Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমাদের সরদার স্যার

রহমান মুস্তাফিজ
১৫ জুন ২০২৩ ১৬:২৪

২০১৪ সালের ১৫ জুন। সরদার ফজলুল করিম স্যার সেদিন যাত্রা করেছিলেন অনন্তলোকে। স্যারের মৃত্যু সংবাদ যেন বুকে বিঁধেছিল। এখনও স্মৃতিতে ভাসে স্যারকে নিয়ে টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি। সরদার ফজলুল করিম ছিলেন একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। তার পরিচয় শুধু শিক্ষক নয়। তিনি দার্শনিক, লেখক, রাজনীতিক হিসেবেও ছিলেন সমুজ্জ্বল।

সরদার ফজলুল করিম ১৯২৫ সালের পয়লা মে জন্মগ্রহণ করেন। বরিশালের আটিপাড়া গ্রামের কৃষক খবিরউদ্দিন সরদার তার বাবা। মা সফুরা বেগম ছিলেন গৃহিনী। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষে ফজলুল করিম ১৯৪০ সালে ঢাকায় আসেন।

১৯৪২ সালে আইএ পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৫ সালে দর্শণশাস্ত্রে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৪৬ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ততার জন্য পাকিস্তান সরকারের জুলুম নির্যাতনের শিকার হন। তিনি ১১ বছর কারাভোগ করেন। জেলে থাকা অবস্থাতেই ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সংবিধান সভার সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন।

১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা উন্নয়ন কেন্দ্র ও বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। দায়িত্ব পালন করেন এর উপ-পরিচালক হিসেবে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আবার গ্রেফতার হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি অবসরে যান।

সময়জ্ঞান
১৯৮৯ সালের কথা। সরদার স্যারের মগবাজারের বাসায় গেলাম। যাওয়ার পথে আমার অরিয়েণ্ট হাতঘড়িটা হারালাম তাড়াহুড়ো করে বাসে উঠতে গিয়ে। তাড়াহুড়োর কারণ ছিল স্যার সময় মেপে চলতে পছন্দ করতেন। স্যারের বাসায় নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছায় স্যার খুব খুশি হলেন। আক্ষেপ করে বললেন, এখন আর কেউ সময়ের মূল্য দেয় না। এটা জাতিগত সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

১৯৯৬ সালে স্যারকে সোমেন চন্দ পদক দেয়া হলো। অনুষ্ঠান বিকেল ৪টায়। এর কিছুদিন আগে স্যারের পা ভাঙলো। তাই স্যার সময় মতো আসতে পারলেন না। কিন্তু স্যারের সময়ানুবর্তিতাকে সম্মান জানাতে অনুষ্ঠান ঠিক ৪টাতেই শুরু করলাম। তখন মিলনায়তনে উপস্থিত সভার সভাপতি হেনা দাস (প্রয়াত), আমি ও মাইকম্যান। স্যার এসে খুব খুশী হয়েছিলেন সময় মতো অনুষ্ঠান শুরু হওয়ায়।

স্যারের ভালোবাসা
১৯৮৯ সালে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্যার নানান পরামর্শ দিয়ে আমাদের সহায়তা করেছেন। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরেই আমার নামটি পাল্টে যায়। একদিন সরদার স্যার বললেন, বাংলাদেশে হাজার হাজার মুস্তাফিজুর রহমান আছে। কিন্তু তোমার মত কেউ নেই। তুমি এ বয়সেই যে কাজে হাত দিয়েছো তা অতুলনীয়, অন্যদের চেয়ে তুমি আলাদা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাশ করেও অনেকে সোমেন চন্দের নাম জানেন না। অথচ তুমি হারিয়ে যাওয়া গণসাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্বকে ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনেছো। তাই তোমার নামটি বদলে দিচ্ছি। এরপর থেকেই আমি রহমান মুস্তাফিজ হয়ে উঠি।

এ অনুষ্ঠানকে ঘিরেই স্যারের কল্যাণে সান্নিধ্য পেয়েছিলাম বাংলা সাহিত্যের আরেক জ্যোতির্ময় মানুষ ‘অধ্যাপক কবীর চৌধুরী’র। আমরা বন্ধুরা চেয়েছিলাম শহীদ সাহিত্যিক সোমেন চন্দের মৃত্যুবার্ষিকী অনুষ্ঠানে সরদার স্যার সভাপতিত্ব করুক। স্যারের সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি বললেন, অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জীবদ্দশায় সোমেন চন্দ ইস্যুতে অনুষ্ঠিত কোন সভায় তিনি সভাপতিত্ব করতে পারেন না। স্যারের কথা মত আমরা কবীর চৌধুরী স্যারের সাথে যোগাযোগ করি।

উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর কার্যালয়ে আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। আলোচক ছিলেন অধ্যাপক ডক্টর হায়াৎ মামুদ, সাংবাদিক শুভ রহমান, ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক কর্মী আবু নাহিদ, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ও অধ্যাপক ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষ। এতে শহীদ সাহিত্যিক সোমেন চন্দের সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে কাঁচা হাতের লিখিত প্রবন্ধটি ছিল রহমান মুস্তাফিজের।

অনুষ্ঠানের পর স্যার দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় উপ-সম্পাদকীয় লিখলেন আমাদের তিন বন্ধু… সৈয়দ হাফিজুর রহমান (বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক), নজরুল কবীর (সাংবাদিক) ও আমাকে নিয়ে। উপাধি দিলেন- ‘সাহিত্যের প্রত্নতাত্ত্বিক’।

স্যারের অভিমান
১৯৯৬ সালে স্যারকে সোমেন চন্দ পদক দেয়া হলো। সোমেন পদকের টাকাটা চেক-এ দেয়া হয়েছিল। ভুল করে সম্মানির টাকা অন্য একটা অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছিল। স্যারব্যাংকে গিয়ে দেখলেন অ্যাকাউন্টে টাকা নেই। ফিরে এলেন। আমাকে কিছু বললেন না, কিন্তু দুঃখ পেয়েছিলেন।

বেশ কিছুদিন পর ঘটনা জানতে পারি বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমান সোহেলের কাছে। আমি চ্যালেঞ্জ করে বললাম, এটা হতেই পারে না, আমি নিজের হাতে আমার বেতনের পুরো টাকা অ্যাকাউন্টে জমা দিয়েছি। আমার তখন কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। আরেক বন্ধু শিল্পী শামীনুর রহমান শামীমের অ্যাকাউন্টে টাকাটা জমা দিয়েছিলাম, অগ্রনী ব্যাংকের বাংলা একাডেমি শাখায়।

শামীমের সাথে কথা বললাম। শামীমও জানালেন তিনি অ্যাকাউন্ট থেকে কোন টাকা তোলেননি। তাহলে? শামীমও তখন সন্দেহ পোষণ করলেন আদৌ আমি ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছি কিনা। শেষ পর্যন্ত সমস্যা চিহ্নিত করা গেল। শামীম চেক দিয়েছেন রূপালী ব্যাংকের নিউ মার্কেট শাখার, আর আমি টাকা জমা দিয়েছি অগ্রনী ব্যাংকের বাংলা একাডেমি শাখায়। শেষ পর্যন্ত সমস্যার সমাধান হয়।

স্যারের আবেগ
প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ (১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত, ১৯৪৭-এর পরেও কিছুদিন এর কার্যক্রম ছিল) নিয়ে কথা বলতে স্যার খুব পছন্দ করতেন। লেখক ও শিল্পী সংঘের দিনগুলো নিয়ে গল্প করতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। রমেন মিত্র (কমরেড ইলা মিত্রের স্বামী, নাচোলের জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী), রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন-দের কথা বলতেন খুব আবেগ নিয়ে।

রাষ্ট্রচিন্তার ছোট্ট নমুনা
১৯৮৫ সালে স্যার অবসরে যান। তার অবসরে যাওয়ার কথা কি ভাবে জানানো হবে তা ভেবে পাচ্ছিলো না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অথচ, কাগজপত্রে তিনি তখন অবসরে। সময় মতো ক্লাসে হাজির হন। দর্শন বিভাগের জাদরেল সব অধ্যাপক ক্লাস নিতে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কথা বলার সাহস নেই তাদের। কারণ, তিনি অধ্যাপক, কিংবা সহযোগী অধ্যাপক যা-ই হোন না কেন, তিনি নিজে এবং তার অনেক শিক্ষকই সরদার স্যারের ছাত্র। শেষ পর্যন্ত স্যারকে অন্য একটা দায়িত্ব দেয়া হলো। বসতে হয় রেজিস্টার বিল্ডিং-এ।

একদিন স্যারের কাছে গেলাম পঞ্চাশের দশকের কিছু তথ্য জানার জন্যে। আমাকে পেয়েই স্যার সব রাগ আমার ওপর ঝাড়লেন। বললেন, তোমরা সাংবাদিকরা কি করো? এই যে আমার মতো একজন মানুষকে অকারণে বসিয়ে বেতন দেয়া হচ্ছে, এতে রাষ্ট্রের কতো টাকা ক্ষতি হচ্ছে জানো? মাথা নাড়লাম দু’দিকে। দেখলাম, স্যার একটা কাগজে হিসেব করে রেখেছেন। তাতে আছে সরকারের কতো টাকা ক্ষতি হয়েছে সেই হিসেব। তার সঙ্গে যোগ করেছেন, শিক্ষার্থীরা কি ভাবে বঞ্চিত হচ্ছে তার ক্লাস না পেয়ে। শিক্ষার্থীরাও এতে আর্থিক ভাবে যে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারও হিসেব আছে তাতে।
এমন শিক্ষক আর কয়জন আছেন আমাদের এ দেশে?

আমাদের দুর্ভাগ্য
এমন অসংখ্য স্মৃতি মনে পরে। ২০১৪ সালের ১৪ জুন স্যারের অসুস্থতার কথা জানতে পারি। আমি তখন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের বার্তা প্রধান। হাসপাতালে ক্যামেরা পাঠিয়েছিলাম। ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশের অনুমতি পেলেন না রিপোর্টার। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বোঝেনি তারা কী থেকে বাঙালি জাতিকে বঞ্চিত করলো। তাদের নিয়মের বেড়াজালে আটকে স্যারের শেষ দিনটির কোন প্রামাণ্য দলিল রাখা গেল না। এ ক্ষত বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, সারাবাংলা ডটনেট; লেখক ও নির্মাতা

সারাবাংলা/রমু/এএসজি

আমাদের সরদার স্যার টপ নিউজ রহমান মুস্তাফিজ সংবাদ সম্প্রসারণ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর