে মুসলিম বিশ্বে মজলুম নেতা হতে ভাবমূর্তি বাড়ায়। তুরস্ক, পাকিস্তানের মতো দেশ ফিলিস্তিনে একটা লাঠি পাঠিয়েও সহায়তা করে না, বরং ইসরাইলের প্রধান বন্ধু মার্কিন জোটের সঙ্গে চলে শক্তিমত্তায় বড় হওয়ার চেষ্টা করেছে জীবনভর। প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক ১৯৪৯ সালে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। ইসরাইলের সঙ্গে তুরস্কের চমৎকার সামরিক সহায়তা ও বোঝাপড়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অর্থাৎ, তারা যাই বলুক না কেন, ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো প্রকৃত সমাধান তারা চায় না।

১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পরই ফিলিস্তিনের পক্ষে সংঘাত করে লক্ষ্য অর্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে হারার পর আর ওই ইস্যু থেকে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া যায় না। ১৯৭৩ সালের চতুর্থ ইসরাইল যুদ্ধের পর ইয়াসির আরাফাতের মতো দুর্ধর্ষ গেরিলা নেতাও বুঝতে পেরেছিলেন, গোটা ফিলিস্তিন ফিরে পেতে চাইলে পুরো ভূখণ্ডই হারাতে হবে।

নৈতিক ভিত্তি যতই দৃঢ় হোক—যুদ্ধে পরাজিত পক্ষের কপালে ভয়াবহ দুর্দশা নেমে আসে। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। তবে পরাজিত শক্তি যদি বাস্তবতা বুঝে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে পারে— তাহলে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত অক্ষশক্তি জার্মানি, জাপান, ইতালি। অনৈতিক ভিত্তির উপর যুদ্ধে করে হেরে যাওয়ার পরও তারা বিশ্বসভা থেকে বাদ পড়েনি। কারণ দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়ার পরে তাদের অহং ধরে বসে থাকেনি। জার্মানি পুরোটাই মিত্র শক্তি দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু হিটলারের মতো অপরাধীর জার্মানিকে আবার তাদের ভূখণ্ড ফেরত দিতে হয়েছে।

ইয়াসির আরাফাত অবশিষ্ট ফিলিস্তিনকে এমন একটি রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিলেন যেখানে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বাস করবে। তিনি নিশ্চিত পরাজয়ের পথ ছেড়ে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের চেয়ে উন্নততর কাঠামোর রাষ্ট্র তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।

ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ মুভমেন্ট ইসরাইলের বিরুদ্ধে নব্য গঠিত হামাসের চেয়েও বেশি যুদ্ধ করেছে। ফাতাহ মুভমেন্ট ছিল ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে গঠিত। মূলত ইয়াসির আরাফাত ও খলিল আল-ওয়াজির সংগঠনটি গড়েছিলেন। সিরিয়ার সমর্থন নিয়ে দামেস্কে ষাটের দশকে সমীহ জাগানিয়া এক কমান্ডো বাহিনী গড়েছিলেন তারা। ১৯৬৪ সালে ইসরাইলের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়ার মতো বড় ঘটনা ঘটিয়েছিল ফাতাহ। কিন্তু ১৯৬৭ সালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে জর্ডান, মিশর, পিএলও (ও তাদের মিত্ররাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন, কিউবা) শোচনীয় পরাজয়ের পর অস্ত্র ব্যবহার করে ফিলিস্তিনের জয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারপরেও ১৯৭৩ সালে সিরিয়া ও মিশর মিলে আকস্মিক ইসরাইলের দখলকৃত এলাকায় যুদ্ধবিরতি সীমারেখা অতিক্রম করে হামলা চালায়। ওই যুদ্ধেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় মিশর। একসময় মিশরের রাজধানী কায়রোসহ গোট দেশটাই ইসরাইলের কাছে হারানোর শঙ্কা দেখা দেয়। যুদ্ধ করে ইসরাইলের সঙ্গে পেরে উঠা যাবে না বুঝতে পেরে সোভিয়েত বলয় থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতে থাকে মিশর। পরে ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করে ইসরাইলের কাছে হেরে যাওয়া সিনাই উপদ্বীপ ফিরে পায় দেশটি।

ইয়াসির আরাফাতও বুঝতে পারেন, সর্বাত্মক যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর আর সংঘাতের মাধ্যমে লক্ষ্য হাসিল সম্ভব হয় না। তিনি আলোচনার পথ ধরেন। তবে সোভিয়েতপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ইয়াসির আরাফাতের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। তাদের মত হলো— আলোচনার টেবিলে পশ্চিমাদের সঙ্গে পেরে উঠা যাবে না। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানেও যে পেরে উঠা যাবে না, তা বুঝতে চাননি তারা। এখানেও দেখা যায়, ফিলিস্তিনিদের ভালো মন্দের চেয়ে মার্কিন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বই বুদ্ধিজীবীদের কাছে বড় হয়েছে। ঝানু গেরিলা নেতা ইয়াসির আরাফাত বুঝতে পারেন—আলোচনার টেবিলে বসলে অবশিষ্ট ভূখণ্ড ইসরাইল আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে একটি স্থিতিশীল দেশ সম্ভব হলেই কেবলই ফিলিস্তিনিরা শান্তিতে বাস করতে পারবে।

সংঘাত ছেড়ে  ইয়াসির আরাফাত যে রাজনৈতিক চাল দিয়েছিলেন তা যুদ্ধে হারা কোনো জাতির জন্য টিকে থাকার একমাত্র পথ। তিনি দুই দেশ সমাধান তত্ত্বকে গ্রহণ করেন ও তা বাস্তবায়নে কূটনৈতিক পথে অগ্রসর হন। ইয়াসির আরাফাত অবশিষ্ট ফিলিস্তিনকে এমন একটি রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিলেন যেখানে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে বাস করবে। অর্থাৎ, তার প্রস্তাব মতো রাষ্ট্র গঠিত হলে ইহুদিবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি চরম হুমকিতে পড়ে যেত। তিনি নিশ্চিত পরাজয়ের পথ ছেড়ে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের চেয়ে উন্নততর কাঠামোর রাষ্ট্র তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তখন ফিলিস্তিন বিশ্বদরবারে মজলুম রাষ্ট্র হিসেবে আলোচনার টেবিলে আরও শক্তিশালী হতো, দেনদরবারে এগিয়ে থাকত ও তার পুরো ফল নিজেই ভোগ করত।

প্রতিবারের লড়াইয়ে ইসরাইলের নৃশংসতা নব নব রূপে আরও কয়েকগুণ বেশি বেড়ে যায়।

দীর্ঘ সংঘাতের পর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১৯৯৩ সালে ওসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির আওতায় ফিলিস্তিন ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং পশ্চিমতীর ও গাজা উপত্যকা থেকে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী সরে যায়। একটি অন্তর্বর্তী স্বশাসিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়। এর মাধ্যমে জাতিসংঘ পরবর্তীতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার দ্বার উন্মোচিত হয়ে যায়। এতে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে মেনে নেয় ইসরাইল আর ইসরাইলকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয় পিএলও। এর মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে বসে পরের বিবাদমান বিষয়গুলো সমাধান হওয়ার পথ খোলে। ইয়াসির আরাফাতের পথ ধরে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৩৮টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছে ফিলিস্তিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নানা সময় ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে। বারাক ওবামার শাসনামলের শেষ দিকে ইসরাইলকে চাপ দেওয়া হয় যেন তারা দুই রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয়।

ফাতাহ যখন সংঘাত ছেড়ে আলোচনার পথ বেছে নেয়, তখন ফিলিস্তিনে গঠিত হয় আরেকটি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। পশ্চিম তীরে ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে গণজাগরণের মধ্য দিয়ে ১৯৮৭ সালে হামাসের সৃষ্টি। এই সংগঠনটি ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ মুভমেন্টের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের সনদে ঘোষণা করে—গোটা ইসরাইল নিয়েই ফিলিস্তিন একটি ইসলামিক রাষ্ট্র হবে। যা বাস্তবতার নিরিখে অনেকটাই অসম্ভব এক লক্ষ্য।

দীর্ঘদিন লড়াই করে ইয়াসির আরাফাত যখন ফিলিস্তিনের প্রকৃত মুক্তির নতুন পথ হিসেবে আলোচনাকেই বেছে নিয়েছিলেন, তখন হামাস ফের সংঘাতের পথকে বেছে নেয়। এতে তারা কতটুকু সফল হয়েছে তা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। কারণ শক্তি ব্যবহার করে ইসরাইলের দখলদারিত্বে কোনো লাগাম টানতে পারেনি সংগঠনটি। সংঘাতের পথে বারবার হেরে গিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলো ও আরব মিত্ররা। বরং প্রতিবারের লড়াইয়ে ইসরাইলের নৃশংসতা নব নব রূপে আরও কয়েকগুণ বেশি বেড়ে যায়। অস্ত্র ব্যবহার করে ফিলিস্তিনের স্থিতিশীলতাকেই কেবল বিলম্বিত করা ছাড়া কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

কে জানে সংঘাত ছেড়ে ইয়াসির আরাফাতের কূটনৈতিক পথে স্বাধীন হতে পারলে ও শক্তিমত্তায় আরব দেশগুলোর উপর নির্ভর না করে নিজের পায়ে দাঁড়ালে একসময় ইসরাইলের কাছে হারানো ভূখণ্ডও হয়ত ফিরে পেতে পারত ফিলিস্তিন। কারণ ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি রাষ্ট্র একসময় ভাঙতে বাধ্য।

লেখক: নিউজরুম এডিটর, সারাবাংলা

আতিকুল ইসলাম ইমন টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর